ইতালি প্রবাসী ভাইয়ের পাঠানো রেমিট্যান্স কিংবা ব্যাংকে সম্পত্তি মর্টগেজ দিয়ে ঋণের বিপরীতে রাজধানীর বনশ্রী ও গুলশান নিকেতনে বহুতল ভবন এবং রাজউকের পূর্বাচলে ৩ কাঠার প্লটের মালিক হয়েছেন বাংলাদেশ রেলওয়ের নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) সদ্য অবসরপ্রাপ্ত কমান্ড্যান্ট মো. মিজানুর রহমান।

ঘটনা সত্যি হলে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা ছিল না। কিন্তু রেমিট্যান্সের মিথ্যা নাটক ও ঋণের জাল কাগজপত্র দিয়ে কি সত্যকে চাপা দেওয়া যায়? যে প্রবাসী ভাইকে অবলম্বন করে অবৈধ আয়কে বৈধ করার চেষ্টা করেছেন, সেই ভাইও শেষ পর্যন্ত একমাত্র ভাইয়ের বিপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন। ফলে শেষ রক্ষা হলো না রেলওয়ের ওই নিরাপত্তা কর্মকর্তার। অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে ঋণের সত্যতা পাওয়া যায়নি।

মিজানুর রহমানের দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণীতে মিথ্যা ও ভিত্তিহীন ৪৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকার তথ্য গোপন ও ৬৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকার জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ সম্পদ অর্জনের মামলার আসামি হতে যাচ্ছেন তিনি। দুদকের অনুসন্ধানে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়ায় সম্প্রতি মিজানুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলার অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। শিগগিরই অনুসন্ধান কর্মকর্তা উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ মামলাটি দায়ের করবেন বলে জানা গেছে।

এ বিষয়ে দুদকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, মিজানুর রহমানের সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে তার রেমিট্যান্স প্রাপ্তিসংক্রান্ত ব্যাংক হিসাব বিবরণী ছাড়া অন্য কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তিনি বারবার ভাইয়ের রেমিট্যান্সের দোহাই দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। তবে তার একমাত্র ভাই সাজ্জাদ যিনি ২০ বছর ধরে ইতালিতে ছিলেন, তিনি বড় ভাইয়ের তথ্য অস্বীকার করেছেন। বড় ভাইকে ঋণ ও রেমিট্যান্স দেননি বলে জানিয়েছেন। এ ছাড়া ২০০৯-২০১০ করবর্ষে তিন কাঠা জমি বন্ধক বাবদ ১৫ লাখ টাকা প্রদর্শন করার চেষ্টা করলেও কোনো রেকর্ডপত্র ও সাক্ষ্য দিতে পারেননি। অর্থাৎ তার অবৈধ আয়কে বৈধ করার বৃথা চেষ্টা করেও শেষ রক্ষা হয়নি। শিগগিরই তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হতে যাচ্ছে।

অনুসন্ধান প্রতিবেদন সূত্রে দেখা যায়, ২০১৭ সালে মো. মিজানুর রহমান যখন চট্টগ্রাম রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সহকারী কমান্ড্যান্ট তখন তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করা হয়। প্রাথমিক অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়ায় ২০১৯ সালের ১৮ এপ্রিল তার বিরুদ্ধে সম্পদ বিবরণী দাখিলের আদেশ জারি করা হয়। ওই বছরের ২ মে তার নামের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ও দায়-দেনার বিবরণসহ সম্পদ বিবরণী দুদক সচিব বরাবর দাখিল করা হয়।

মিজানুর রহমান ১৯৮৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর এস আই হিসেবে বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীতে যোগদান করেন। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৯ মার্চ কমান্ড্যান্ট হিসেবে পদোন্নতি পেয়ে তারিখে অবসর গ্রহণ করেন। তার স্ত্রী ও তিন সন্তান রয়েছে।

তার দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী ও এনবিআরের দাখিলকৃত আয়কর বিবরণী যাচাই-বাচাইয়ের দেখা যায়, মিজানুর রহমানের রাজধানীর বনশ্রীর ইস্টার্ন হাউজিং থেকে ক্রয়কৃত ২ দশমিক ৫০ কাঠা জমি ওপর নির্মিত সাড়ে পাঁচ তলা ভবনের অর্ধেকের মালিকানা, গুলশান নিকেতনের সাত তলা ভবনসহ ৫ কাঠা জমির ২৫ শতাংশের মালিকানা এবং রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পূর্বাচল প্রকল্পের নতুন শহরে ৩ কাঠার প্লটের মালিকানা রয়েছে, যা তিনি তার দাখিলকৃত সম্পদ বিরবণীতে এসব সম্পত্তির মাত্র ৮৮ লাখ ৬৭ হাজার ৭৩৬ টাকা মূল্যে ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এসব সম্পত্তির মূল্য অন্তত পাঁচগুণেরও বেশি। এমনকি দালিলিক মূল্য হিসাব করলেও দুদকের অনুসন্ধানে এসব সম্পদের মূল্য পাওয়া যায় ১ কোটি ১৮ লাখ টাকার বেশি। কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি অর্জন করেছেন তিনি।

অন্যদিকে তিনি তার দাখিলকৃত সম্পদ বিরবণীতে নিজ নামে ১৬ লাখ ৩৪ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য দাখিল করেছেন। কিন্তু সম্পদ বিবরণী যাচাইকালে তার নামে ৩৫ লাখ ৩৯ হাজার ৯৯৭ টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য পাওয়া যায়। এখানে তিনি ১৯ লাখ সাড়ে ৫ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদ অর্জনের তথ্য গোপন করেছেন। স্থাবর ও অস্থাবর মিলিয়ে দালিলিক হিসাবে ৪৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকার সম্পদের তথ্য গোপনের প্রমাণ পাওয়া গেছে দুদকের অনুসন্ধানে।

দুদকের অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, গুলশান নিকেতন ও বনশ্রীতে বাড়ি নির্মাণ করার সময় মিজানুর রহমানের নিকট উক্ত বাড়ি নির্মাণের জন্য বৈধ অর্থ ছিল না। তাই তিনি তার অবৈধ উপায়ে অর্জিত মোট ৬৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা বৈধ করার জন্য ইতালিতে অবস্থানরত তার ভাইয়ের বাড়ি নির্মাণের জন্য পাঠানো রেমিট্যান্সকে তিনি নিজের আয় হিসেবে প্রদর্শন করার চেষ্টা করেছেন। এ ছাড়া, জমি বন্ধক দেয়ার মিথ্যা তথ্য আয়কর নথিতে প্রদর্শন করেছেন। অর্থাৎ ওই টাকা বৈধ করার নানান কৌশল অবলম্বন করেছেন তিনি। যা দুদকের অনুসন্ধানে জ্ঞাত আয়ের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বলে প্রমাণিত হয়েছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।

এ বিষয়ে দুদক উপপরিচালক মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জনসংযোগ দপ্তরের যোগাযোগ করতে বলেন। অন্যদিকে সাবেক কমান্ড্যান্ট মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

আরএম