জীবিকায় পড়বে টান, তবুও খুশি তারা
বছর তিনেক আগে পরিবারের জোয়াল কাঁধে নিতে বাড়ি থেকে বের হন মোহাম্মদ সবুজ। চাচার হাত ধরে আসেন বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাটে। শুরু করেন হকারি। জীবিকার তাগিদে কখনও শসা-গাজর, কখনও আমড়া, আবার কখনও কাঁচা আম কিংবা বাদাম বিক্রি করতে হয় তাকে। শ্রম দিয়ে চার সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ চালানো সবুজ এখন তিন কর্মচারীর মালিক। ঘাট ঘিরে তার কারণে চার সংসারের চাকা ঘুরছে; সেই মানুষটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলে চলে যাবেন বাড়ি।
বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাটে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা হয় সবুজের। বলেন, তিন বছর ধরে এ ঘাটে আছি। হকারি করে পরিবার চালাই। এখন তিন কর্মচারীর মহাজন আমি। তাদের বেতন দিই। আমারও সংসার চলে। ব্রিজ (পদ্মা সেতু) চালু হলে বাড়ি চলে যাব। কর্মচারীরাও চলে যাবে। বরিশাল গিয়ে নিজের কেনা অটো চালাব। তবে, এখান থেকে চলে যেতে অনেক খারাপ লাগবে।
বিজ্ঞাপন
পদ্মা সেতু চালু হলে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে গাড়িতে চড়ে মাত্র ছয় থেকে আট মিনিটে পৌঁছানো যাবে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে। এতে গুরুত্ব হারাবে পদ্মা পাড়ের ঘাট দুটি। বাংলাবাজারের পাশাপাশি শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত তখন হয়ে উঠবে সুনসান
কেন— জানতে চাইলে সবুজ বলেন, ‘ঘাটের জন্য একটা মায়া জন্মায়ছে। তিন বছর হলো এখানে আইছি। এখানে থাকার খুব ইচ্ছা হয়, কিন্তু সেটা চাইলেও আর সম্ভব না। চইলা গেলেও পরাণটা এখানে রইয়া যাব।’
প্রায় দুই যুগ আগে বাংলাবাজার-শিমুলিয়া ঘাটে হকারি শুরু করেন কুষ্টিয়ার লিয়াকত আলী। বাদাম বিক্রি দিয়ে শুরু। গত পাঁচ বছর ধরে মালাই বিক্রি করছেন। দুই যুগের বন্ধন ছেড়ে তিনিও অন্যত্র চলে যাবেন। ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে সবাই খুশি হবে। আমিও খুশি। কিন্তু সেতু চালু হলে ঘাট থাকবে, আমাদের কাজ থাকবে না। হয়তো এখানে আরও কিছুদিন থাকব, এরপর অন্য জায়গায় গিয়ে হকারি করব। এ ঘাটে যে মায়া, সেটা কোথাও গিয়ে পাব?
সবুজ-লিয়াকতের মতো ঘাটঘিরে যাদের সংসারের চাকা ঘুরছে, স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুই প্রান্ত যুক্ত হওয়ায় পর তাদের কপালে যেন চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। বিশেষ করে মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের হকারদের জীবিকা নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে।
আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর (২৫ জুন সকাল ১০টা) স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হচ্ছে। সেতু চালু হলে মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে গাড়িতে চড়ে মাত্র ছয় থেকে আট মিনিটে পৌঁছানো যাবে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে। এতে গুরুত্ব হারাবে পদ্মা পাড়ের ঘাট দুটি। বাংলাবাজারের পাশাপাশি শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্ত তখন হয়ে উঠবে সুনসান।
অর্থাৎ সেতু চালু হলে এ পথে সচরাচর মানুষের পা পড়বে না। হকারদের জমজমাট বিকিকিনিও থাকবে না। এছাড়া পদ্মা সেতুর নিরাপত্তায় বাংলাবাজার ঘাট স্থানান্তরেরও সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। এটি শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরকান্দি ঘাটে নেওয়ার কথা রয়েছে।
সেতু চালু হলে কোথায় যাবেন, তারা কি অন্য পেশা বেছে নেবেন— এমন দুশ্চিন্তার মধ্যেও অন্য সবার মতো খুশির আভা খেলে যাচ্ছে হকারদের চোখে-মুখে। ‘একটু তো চিন্তা হবেই, সংসারও চালাতে হবে। এখানে কুলাইতে (না চললে) না পারলে এলাকায় চলে যাব। সেখানে হকারি করব’— বলেন কুষ্টিয়ার লিয়াকত আলী।
মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের হকার ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাবাজার ও জাজিরা ঘাটে দুইশ’র কাছাকাছি হকার রয়েছেন। লঞ্চ, ফেরি বা স্পিডবোট ব্যবহারকারী যাত্রী তাদের ক্রেতা। লঞ্চ বা ফেরিতে ঘুরে ঘুরে তারা শসা, গাজর, বাদাম, কাঁচা আম, মালাই, আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, শিঙাড়া, নারিকেল-চিড়া, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার বিক্রি করেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা, কেউবা রাত অবধি ঘাট এলাকা ঘুরে খাবারসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রি করে সংসার চালান।
হকারদের ভাষ্য, বাংলাবাজার ও জাজিরা ঘাটে বর্তমানে ৮৭টি লঞ্চ, দেড় শতাধিক স্পিডবোট ও ৫৭টি ফেরি চলাচল করছে। প্রতিদিন সেবা নিচ্ছেন হাজার হাজার যাত্রী। ঘাট বন্ধ হয়ে গেলে এসব যাত্রীর পা পড়বে না এ রুটে। ফলে হকারদের আর গুরুত্ব থাকবে না।
রানীগাঁও এলাকার বাসিন্দা আব্দুর সত্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, সেতু চালু নিয়ে এপাড়-ওপাড়ের সবাই খুশি। আমরাও চাই সেতু চালু হোক। মানুষের ভোগান্তি কম হোক। হয়তো কিছু লোক বেকার হয়ে পড়বে। জীবিকা নির্বাহ কষ্টকর হয়ে পড়বে। তারপরও সবার ভালো চাওয়াই আমাদের কাম্য।
বাংলাবাজার ও জাজিরা ঘাটে দুইশ’র কাছাকাছি হকার রয়েছেন। লঞ্চ, ফেরি বা স্পিডবোট ব্যবহারকারী যাত্রী তাদের ক্রেতা। লঞ্চ বা ফেরিতে ঘুরে ঘুরে তারা শসা, গাজর, বাদাম, কাঁচা আম, মালাই, আইসক্রিম, ঝালমুড়ি, ছোলা, সেদ্ধ ডিম, শিঙাড়া, নারিকেল-চিড়া, দইসহ নানা রকম মুখরোচক খাবার বিক্রি করেন। সেতু চালু হলে তারা বেকার হয়ে পড়বেন
‘আমাদের এখানে কিছু হকার আছে, শুনছি তারা ঢাকায় চলে যাবে। আবার অনেকে নিজ নিজ এলাকায় দোকান নিয়ে বসবে। বিকল্প একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে, আশা করি কেউ বসে থাকবে না’— বলেন তিনি। কাজ হারালেও পদ্মা সেতু চালু নিয়ে প্রচণ্ড উচ্ছ্বসিত গোপালগঞ্জের বাসিন্দা মো. রুবেল শেখ। ১০ বছর ধরে স্থানীয় এক খাবারের হোটেলে কাজের পাশাপাশি বাংলাবাজার ঘাটে হকারিও করেন তিনি। বলেন, ‘ভাই, ভাবতেই আনন্দ হচ্ছে। সেতু চালু হবে, এক টানে ঢাকা চলে যাব। আবার ঢাকা থেকে খুবই অল্প সময়ে বাড়ি পৌঁছে যাব। ঘাটে এসে কারও আর বসে থাকা লাগবে না। আমরা যারা ঘাটে হকারি করি তারা অন্যকিছু করে খেতে পারব। আমিও অন্য কাজ খুঁজে নেব। গ্রামে গিয়া ধান কাটব। শীতকালে লেপ-তোশকের কাজ করব। বিভিন্ন জায়গায় গিয়া কামলা দেব।’
১৭ বছর বয়সী সাগর বলেন, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর আরও ছয় মাস সেতুর আশেপাশে হকারি করব। কারণ, প্রথম প্রথম মানুষ সেতু দেখতে আসবে। ভালো ব্যবসা হবে। পরে অন্য কিছু করব। আল্লাহ যেখানে রিজিক রাখবে সেখানে যাব।
প্রমত্ত পদ্মার জাজিরা প্রান্তে ফেরিতে কথা হয় মুড়িবিক্রেতা মোহাম্মদ জব্বারের সঙ্গে। বলেন, এখনও পেশা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। তবে, ঘাট না থাকলে ঢাকায় গিয়ে হকারি করব।
সেতু বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর মূল পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শুরু হয়। চীনের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি (এমবিইসি) আট বছরের অধিক সময় নিয়ে এটির নির্মাণকাজ শেষ করে। গত ২২ জুন সেতুটি প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সেতুর নির্মাণব্যয় ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা ধরা হলেও ২৭ হাজার ৭৩২ কোটি ৮ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আগামীকাল শনিবার (২৫ জুন) সকালে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করবেন তিনি।
প্রথমে তিনি মাওয়ায় সুধী সমাবেশে অংশ নেবেন। এরপর টোল দিয়ে সেতুতে প্রবেশ করে তিনি উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন করবেন। গাড়িতে সেতু পাড়ি দিয়ে জাজিরা প্রান্তে আরেকটি ফলক উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী। বিকেলে তিনি মাদারীপুরের শিবচরে জনসভায় ভাষণ দেবেন।
এনআই/এমএআর/ওএফ