বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক সংকট এড়াতে এবং বিদ্যুৎ ও তেলের খরচ কমাতে একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। যার অংশ হিসেবে এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টা লোডশেডিং, প্রয়োজনের বাইরে এসি বন্ধ রাখা, রাত ৮টার পর দোকানপাট-শপিংমল বন্ধসহ বেশকিছু ঘোষণা এসেছে।

সামনের দিনে কর্মঘণ্টা কমিয়ে ভার্চুয়াল অফিস করাসহ আরও কিছু পদক্ষেপ আসতে পারে। সংকট সমাধানে লোডশেডিংসহ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সাধুবাদ পেলেও মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারি বড় কর্তাদের ক্ষেত্রেও একই আদেশের বাস্তবায়ন চান সংশ্লিষ্টরা।

এমনকি জ্বালানি বিশেষজ্ঞরাও সংকট মোকাবিলায় সব পর্যায় থেকে দেশপ্রেমের নজির দেখতে চান। তারা বলছেন, লোডশেডিং সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘমেয়াদে সুফল আনবে না। বরং জ্বালানি খাতের সংস্কার, স্বচ্ছতা ও গ্যাস-কয়লার মতো নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতের প্রতি জোর দিতে হবে।

যেমনটা বলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, লোডশেডিং কখনই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হতে পারে না। এটা সাময়িক সমাধানের চেষ্টা বলতে পারেন। এমন ঘটনা যদি জনগণ দেখতে পেত যে একজন মন্ত্রী হাতপাখা হাতে বাতাস করছেন, তারাও জনগণের সঙ্গে লোডশেডিং মেনে নিচ্ছেন, জনগণের কাতারে দাঁড়িয়ে সরকারের বড় বড় কর্মকর্তা তা অনুকরণ করছেন; তাহলে সমান ও সমতার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠিত হতো। মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সরকারের আদেশে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু সরকারের এমন আদেশে কীভাবে এর সুফল জনগণ পাবে? লোডশেডিং আগেও ছিল, এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

আরও পড়ুন>> রাত ৮টার পর দোকানপাট-শপিংমল বন্ধ না করলে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন

বিকল্প সমাধানের বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক শামসুল বলেন, আমরা এর আগে ১১ দফা সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছি। জ্বালানি নীতি তৈরি করে দিয়েছি। এগুলোর আলোকে জ্বালানি খাতের আমূল সংস্কার, দায় নিরূপণ ও লোডশেডিং মোকাবিলার প্রস্তাব বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)-এর মাধ্যমে স্টেকহোল্ডারের মতামতের ভিত্তিতে করা যেত। তাহলে সব শ্রেণির মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হতো। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে যেমন সব মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, তেমনি এই সংকট মোকাবিলার জন্য জনগণ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অংশগ্রহণ করতো। কিন্তু সেটা হয়নি। আমাদের দেওয়া সংস্কার প্রস্তাবগুলোতে উত্তরণের উপায়গুলো বলা আছে। আমরা সে বিষয়গুলো বারবার বলে যাচ্ছি।

যদিও লোডশেডিং ইতিবাচক হিসেবেই দেখছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ও জ্বালানিবিষয়ক বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ম তামিম। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, লোডশেডিং করার মধ্য দিয়ে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদন কম করছি। উৎপাদন কম করলে আমাদের জ্বালানি কম লাগবে। জ্বালানি কম লাগলে আমাদের সাশ্রয় হবেই। লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে সাশ্রয় করার কৌশল একটি স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস। এটা নতুন কিছু না, আগেও হয়েছে। তবে আগে হয়েছিল আমাদের উৎপাদন ক্ষমতা ছিল না বলে। বর্তমানে উৎপাদন ক্ষমতা আছে, কিন্তু জ্বালানির অভাবে লোডশেডিং করতে হচ্ছে। এটা কার্যকর পদ্ধতি। যেহেতু আমাদের অনেক জ্বালানি আমদানি করতে হয়, সেটা সাশ্রয়ের লক্ষ্য নিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এর ফলে রপ্তানি খাতে কোনো প্রভাব পড়বে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইপিজেড এলাকা তো লোডশেডিংয়ের আওতায় আসবে না। তবে অন্যান্য জোনে কিছু শিল্প রয়েছে, সেসব জায়গায় সরকার চেষ্টা করবে যেন লোডশেডিং না হয়, বিদ্যুৎ নিয়মিত রাখা হয়।

ম তামিম বলেন, বিশ্বে যখন চালের ঘাটতি হয় তখন সমাধান কী? গম বা অন্য খাদ্যের মাধ্যমে তা পূরণ করা। জ্বালানির ক্ষেত্রেও তাই। যদিও এটা জ্বালানি সংকট নয়। রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে চাইলেই আমরা সমাধান করতে পারব না। এখন আমদের নিজস্ব গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টা করতে হবে এবং নিজস্ব কয়লা ব্যবহারেও চিন্তাভাবনা করতে হবে। অর্থাৎ নিজস্ব সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আমরা আমদানির জন্য পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় করতে না পারি, ততদিন পর্যন্ত আমাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সাশ্রয়ী কৌশল অবলম্বন করতে হবে।

বিশ্ববাজারে জ্বালানির দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে ডিজেলের দাম ‘আকাশচুম্বী’ হওয়ায় আপাতত দেশের ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে উৎপাদন স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। গত ১৮ জুলাই জ্বালানি পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বৈঠকে অফিসের কর্মঘণ্টা কমিয়ে আনা, ভার্চুয়ালি অফিস করা, এসি ব্যবহারে সংযমী হওয়াসহ বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বিশ্বজুড়ে জ্বালানি সংকট চলার কথা তুলে ধরে বলেন, 'ধৈর্য ধরে যদি আমরা এটা সহ্য করে সবাই মিলে অতিক্রম করি, তাহলে ইনশাল্লাহ ভবিষ্যতে আবার সুদিন আসবে। আমরা আজ যা আলোচনা করেছি তার উল্লেখযোগ্য দিক হলো, আমরা আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে, যাতে আমাদের খরচ কম হয়, সহনশীল হয়; সেই পর্যায়ে নিয়ে আসা। ডিজেলের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন আপাতত আমরা স্থগিত করলাম। এতে অনেক টাকা সাশ্রয় হবে।'

সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে সারাদেশে প্রতিদিন সূচি ধরে অন্তত এক ঘণ্টা করে বিদ্যুতের লোডশেডিং শুরু হয়েছে। প্রথমদিন মঙ্গলবার (১৯ জুলাই) সারাদেশে মোট এক হাজার ৯১৫ মেগাওয়াট লোডশেডিং হয়েছে। মানুষের যাতে সমস্যা কম হয়, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পায়, সেজন্য সূচি ঠিক করে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

ডিপিডিসি ও ডেসকো নিজেদের ওয়েবসাইটে লোডশেডিংয়ের সূচি প্রকাশ করেছে। দেশের বাকি এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্বে থাকা বাকি চার কোম্পানিও আলাদাভাবে নিজেদের সূচি গ্রাহকদের জানিয়ে দেবে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, এখন কয়লা থেকে ৭ দশমিক ৮৯ শতাংশ, গ্যাস থেকে ৫০ দশমিক ৮৪ শতাংশ, ফার্নেস অয়েল থেকে ২৮ শতাংশ এবং ডিজেল থেকে ৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এ অবস্থায় জ্বালানি সাশ্রয় নীতির কারণে দিনে এক থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।

আরএম/জেডএস