ঢাকার উত্তরে এবার ৮ হাট, দক্ষিণে ১০
মুসলিমদের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহার আমেজ আসে কোরবানির পশুর হাট ঘিরে। পরিবারের সদস্যরা মিলে হাটে যাওয়া, দরদাম করে পশু কিনে বাড়ি ফেরা, পথে মানুষের জিজ্ঞাসা ‘দাম কত হলো,’ এসব আলাদা মাত্রা যোগ করে ঈদের আমেজে।
কিন্তু গত দুই বছর করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে রাজধানীর হাটকেন্দ্রিক উৎসবের আমেজে অনেকটা ভাটা পড়েছিল। রাজধানীর সব পশুর হাটে জনসমাগম ছিল নিয়ন্ত্রিত। নির্ধারিত হাটের সংখ্যাও কমিয়ে এনেছিল ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এরই ধারাবাহিকতায় এবারও হাটের সংখ্যা কমানো হয়েছে। পাশাপাশি ডিজিটাল হাটের দিকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া এবার উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায় বসানো হচ্ছে ৮টি অস্থায়ী পশুর হাট। অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বসতে যাচ্ছে ১০টি অস্থায়ী পশুর হাট।
বিজ্ঞাপন
রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যে দুটি স্থায়ী হাট রয়েছে, সেগুলোতে বছর জুড়েই পশু কেনা-বেচা চলে। আসন্ন কোরবানি ঈদ উপলক্ষ্যেও এই দুই হাটে কোরবানির পশু কেনা-বেচা হবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় স্থায়ী হাটটি হলো গাবতলী হাট আর দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতায় স্থায়ী হাট হলো সারুলিয়া স্থায়ী হাট।
এবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৮টি অস্থায়ী হাট বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো ছাড়াও আরও দুটি হাট নতুন করে বসানোর জন্য কাউন্সিলরদের পক্ষ থেকে আবেদন জানানো হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে সিটি করপোরেশন বিষয়টি ভেবে দেখছে। পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে ডিএনসিসি এলাকায় আরও দুটি হাট নতুন করে বসতে পারে।
ডিজিটাল হাটকে গুরুত্ব
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন মিলিয়ে গত বছর মোট ২৩টি হাট বসেছিল রাজধানীতে। এ বছর হাটের সংখ্যা কমিয়ে ১৮টিতে আনা হয়েছে। আগামী বছর থেকে এ সংখ্যা আরও কমতে পারে। গত বছর ১০টি হাটের ইজারা দিয়েছিল ডিএনসিসি আর এ বছর তা কমিয়ে ৮টিতে আনা হয়েছে। পাশাপাশি এ বছর অনলাইন বা ডিজিটাল হাটকেও বেশ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
করোনার কারণে ২০২০ সালে প্রথম অনলাইন হাটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়, তবে এর আগেও ব্যক্তি বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো অল্প সংখ্যক পশু অনলাইনে বিক্রির ট্রেন্ড চালু করেছিল। এরপর থেকে বিকাশ ঘটতে থাকে অললাইন হাটের। ২০২০ সালের মতো ২০২১ সালেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুসারে এবং ডিএনসিসির তত্ত্বাবধানে ই-ক্যাব ও বিডিএফ অনলাইন হাট পরিচালনা করেছে।
গতবছর ডিজিটাল হাট প্লাটফর্মে ১ হাজার ৮৪৩টি হাট অনলাইনে যুক্ত হয়। এ বছর এই লক্ষ্যমাত্র আরও বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ডিএনসিসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, গত বছর করোনা সংক্রমণের কারণে ডিজিটাল হাটের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ডিজিটাল হাটের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মাংস কাটা, গরু জবাই ও হোম ডেলিভারি সেবা। গত বছর ডিজিটাল হাট থেকে মোট পশু বিক্রি হয় ৩ লাখ ৮৭ হাজার ৫শ ৭৯টি। এগুলোর মধ্যে গরু ও মহিষ ২ লাখ ৯৬ হাজার ৭ শত ১০টি; যার মোট মূল্য ২ হাজার ৭শ ৩৫ কোটি ১১ লাখ ১৫ হাজার ৬শ ৭৮ টাকা।
গতবারের মতো এবারও ডিজিটাল হাটে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের নিয়ম ঠিক করে দেওয়া হবে। এতে পশু বিক্রির কী কী নিয়ম মানতে হবে, কী কী তথ্য থাকতে হবে তা উল্লেখ করে দেওয়া হবে। এছাড়া গ্রাহককে সময় মতো কোরবানির পশু দিতে না পারলে সেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। পাশাপাশি জেলা প্রশাসকদের অনুমোদিত বিক্রেতারা তাদের পশু বিক্রি করতে পারবে। ক্রেতার আর্থিক নিরাপত্তা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তার সাময়িক স্ক্রো সেবা ব্যবহার করা হবে। এটার মাধ্যমে যিনি গরুটা কিনবেন সেই টাকা তাৎক্ষণিক বিক্রেতা পাবেন না। এটা চলে যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে। যখন ক্রেতা কনফার্ম করবেন গরুটা তিনি পেয়েছেন এবং কোনো অভিযোগ নেই তখনই গরুর বিক্রেতা তার টাকা পাবেন। এই পদ্ধতিটি গতবার থেকে ডিজিটাল হাটে যুক্ত করা হয়েছে।
গত ২৩ জুন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে কোরবানির পশুর চাহিদা নিরূপণ, সরবরাহ ও অবাধ পরিবহন নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেছেন, এবারের ঈদুল আজহায় কোরবানির জন্য অনলাইন থেকে কেনা পশু পছন্দ না হলে টাকা ফেরতের ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া নগদ টাকার বদলে খামারিরা যাতে স্মার্ট পদ্ধতিতে আর্থিক লেনদেন করতে পারেন সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মন্ত্রী বলেন, গত বছর অনলাইনে প্রচুর গবাদিপশু বিক্রি হয়েছিল। এবারও সে ব্যবস্থা চালু থাকছে। এছাড়া ঈদুল আজহা উদযাপন নিরাপদ করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি দেশে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় প্রতিটি কোরবানির হাটে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করতে হবে। হাটগুলোতে হাত ধোয়া ও স্যানিটাইজারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাশাপাশি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে হাট পরিচালিত হবে।
ঢাকা উত্তরে বসবে ৮ টি অস্থায়ী হাট
এ বছর অস্থায়ী ৮টি হাট বসানোর জন্য দরপত্র আহ্বান করে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। এরমধ্যে ৫টি হাটের ইজার ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। বাকি ৩টি হাটের এখনও ইজারা চূড়ান্ত হয়নি। এ মিলিয়ে মোট ৮টি অস্থায়ী হাট বসার কথা রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকায়। তবে এরসঙ্গে কাউন্সিলরদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আরও দুটি হাট বসানোর কথাও ভাবা হচ্ছে।
উত্তর সিটির যে ৮ স্থানে বসবে অস্থায়ী হাট- কাওলা শিয়ালডাঙ্গা, উত্তরা ১৭ নম্বর সেক্টর বৃন্দাবন থেকে উত্তর দিকে বিজিএমইএ এর খালি জায়গা, ভাটারা (সাইদ নগর), বাড্ডা ইস্টার্ন হাউজিং, আফতাবনগর ব্লক ই থেকে এইচ পর্যন্ত এলাকা, মোহাম্মদপুর বছিলার ৪০ ফুট রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গা, ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের ৩০০ ফুট সড়ক সংলগ্ন খালি জায়গা, মিরপুর সেকশন ৬ এর খালি জায়গা এবং ৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাঁচপুরা বেপারিপাড়ার রহমান নগর আবাসিক প্রকল্প এলাকায় অস্থায়ী এই ৮টি হাট বসবে।
এছাড়া মহাখালী টিঅ্যান্ডটি মোড় খেলার মাঠ এবং তেজগাঁও পলিটেকনিক্যাল মাঠসহ আশপাশের খালি জায়গায় পৃথক দুটি হাট বসানোর জন্য আবেদন জানিয়েছেন কাউন্সিলররা।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মাহে আলম বলেন, ইজারা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সর্বোচ্চ দরদাতাকেই হাটের ইজারা দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা দক্ষিণে বসবে ১০ অস্থায়ী হাট
এ বছর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় বসবে ১০টি অস্থায়ী হাট। এছাড়া সারুলিয়া স্থায়ী হাটে বছরের অন্য সময়ও পশু কেনা-বেচা হয়। আসন্ন কোরবানির ঈদেও এই হাটে অন্যান্য সময়ের মতো পশু উঠবে।
দক্ষিণ সিটির যে ১০ স্থানে বসবে অস্থায়ী হাট- খিলগাঁও রেলগেট বাজারের মৈত্রী ক্লাব সংঘ মাঠ, হাজারীবাগ ইনস্টিটিউট অব লেদার টেকনোলজি কলেজ মাঠ, পোস্তগোলা শ্মশানঘাটসহ আশপাশের খালি জায়গা, মেরাদিয়া বাজার সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাব সংলগ্ন খালি জায়গাসহ কমলাপুর স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকা, যাত্রাবাড়ি দনিয়া কলেজ সংলগ্ন আশপাশের এলাকা, ধোলাইখাল ট্রাক টার্মিনাল সংলগ্ন উন্মুক্ত এলাকা, লালবাগ রহমতগঞ্জ ক্লাব সংলগ্ন আশপাশের খালি জায়গা, শ্যামপুর কদমতলী ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন খালি জায়গা এবং আমুলিয়া মডেল টাউনের আশপাশের খালি জায়গায় এবার ডিএসসিসির নির্ধারিত অস্থায়ী হাটগুলো বসবে।
এই হাটগুলোর মধ্যে সবগুলোর ইজারা ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়ে গেছে। যারা হাটগুলো ইজারা পেয়েছেন তারা হাটে বাঁশ, সামিয়ানা, হাসিল প্যান্ডেল, গরু রাখার স্থান নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। বাকি কয়েকদিনের মধ্যেই হাটের সব ধরনের প্রস্তুতির কাজ তারা শেষ করে ফেলবেন বলে জানিয়েছেন।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন অস্থায়ী হাটগুলোর বিষয়ে বলেন, স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সর্বোচ্চ দরদাতাকে হাট ইজারা দিয়েছি আমরা। এ বছর আমাদের ১০টি হাট বসবে, ইজারা প্রক্রিয়া মেনেই সবাইকে হাট নিতে হয়েছে।
অন্যদিকে হাটগুলোতে গিয়ে দেখা গেছে তোরণ, গরু রাখার স্থান, মঞ্চ তৈরির কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে হাট প্রস্তুতের কাজে নিয়োজিত শ্রমিকরা।
স্বাস্থ্যবিধি মেনে কোরবানির পশুর হাট বসানোর নির্দেশ
কোরবানির পশুর বর্জ্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অপসারণ এবং কোরবানির স্থান পরিষ্কার করার জন্য সব সিটি করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে কোরবানির পশুর হাট বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং এ বছরও অনলাইনে পশু ক্রয়-বিক্রয়ের বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে জানানো হয়েছে।
গত ২৬ জুন পশুর হাট ব্যবস্থাপনা, নির্দিষ্ট স্থানে পশু কোরবানি বাস্তবায়ন ও কোরবানির পশুর বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সার্বিক প্রস্তুতি পর্যালোচনার লক্ষ্যে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা থেকে এসব নির্দেশ দেওয়া হয়।
সভায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম বলেন, পশুরহাট, বাজার ব্যবস্থাপনা, দ্রুততম সময়ে কোরবানির বর্জ্য অপসারণের জন্য জনপ্রতিনিধিদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও জনসাধারণকে পাশে দাঁড়াতে হবে। সড়ক-মহাসড়কের পাশে যেখানে যান চলাচল বিঘ্ন হতে পারে সেখানে কোনোভাবেই পশুর হাট বসানো যাবে না। এ নির্দেশ অমান্যকারীর বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কোরবানির জন্য ১ কোটি ২১ লাখ পশু প্রস্তুত
গত ২৩ জুন কোরবানির হাটের বিষয়ে ফার্মগেটে প্রাণি সম্পদ অধিদপ্তরে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কোরবানির পশুর চহিদা, সরবরাহসহ সার্বিক বিষয়ে পর্যালোচনা হয়। সেখানে জানানো হয়, এ বছর কোরবানির জন্য গরু, ছাগল, ভেড়া, উট মিলিয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ২ হাজার ৩৮৯টি পশু প্রস্তুত করা হয়েছে। এছাড়া গতবারের মতো বেসরকারি উদ্যোক্তার পাশাপাশি সরকারিভাবে অনলাইন হাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত বছরের কোরবানিযোগ্য পশুর সংখ্যা ছিল ১ কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার ৭৬৫টি। এর মধ্যে কোরবানি হয় ৯০ লাখ ৯৩ হাজার ২৪২টি পশু। প্রায় ২৮ লাখ গবাদি পশু সেবার বিক্রি হয়নি।
এএসএস/এনএফ