তৃতীয় পর্ব

হার না মানা গল্পগুলোই মানুষকে স্বপ্ন দেখায়। এমন গল্পের সীমানা থাকে না। সীমানা থাকতেও নেই। শ্রমই যার পুঁজি, তারে দমায় কে? দেহশক্তিতে ভর করে যে বাঁচতে চায়, তার বেঁচে থাকার জমিন যেন গোটা দুনিয়াতেই।

সুদূর মরুর দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে এমন শ্রমের জমিন বিছিয়েছেন বাংলাদেশের নওশাদ। সঙ্গে আরও কয়েকজন। নওশাদদের ঠিকানা দুবাইয়ের প্রসিদ্ধ আল-আওয়ির ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল মার্কেটে। বাংলাদেশিরা অবশ্য একে আবির মার্কেট বলেন।

নওশাদের পেশা ট্রলি বহন। এ মার্কেটে যারা বাজার করতে আসেন তাদের পণ্য বহন করেন তিনি। বাংলাদেশে যারা কুলি হিসেবে পরিচিত। ঢাকার কারওয়ান বাজারসহ বড় বড় কাঁচা বাজারে দেখা মেলে এমন শ্রমিকের।

আরও পড়ুন >> যেখানে স্বপ্ন ঝরে অশ্রু হয়ে

প্রশ্ন উঠতেই পারে, কুলির কাজ করতে দুবাই! হ্যাঁ, এমন প্রশ্নের উত্তর মিলবে শ্রমের মূল্য দিয়ে। এখানে একজন শ্রমিক দৈনিক দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা (বাংলাদেশি মুদ্রা) আয় করেন অনায়াসেই। সম্মানও ভালো। নির্দিষ্ট পোশাক আর ট্রলি দিয়েই তাদের পরিচয়। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে তারা পরিচিত ‘বাংলাদেশি’ বলে।

দুবাইয়ের প্রসিদ্ধ আল-আওয়ির ফ্রুটস অ্যান্ড ভেজিটেবল মার্কেট | ছবি- ঢাকা পোস্ট

পৃথিবীর অন্যতম ব্যস্ততম শহরের মার্কেটগুলোতে ট্রলি হাতে যারা পণ্য বহনে নিয়োজিত, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ থেকে আসা। অনেকে বছরের পর বছর ধরে এ পেশায় যুক্ত। অনেকে আবার অন্য পেশার ভিসা নিয়ে এসে কুলির পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। প্রধান কারণ, অধিক মজুরি এবং নগদ আয়।

আধঘণ্টা পরপর সিরিয়ালি একজন একজন করে ডাক পান। নির্দিষ্ট ফি থাকলেও অনেকে বকশিশ দিয়ে খুশি করেন শ্রমিকদের। আর বকশিশ থেকেই অধিক আয়ের সুযোগ পাচ্ছেন তারা।

প্রতিটি ট্রলিম্যানের (কুলি) সঙ্গে কথা বলে একটাই উত্তর মেলে, ‘অন্যদের চেয়ে অনেক ভালো আছি, প্রশান্তিতে আছি, স্বস্তিতে আছি।’

কথা হয় সিলেটের আব্দুর রহমানের সঙ্গে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছেন। ১৮ হাজার দিরহামে সেলসম্যানের ভিসা লাগিয়ে প্রথমে একটি দোকানে কাজ শুরু করেন। গত চার বছর ধরে আবিরের এই ফ্রুট মার্কেটে ট্রলিম্যানের কাজ করছেন। দেশে দুই ছেলে। একটির বয়স ১০, আরেকটির দুই বছর। মাসে আয় আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার দিরহাম। ৬০০-৭০০ দিরহাম খরচের পর বাকি টাকা পাঠান বাংলাদেশে থাকা স্ত্রীর কাছে। সবমিলে খুশি তিনি।

কাজের ফাঁকে বিশ্রামরত এক বাংলাদেশি শ্রমিক | ছবি- ঢাকা পোস্ট

উচ্ছ্বাসিত আব্দুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কাস্টমার আসলে আমরা মাল তুলে দেই, তারা আমাদের পয়সা দেয়। যা দেয়, তা দিয়ে ভালোই চলে যায়; আলহামদুলিল্লাহ। খুব শান্তিতে আছি। ভালোভাবে থাকি, ভালোভাবে খাই, সবাই একসাথে কাজ করি, দেশে ভালো টাকাও পাঠাই। আপনারা আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

এই মার্কেটে ট্রলিতে মালামাল বহনের নিয়ম আছে। একজন ট্রলিম্যান একজন গ্রাহককে সেবা দেওয়ার পর আরেকজনের সিরিয়াল আসে। এভাবে ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট পরপর সিরিয়াল মেলে। মাঝে বিশ্রামের ভালো সময়ও পাওয়া যায়।

কাজের ফাঁকে এভাবেই ট্রলি শুয়ে বিশ্রাম করেন বাংলাদেশি শ্রমিকরা | ছবি- ঢাকা পোস্ট

কথা হয় বিশ্রামরত অপর এক বাংলাদেশির সঙ্গে। পরিচয় না দিয়ে তিনি জানান, বয়স ৬১। ট্রলি চালান। দেশে এমন কোনো পেশা নেই। থাকলেও এখানকার মতো এত কাজের সুযোগও নেই। দেশে সর্বোচ্চ ১০-১৫ হাজার টাকা আয় করা যেত। কিন্তু পরিবার-পরিজনের কাছে সম্মান মিলত না। এখানে আল্লাহর রহমতে যে আয় হয়, থাকা-খাওয়ার খরচ বাদ দিয়ে মাসে ৪০ হাজার টাকা দেশে পাঠানো যায়। এখানে নিশ্চিন্তে-নির্বিঘ্নে কাজের সুযোগ মেলে। কেউ ডিস্টার্ব করে না। আল্লাহর রহমতে ভালো আছেন। সবার জন্য দোয়া প্রার্থনাও করেন তিনি।

সবচেয়ে বড় বিষয়, ভালো টাকা পাঠানো যায় দেশে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

সংযুক্ত আরব আমিরাতের বেশ কয়েকটি শহরে কাজ করার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে তিনি আরও জানান, এখানে আয় করতে হয় ধৈর্য ও ভালো ব্যবহার দিয়ে। আয়ের একটা বড় অংশ আসে গ্রাহকের বকশিশ থেকে। তাদের সঙ্গে যত ভালো ব্যবহার করা যাবে তত বকশিশ মিলবে। এমনও হয়, খুশি হয়ে কেউ ১০০ দিরহাম (প্রায় ২৪০০ টাকা) পর্যন্ত বকশিশ দিয়ে থাকেন।

আরও পড়ুন >> জীবিত থাকলে রেমিট্যান্স যোদ্ধা, মারা গেলে বেওয়ারিশ 

আবির মার্কেটে লোডার পদেও বাংলাদেশিরা কাজ করেন। তারা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ফল ও সবজিবোঝাই কন্টেইনার থেকে মালামাল নামিয়ে মাথায় করে গোডাউনে নিয়ে যান। আবার কেউ গোডাউন থেকে দোকানে মাল নিয়ে যান।

তাদের একজন শাহাদাত। কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল, দুপুর ও রাতে ফল-সবজির কন্টেইনার আসে এখানে। শুধু বাংলাদেশি নয়, পাকিস্তানি-ভারতীয়রাও এ কাজ করেন। সবাই একসঙ্গে হাতে হাতে কন্টেইনার থেকে মাল নামিয়ে গোডাউনে ভর্তি করেন। দৈনিক বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫০০ থেকে ১৭০০ টাকা আয় হয়। থাকা-খাওয়া বাদ দিয়ে ভালো অর্থ থাকে। ভালো আয় হওয়ায় কী কাজ করি, বিষয়টি কখনও মাথায় আসে না।

ট্রলি হাতেও খুশি তারা, কারণ ন্যায্য শ্রমের মূল্য মেলে এখানে | ছবি- ঢাকা পোস্ট

মার্কেটের পাশেই একটি সুপারশপের ক্যাশিয়ার পদে আছেন বাংলাদেশি সালেহীন। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে টাকা খরচ করে এখানে এসেছি। এসে হতাশ হইনি। এই দেশে শুধুমাত্র নিয়ম-কানুন মানলেই খুব শান্তিতে থাকা যায়। আর কিছু লাগে না। এছাড়া এখানে প্রতিটি কাজের সম্মান আছে, বিদেশি টুরিস্টরা সবাইকে সমান চোখে দেখেন। ধনী-গরিব, মালিক-কর্মচারী, কোনো বৈষম্য নেই। এককথায় বলতে গেলে, এখানে যে শান্তিতে আছি, বাংলাদেশে কোনোভাবেই তা মিলত না। চলা তো দূরের কথা। এখানে অনেক সুখে আছি ভাই, আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’

এআর/এমএআর/