অপেক্ষা এবার ট্রেনে পদ্মা পাড়ির, স্বপ্ন পূরণ আগামী বছরই
পদ্মা সেতুর মূল দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। আর দুপ্রান্তে ভায়াডাক্ট নামে পরিচিত মাটি থেকে মূল সেতুর সংযোগ পর্যন্ত উড়াল সেতুর দৈর্ঘ্য মোট ৩.৬৮ কিলোমিটার। সবমিলিয়ে পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.৮৩ কিলোমিটার। এরইমধ্যে ভায়াডাক্টের প্রায় ৩.৬৮ কিলোমিটারের ওপর রেল লাইন স্থাপনের কাজ শেষ, প্রায় শেষ হয়েছে স্ল্যাবের ঢালাইয়ের কাজও। শুধু বাদ রয়েছে মূল সেতুতে রেললাইন বসানো ও স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ। এই হিসাবে পদ্মা সেতু অংশে রেলের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ।
সম্প্রতি পদ্মা সেতুর জাজিরা এলাকা ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে। সেখানে কাজ করছিলেন এমন শ্রমিকরা বলছেন, আমরা এখন দুই রেল লাইনের মাঝে যে স্ল্যাব আছে সেটির ঢালাইয়ের কাজ করছি। কাজটি ৪৭ নম্বর পিলার পর্যন্ত শেষ হয়েছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা এই কাজ চলছে।
বিজ্ঞাপন
পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের কাজে নিয়োজিত ফোরম্যান আশরাফ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এখন রেললাইনের স্লিপারের মাঝে স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ করছি। এর আগে এই প্রান্তে প্রায় আড়াই কিলোমিটারের কাজ শেষ করেছি। এখন নদীর পাড় পর্যন্ত এক কিলোমিটারে স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ বাকি আছে, সেটাই করছি। মাওয়া প্রান্তে আমাদের আরেক দল কর্মীরা কাজ করছে। বর্তমানে শুধু নদীর উপরের অংশটুকুরই ঢালাই হয়নি। এই অংশের কাজের অনুমতি এখনও মিলেনি। অনুমতি মিললে কাজ শেষ করতে ৪-৫ মাস সময় লাগবে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রকল্পের কাজ শুধু সেতুর ওপরে নয়, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল লাইনের কাজ চলমান রয়েছে। এই অংশের কোথাও মাটি ভরাট, কোথাও সেতু, কালর্ভাট নির্মাণ এবং রেললাইন স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ১৭২ কিলোমিটারের মধ্যে ওভারঅল প্রায় ৬০ পার্সেন্ট কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আশা করছে, আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে ফরিদপুর ও রাজবাড়ির দিকে যে রেললাইন আছে, সেখানে রেল লাইন সংযোগ তৈরি হয়ে যাবে এবং সরকার চাইলে তখন রেল চলাচল করতে পারবে।
প্রকল্পের কাজ শুধু সেতুর ওপরে নয়, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল লাইনের কাজ চলমান রয়েছে। এই অংশের কোথাও মাটি ভরাট, কোথাও সেতু, কালর্ভাট নির্মাণ এবং রেললাইন স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে
এদিকে কিছুদিন আগে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ কাজের অগ্রগতি দেখতে যান রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। সেদিন তিনি জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর সেতু কর্তৃপক্ষ রেলের অংশ বুঝিয়ে দেবে। সেটি বুঝিয়ে দিলেই জুলাই মাস থেকে পদ্মা সেতুতে রেললাইন বসানোর কাজ শুরু হবে। পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ হবে। যা ঢাকার থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত যুক্ত হবে। যার ফলে আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলবে।
জানা গেছে, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ৮২ কিলোমিটার রেল লাইনটি ২ ভাগে ভাগ করে দ্রুতগতিতে কাজ চলছে। এরমধ্যে ঢাকা থেকে মাওয়া অংশের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৫৫ শতাংশ এবং মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশের কাজ শেষ হয়েছে প্রায় ৭৮ শতাংশ।
নতুন এই যাত্রাপথে রেলের ভাড়া যেমন হবে
১৭২ কিলোমিটারের এ যাত্রাপথে যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি কোনো ভাড়া নেওয়া হবে না বলে জানিয়েছে পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। কর্তৃপক্ষ বলছে, রেলের ট্রাফিক বিভাগে কোচের প্রতিটি ক্লাসের জন্য প্রতি কিলোমিটারে (শোভন, শোভন চেয়ার, এসি চেয়ার ইত্যাদি) যে ভাড়া নির্ধারণ করা আছে, সেটাই কার্যকর হবে। রেলের যাত্রীদের কাছ থেকে টোলও নেওয়া হবে না।
পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক আফজাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, ট্রেনের ভাড়া ট্রাফিক বিভাগ নির্ধারণ করে। তবে পদ্মা সেতুর জন্য স্পেশালি কোনো রেট হবে না এবং পদ্মা সেতুতে রেলযাত্রীদের সরাসরি টোল ফি দিতে হবে না। যেহেতু এটি সরকারের প্রতিষ্ঠান, তাই সরকার এখানে ভর্তুকি দিতে পারে। আমরা সব সময় চাই সড়কের চেয়ে রেলের ভাড়া একটু কম হোক, যেন যাত্রীরা স্বাচ্ছন্দ্যে যাতায়াত করতে পারে। হয়তো ভর্তুকির পর সামান্য কিছু টোলের অংশ যাত্রীদের টিকিটে যুক্ত হতে পারে।
আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের জুন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে ফরিদপুর ও রাজবাড়ির দিকে যে রেললাইন আছে, সেখানে রেল লাইন সংযোগ তৈরি হয়ে যাবে এবং সরকার চাইলে তখন রেল চলাচল করতে পারবে
রেলের বগি ও কোচ আসছে রোমানিয়া-জার্মানি থেকে
প্রকল্প পরিচালক জানিয়েছেন, আমাদের যখন চুক্তি হয় তখনই কোথা থেকে কোন মালামাল আসবে তা ঠিক হয়ে যায়। এই প্রকল্পে ১০০টি রেলের নতুন কোচ কেনার কথা বলা হয়েছে। রেলের ফিনিশড বডি আসবে চীন থেকে। কিন্তু কোচগুলোর কিছু কিছু কম্পোনেন্ট আসবে ইউরোপ থেকে। ইউরোপ থেকে প্রথমে আসবে চীনে। সেখান থেকে ফিনিশড হয়ে বডি আসবে বাংলাদেশে। কোচের বগি আসবে জার্মানি থেকে। এছাড়া হুইল, এয়ার ব্রেক, জেনারেটর এবং বগির ফিটিংসগুলো আসবে জার্মানি ও রোমানিয়া থেকে।
তিনি আরও জানান, কোচগুলো চায়না থেকে এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশে আসবে। এরপর আমাদের দেশে কিছু কাজ থাকবে। বগি ও বডি চীন থেকে আনার পর আমাদের দেশে সংযোজন করা হবে। তারপর সেগুলো ট্রায়াল রান করানো হবে। এসব কাজ করতে আমাদের ২-৩ মাস সময় লাগবে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কবে নাগাদ পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে ট্রেন চালাতে পারবে— এমন প্রশ্নের উত্তরে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমাদের প্রথম টার্গেট ছিল মাওয়া থেকে ভাঙ্গা অংশটা এ বছর ডিসেম্বরের মধ্যে চালু করা। যেহেতু ব্রিজের উপর আমরা এখনও কাজ করতে পারিনি সেজন্য আমরা এটা পারছি না। আমরা একবারে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত লাইনে ট্রেন চালাব। সরকার চাইলে আগামী ২০২৩ সালের জুন মাসে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন চালাতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘জুলাই মাসের মাঝামাঝিতে সেতু কর্তৃপক্ষ সেতুতে রেলের কাজ করার জন্য আমাদের কাছে হ্যান্ডওভার করবে। আমরা চেষ্টা করব জুলাইয়ের শেষ দিকেই কাজ শুরু করার। যদি না হয়, তবে আগস্টের শুরুতে অবশ্যই আমরা কাজ শুরু করব।’
/এমএইচএন/এআর/জেএস/এসএসএইচ