মহাসড়কে মোটরসাইকেল বন্ধ : বাসমালিকদের ‘ষড়যন্ত্র’ দেখছেন বাইকাররা
ঈদুল আযহা উপলক্ষে সড়কে যানবাহন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে এবং দুর্ঘটনা কমাতে সরকার ঈদের আগে পরে মিলে ৭ দিন মহাসড়কে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে ভোগান্তিতে পড়েছেন লাখো নিয়মিত বাইকার। এর জন্য মোটরসাইকেল চালকরা দোষারোপ করছেন বাস মালিকদের। তবে বাস মালিকরা বলছেন, সরকার তাদের সঙ্গে কথা বলেনি। গণপরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হুট করে নেওয়া সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই কাম্য নয়। সরকার আগে থেকে সবাইকে এ বিষয়ে জানাতে পারত।
দেশের অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকই পরিবহন দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে ব্যক্তিগত এই যানটি ব্যবহার করেন। কিন্তু এবার ঈদে সরকার যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে রাইড শেয়ার করেন না এমন সত্যিকারের মোটরসাইকেল চালকদেরও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে
যারা নিয়মিত ঢাকা থেকে বাড়ি যাতায়াতে ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের অধিকাংশ মোটরসাইকেল চালকই পরিবহন দুর্ভোগ থেকে রেহাই পেতে ব্যক্তিগত এই যানটি ব্যবহার করেন। কিন্তু এবার ঈদে সরকার যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তাতে রাইড শেয়ার করেন না এমন সত্যিকারের মোটরসাইকেল চালকদেরও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
বিজ্ঞাপন
তারা বলছেন, গত ঈদে মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়ায় কোটি কোটি টাকা বাড়তি আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বাস মালিকরা। যার ফলে তারাই সরকারকে বাধ্য করেছেন এমন সিদ্ধান্ত নিতে।
যাত্রীদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন যাত্রী কল্যাণ সমিতি এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, গণপরিবহনের সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে ঈদযাত্রা নিষিদ্ধ না করে এই বাহনটির স্পিড লিমিট করে দেওয়া, লাগেজ-ব্যাগেজ নিয়ে না যাওয়াসহ অন্যান্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে চলাচলের সুযোগ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে।
রাজধানী ঢাকা থেকে বিভিন্ন সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ব্যক্তিগত মোটরসাইকেলে যাতায়াত করেন সিফাত উদ্দিন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের দেশে দুই ক্যাটাগরির বাইকার আছে। এক ক্যাটাগরি হচ্ছে যারা আমরা প্যাশনে বাইক চালাই। আরেক ক্যাটাগরি হচ্ছে যারা খ্যাপ মারে। মহাসড়কে সবার বাইক চালানোর এক্সপেরিয়েন্সও আবার এক নয়। কিছু কিছু মানুষের কারণে এবার বাইক নিয়ে সবার বাড়ি ফেরাটা বন্ধ হয়ে গেছে। আমি সরকারকে বলতে চাই, একটা নির্দেশনা দিয়ে সবাইকে বাড়ি যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হোক। নির্দেশনায় এমন থাকতে পারে যে, ড্রাইভিং এক্সপেরিয়েন্স, ড্রাইভিং লাইসেন্সের মেয়াদ এবং যানবাহনের মেয়াদ ঠিক থাকলে তাকে যেতে দেওয়া হবে। আর এগুলো চেকিংয়ের দায়িত্বে থাকবে হাইওয়ে পুলিশ।
তিনি আরও বলেন, ঈদের সময় বাসগুলো ৫০০ টাকার টিকিট ১ হাজার থেকে ১৫শ টাকা পর্যন্ত নেয়। অনেক মানুষ মোটরসাইকেলে বাড়ি যাওয়া শুরু করায় তাদের এই ব্যবসাটা আর হচ্ছে না। ফলে বোঝাই যায় সরকারের এই সিদ্ধান্তে বাস মালিকদের হাত আছে।
আরেক বাইকার মো. রেজোয়ান শুভ ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোটরসাইকেল কেনার সময় সরকারকে ট্যাক্স প্রদান করা হয়। সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের জন্যও সরকারকে আলাদাভাবে ট্যাক্স দেওয়া হয়। এতকিছুর পরও নিজের যানবাহনে কেন যাতায়াত করতে পারব না?
বাস মালিকদের ইন্ধনের বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, 'এটা ওদের ভুল ধারণা। বাইক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যেদিন মিটিং হয় তখন আমি করোনা এফেক্টেড ছিলাম এবং বাসায় ছিলাম। আমার প্রেসিডেন্ট ছিলেন না। তাহলে আমরা দাবি জানালাম কী করে? আমরা তো মিটিংয়েই ছিলাম না।'
তিনি বলেন, 'সরকার কী চিন্তা করে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা আমরা জানি না। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের জানিয়েছেন বিষয়টি উঠিয়েছে হাইওয়ে পুলিশ। আমাদের ওপর দোষ চাপানো সঠিক নয়।'
বাইক চলাচলে নিষেধাজ্ঞা কতটা যুক্তিযুক্ত- এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক হাদিউজ্জামান ঢাকা পোস্টকে বলেন, মোটরসাইকেল যে ঝুঁকিপূর্ণ যানবাহন সেটি নতুন করে আবিষ্কার করার কিছু নেই। আমরা যারা সড়ক পরিবহন নিয়ে কাজ করি তারা ২০১৬ সাল থেকেই সরকারকে বলেছি মোটরসাইকেল আপনারা নিয়ন্ত্রণ করুন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ মোটরসাইকেলকে আরও প্রণোদনা দিয়েছে, উৎসাহিত করেছে। এখন মোটরসাইকেল মানুষের যাতায়াতের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে জীবিকার জন্য এই মোটরসাইকেলের উপর অনেকে নির্ভরশীল।
তিনি বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় গত ঈদে অনেক মানুষ মারা গিয়েছেন। এটা তো দুই মাস আগের হিসাব। দুই মাস আগেই ঘোষণা করা উচিত ছিল সরকারের। ঈদের আছে আর মাত্র চার-পাঁচ দিন, এই সময়ে ২৫/৩০ লাখ মোটরসাইকেল চালক যারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোটরসাইকেলে বাড়ি যাবেন, তারা কী করবেন? শুধু মোটরসাইকেল বন্ধ করাটা আমি যথার্থ মনে করছি না। তাদের বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা কী হবে, সেই দায়িত্বও সরকারকে নিতে হবে। আমরা জানি গণপরিবহনের সক্ষমতা রয়েছে ৩৪ লাখ যাত্রী পরিবহনের। এখন যদি নতুন করে আরও ৩০ লাখ মানুষ সেই বহরে যুক্ত হয়, তাহলে সব মিলিয়ে এই ৬৫ লাখ যাত্রী কীভাবে বহন করবে তারা?
হাদিউজ্জামান বলেন, এতে আবার হিতে বিপরীতও হতে পারে। দেখা যাবে পশুবাহী খালি ট্রাকে বাড়ি ফিরবেন অনেকে। বা ট্রেনের ছাদে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করবেন। এতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যাবে। যদি দুই মাস আগে আসতো তাহলে এই সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে পারতাম। এখন সরকারের সিদ্ধান্তকে সাধুবাদ জানাতে পারছি না।
এমএইচএন/জেএস