যেখানে স্বপ্ন ঝরে অশ্রু হয়ে
দ্বিতীয় পর্ব
শেরপুরের জালাল উদ্দিন। গ্রামের এক দালালকে ধরে প্রথমে আসেন ঢাকায়। এরপর ঢাকার বিমানবন্দর থেকে সরাসরি সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে। এরই মধ্যে খরচ হয়ে গেছে পাঁচ লাখ টাকা। ঢাকার ট্রাভেল এজেন্সি থেকে বলা হয়েছিল, দুবাই বিমানবন্দরে থাকবে তাদের লোক। তাকে নিয়ে দেবে কাজ।
বিজ্ঞাপন
জীবনের তাগিদে চোখে পাহাড়সম স্বপ্ন নিয়ে ৯ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে দুবাইয়ের বিমানবন্দরে নামেন জালাল। ভিন দেশের জাঁকজমকপূর্ণ বিমানবন্দরেই কিছুটা হোঁচট খায় জালালের স্বপ্ন। অবাক হয়ে দেখলেন, তাকে নিতে কেউ আসেননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও কাউকেই পেলেন না। করোনা পরিস্থিতিতে বিমানবন্দরের গেটেও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে দেন না নিরাপত্তাকর্মীরা।
আদনান রহমানের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্বটি পড়ুন
বাধে বিপত্তি! কী করবেন জালাল? ঠিকমতো শুদ্ধ বাংলাও বলতে না পারা জালাল কোথায় যাবেন? কিংকর্তব্যবিমূঢ় এই বাঙালির স্বপ্ন ফিকে হয়ে চোখে নেমে আসে অন্ধকার! মুহূর্তেই স্বপ্ন চোখের অশ্রু হয়ে ঝরে পড়ল। অনেক ঘোরাঘুরির পর দেখা হয়, আরেক প্রবাসী বাংলাদেশির সঙ্গে। তার পরামর্শে রাত ২টার দিকে ট্যাক্সিতে করে শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে রাস আল খোর শিল্পাঞ্চলে যান তিনি। ওই বাংলাদেশি তাকে বললেন, এ অঞ্চলে কাজ পাওয়া যায়।
রাস আল খোর-এ এসে ঠাঁই হয় এক মার্কেটের মেঝেতে। শীতল টাইলসের মেঝেতেই লাগেজপত্রসহ রাত কাটে তার। টাইলসের শীতলতা যেন তার শরীরেও বয়ে যায়। চোখে ভাসতে থাকে সেই দালাল ও ঢাকার এজেন্সির লোকগুলোর চেহারা। দুঃখ নাকি আক্ষেপ- কী হওয়া উচিৎ তা ভেবেই কাটে রাত।
সরেজমিনে রাস আল খোর শিল্পাঞ্চলের একাধিক মার্কেটে জালালের মতো প্রায় ২০ থেকে ২৫ জন বাংলাদেশিকে শুয়ে থাকতে দেখা যায়। কেউ মোবাইল ফোন চাপছেন, কেউবা চোখ খুলে শুয়ে আছেন, কেউবা ক্লান্তির গভীর নিদ্রায়। চোখমুখে তাদের ভয়ের ছাপ। শোয়া থেকে কেউ উঠে নামাজ পড়ছেন। নামাজ শেষে আবার শুয়ে যাচ্ছেন। তারা কোথায় যাবেন, কীভাবে থাকবেন, পরবর্তী বেলায় কী খাবেন? এসবের কোনো নিশ্চয়তা নেই।
কথা হয় এখনও প্রতারণার ঘোর থেকে বের হতে না পারা জালালের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যার সঙ্গে কন্ট্রাক্ট (চুক্তি) করেছিলাম, তার মোবাইলফোন বন্ধ। বাধ্য হয়ে এখানে আছি। অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে। খালি হাতে দেশে ফিরে যাওয়া আর সম্ভব না। তাই এখানেই থেকে যেতে হবে।’
আবির নামক একটি মার্কেটের চারপাশে আরও অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয়েছে। সাংবাদিক পরিচয়ে তাদের কাছে যেতেই আঁতকে উঠেন তারা। কথা বলতে রাজি হন না। তাদের একজন বললেন, ‘কথা বলে কী লাভ? সবই তো শেষ’।
গাইবান্ধা থেকে দুবাইয়ে এসেছিলেন কাজী আনোয়ারুল বাশার। তিনি বলেন, ‘এখানকার এয়ারপোর্টে নেমে এজেন্টকে ফোন দেই। তিনি আবুধাবিতে রয়েছেন বলে জানালেন। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে, এখন কোথায় যাব? তিনি আমাকে সাত দিন পর ফোন দিতে বললেন। আশ্রয় খুঁজতে খুঁজতে এখানে এলাম। না জানি কতদিন এভাবে থাকতে হয়!’
যারা নতুন এসেছেন শুধু তারাই নন, প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন পুরনোরাও। তাদেরই একজন রেজাউল হক। অন্যদের মতো তিনিও বাংলাদেশির দ্বারাই প্রতারণার শিকার হয়েছেন। সাভারের রাজাবাড়ি এলাকার রেজাউল দীর্ঘ ১৭ বছর ধরে দুবাইতে এলইডিসহ নানা ধরনের বাতির দোকান করেছিলেন। সাঈদুল ইসলাম নামের এক জন তার দোকানে এলে দুজনের পরিচয় হয়। দীর্ঘদিন দোকানে আসা যাওয়া করায় সাঈদুলের সঙ্গে সখ্যতা হয় রেজাউলের। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি রেজাউলের কাছ থেকে গার্মেন্ট শোরুম খোলার কথা বলে বিনা সুদে ৫০ হাজার দিরহাম (বাংলাদেশি প্রায় ১২ লাখ টাকা) ঋণ নিয়েছিলেন। তবে সেই টাকা আর ফেরত দেয়নি। এখন তাকে কোনোভাবে খুঁজেও পাচ্ছেন না রেজাউল। লকডাউনে মন্দার কারণে বাতির দোকান ছাড়তে হয় রেজাউলকে। টাকা না পাওয়ায় ঘরও ছাড়তে হয়েছে।
মেঝেতে শুয়ে মার্কেটের সিলিংয়ের দিকে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকা রেজাউল ছলছল চোখে ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘বাড়ির সবাই জানে আমি ব্যবসা করি, আমার দোকান আছে। অথচ আমার এখন কিছুই নেই। অন্যের উপকারের জন্য নিঃস্বার্থভাবে সহযোগিতা করেছিলাম। অবশ্য তার প্রতিদান পেলাম। ভাগ্য ভালো যে, খোলা আকাশের নিচে শুতে হচ্ছে না। ব্যবসায় মন্দার কথা বলে তিন মাস ধরে বাড়িতে টাকা পাঠাই না। বাড়িতে তিন সন্তান আর স্ত্রী আমার টাকার আশায় বসে আছে। এখন কী করব? বুঝতে পারছি না। দেশে ফেরার তো কোনো প্রশ্নই আসে না।’
আবির মার্কেটের পাশের ভবনেও বাংলাদেশিরা উদ্বাস্তুদের মতো থাকেন। সেখানে হাতেগোনা কয়েকটি সেলুন রয়েছে। এগুলো পরিচালনা করেন পাকিস্তানিরা। সেখানে বাংলাদেশিরা এক বেলায় খাবার খেলে আরেকবেলা অভুক্ত থাকেন। সকালে সেলুন থেকে তাদের নান রুটি-ডাল দিয়ে যান অনেকে। দুপুরে পোলাওয়ের বাক্স দিয়ে যান কেউ কেউ। তাছাড়া তেমন কিছু কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের।
অনিক আখতার নামের আবির মার্কেট অঞ্চলের এক ফল ব্যবসায়ী ঢাকা পোস্ট-কে বলেন, ‘গত সাত বছর ধরে এখানে ফলের মার্কেটে দোকান চালাচ্ছি। পাশের ভবনে যখনই নামাজ পড়তে যাই, তখনই প্রতারণার শিকার এসব বাংলাদেশিদের শুয়ে থাকতে দেখি। বাংলাদেশিরা এ মার্কেটে লাগেজ রেখে সকালে কাজের সন্ধানে বের হন। কাজ পেলে করেন, না পেলে বিকেলে এসে বিশ্রাম নেন। আবার ছুটাছুটি করেন। সন্ধ্যার পর এখানে এখানে অনেক লোকজন দেখা যায়, যাদের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই।’
এআর/আরএইচ/এফআর