স্বর্ণের চেয়েও দামি শরীয়তপুরের মাটি
১০ বছর আগে প্রতি বিঘা জমি বিক্রি হতো ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায়, তবু জমি কেনার প্রতি আগ্রহ ছিল না কারও। ২০১৫ সালের পর থেকে মানুষ জমি কিনতে শুরু করে। এ সময় জমির চাহিদা দেখে প্রতি বিঘা জমির মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকায়। পরে জমির চাহিদা বাড়তে থাকে আরও। মাত্র সাত বছর পর এখন একই জায়গায় প্রতি বিঘা জমির দাম গিয়ে ঠেকেছে প্রায় এক কোটি টাকায়।
জমি-জমার দামের এই আমূল পরিবর্তনের চিত্রটি হলো উন্নয়নের দিক থেকে এক সময় অনেক পিছিয়ে থাকা অবহেলিত জেলা শরীয়তপুরের। বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাণিজ্যের দিক দিয়ে এতদিন পিছিয়ে থাকলেও জেলার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির বিরাট সুযোগ সৃষ্টি করেছে পদ্মা সেতু। আগামী ২৫ জুন স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উদ্বোধন। শরীয়তপুরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দুয়ার খুলে দিচ্ছে এই সেতু।
বিজ্ঞাপন
শরীয়তপুর অংশে সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্টের আশপাশে গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা, গার্মেন্টস, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে হবে বিশ্বমানের রিসোর্ট, হোটেল, মোটেলসহ বিলাসবহুল নানা প্রতিষ্ঠান। দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব এলাকায় বিনিয়োগ করছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন বুনছেন এখানে। বিভিন্ন শিল্প-কারখানার অবকাঠামোয় সমৃদ্ধ হবে এ এলাকা। এসব কারণে দীর্ঘদিনের অবহেলিত জনপদ শরীয়তপুর এখন মূল্যবান হয়ে উঠছে অনেকের কাছে। ফলে এখানে জমি কেনার ধুম পড়েছে; দাম বেড়েছে বহু গুণ। শরীয়তপুরের মাটি হয়েছে এখন স্বর্ণ!
সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্টের আশপাশে গড়ে উঠবে শিল্পকারখানা, গার্মেন্টস, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান। সেই সঙ্গে হবে বিশ্বমানের রিসোর্ট, হোটেল, মোটেলসহ বিলাসবহুল নানা প্রতিষ্ঠান। দেশের খ্যাতনামা প্রতিষ্ঠানগুলো এসব এলাকায় বিনিয়োগ করছে। নতুন নতুন উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা স্বপ্ন বুনছেন এখানে।
ইতোমধ্যে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান, উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ীরা জমি কিনে ফেলেছেন এই এলাকায়। আবার অন্য উদ্যোক্তা, প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ীরা এখন নতুন করে নিজেদের শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়তে উপযুক্ত জমি খুঁজছেন হন্যে হয়ে। তবে জমির দাম আরও বাড়বে এমন আশায় জমি বিক্রি করতে রাজি হচ্ছেন না অনেকে! ফলে নতুন করে কেনার জন্য জমি খুঁজে পাচ্ছেন না ক্রেতারা।
সবচেয়ে বেশি জমির চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে জাজিরা উপজেলায়। বিশেষ করে পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং এলাকার আশপাশ দিয়ে জমির চাহিদা অনেক বেশি। আর দাম সবচেয়ে বেড়েছে এক্সপ্রেস ওয়ের দুই পাশের জমির।
জাজিরা এলাকায় কেউ জমি কিনে সীমানা প্রাচীর বসিয়ে রেখেছেন, কেউবা নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন, কেউ কেউ জমি উঁচু করতে বালু দিয়ে ভরাট করাচ্ছেন। শিল্প কারখানা, গার্মেন্টস, আবাসন, হাসপাতাল, হিমাগারসহ নানা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য অনেকে জমি কিনে সীমানা প্রাচীর বসিয়েছেন। প্রতিষ্ঠানের নামে সাইনবোর্ড টাঙানো হয়েছে অনেক জমিতে।
জাজিরা উপজেলার পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে জমি কিনেছেন পোশাক রপ্তানিকারক একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক এবং স্থানীয় উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার। সেখানে তিনি বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবেন।
আগে আশপাশের এলাকায় জমি বিক্রি হয়েছে প্রতি বিঘা ২০/২৫ লাখ টাকায়। কিন্তু এখন জমির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় দাম বেড়ে প্রায় ৭০/৮০ লাখ টাকা হয়েছে। এছাড়া ভালো অবস্থানের জমির দাম প্রায় কোটি টাকা প্রতি বিঘা।
এ বিষয়ে মোবারক আলী সিকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেকে জমি কিনেছেন, আবার অনেকে কেনার জন্য জমি খুঁজছেন। ফলে আগের চেয়ে জমির দাম অনেক বেড়ে গেছে।
অর্থনৈতিক দিক থেকে একটা বড় জোন হতে যাচ্ছে আমাদের এই শরীয়তপুর। স্বপ্নের পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করেই এই এলাকার মানুষের ভাগ্য বদলের দিন শুরু হয়েছে।
জাজিরার আরাচন্ডি এলাকায় একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কিনে সেখানে সীমানা চিহ্নিত করে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন ঢাকার ফরাজি হাসপাতালের মালিক ডা. আনোয়ার ফরাজি ইমন। তার প্রকল্পের সীমানা সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখানে ফরাজি হাসপাতাল হবে, সে কারণে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা দিয়ে প্রস্তাবিত হাসপাতালের মালিক এখানে জমি কিনেছেন। জমির দাম প্রতিদিনই বেড়ে যাচ্ছে। যাদের জমি আছে তারা এখন আর জমি বিক্রি করতে চাচ্ছে না। কারণ, তারা ভাবছে জমির দাম আরও বাড়বে।
ঢাকায় বিভিন্ন ব্যবসা থাকলেও পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট থেকে কিছু দূরে একটি উন্নত মানের রেস্টুরেন্ট নির্মাণ করতে চান সারোয়ার আলম নামের একজন ব্যবসায়ী। তিনি শরীয়তপুর সদরের বাসিন্দা। আলাপকালে সারোয়ার আলম বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এই এলাকা একটি পর্যটন এলাকায় পরিণত হতে যাচ্ছে। অনেক মানুষের আনাগোনা থাকবে এই এলাকায়। তাই আমি একটি ভালো মানের রেস্টুরেন্ট করার পরিকল্পনা নিয়েছি। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এলাকায় কেনার জন্য জমি ফাঁকা পাচ্ছি না।
জাজিরার নাওডোবা ইউনিয়ন এলাকায় প্রস্তাবিত জাজিরা জেনারেল হাসপাতাল লিমিটেড গড়ে তোলার লক্ষ্যে জমি কিনে সাইনবোর্ড টাঙিয়েছেন এ বি এম মোজাম্মেল হক এবং সুলতান আহমেদ নামে দুজন ব্যবসায়ী। তারা এখানে হাসপাতাল গড়ে তুলবেন।
এভাবে পুরো এলাকা জুড়েই বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান, ফ্যাক্টরি, কল কারখানা, গার্মেন্টস, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, আবাসন, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বাড়ি করার জন্য জমি কিনে রেখেছেন অনেকে। এছাড়া অন্যরাও হন্য হয়ে এই এলাকায় জমি খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
আব্দুল ওয়াহাব এই এলাকার একজন স্থায়ী বাসিন্দা। মূলত কৃষি কাজ করেন তিনি। জাজিরার নাওডোবা এলাকায় তার বসত ভিটা। কৃষি জমির পাশাপাশি কিছু উঁচু জমি আছে তার। জাজিরা অংশে পদ্মা সেতুর ল্যান্ডিং পয়েন্ট সংলগ্ন এলাকায় জমির দরদাম বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে।
আব্দুল ওয়াহাব বলেন, আগে আশপাশের এলাকায় জমি বিক্রি হয়েছে প্রতি বিঘা ২০/২৫ লাখ টাকায়। কিন্তু এখন জমির চাহিদা বেশি থাকায় দাম বেড়ে প্রায় ৭০/৮০ লাখ টাকা হয়েছে।
এছাড়া ভালো অবস্থানের জমির দাম প্রায় কোটি টাকা প্রতি বিঘা। আগে যারা জমি বিক্রি করেছে এখন তারা জমির চাহিদা দেখে আফসোস করছে।
তিনি বলেন, মূলত এখানে জমি কিনতে আসছেন ঢাকার লোকেরা। তারা কারখানা, গার্মেন্টস, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য জমি খুঁজছেন। প্রতিদিনই জমি দেখতে মানুষ আসে, জমি কিনতে চায়। কিন্তু এখন আর সহজে জমি পাচ্ছে না তারা। মানুষ এখন কম দামে জমি বিক্রি করতে চায় না। জমির মালিকরা বুঝে গেছে এই জমির দাম আরও বাড়বে। আমার নিজের ভাইয়ের একটি জমি ৮০ লাখ টাকা করে বলেছে,কিন্তু সে দিচ্ছে না।
জাজিরার পূর্ব নাওডোবা ইউনিয়নের নির্বাচনে চেয়ারম্যান প্রার্থী মোসলেম উদ্দিন মাদবরের ছেলে রবিন আহমেদ মাদবর এলাকার জমির দাম বিষয়ে বলেন, জমির দাম অনেক গুণ বেড়েছে এটা ঠিক, কিন্তু এখন জমির মালিকরা খুব জরুরি প্রয়োজন ছাড়া জমি বিক্রি করতে চাচ্ছে না। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষ এই এলাকায় এসে জমি কিনে বাড়ি বানাতে চাচ্ছে।
সার্বিক বিষয় নিয়ে আলাপকালে জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কামরুল হাসান সোহেল ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতুকে কেন্দ্র করে এলাকার মানুষ দারুণ উচ্ছ্বসিত। এখানে স্থাপিত হতে যাচ্ছে বাণিজ্যিক সব শিল্প প্রতিষ্ঠান, কল কারখানা। জমির চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দামও বৃদ্ধি পেয়েছে। সব মিলিয়ে আমূল পরিবর্তন হতে যাচ্ছে এই এলাকার।
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতু শুধু একটি স্ট্রাকচার নয়, এটি একটি স্বপ্নের নাম। এখানে আমরা এগ্রোবেইজড ইকোনমিক জোন করার চেষ্টা করছি। বেসরকারিভাবে নানা শিল্প প্রতিষ্ঠান নির্মাণের লক্ষ্যে জমির চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, দামও বেড়েছে। ফলে অর্থনৈতিক ভাবে এই এলাকার মানুষ প্রচুর লাভবান হচ্ছেন।
এএসএস/এআর/জেএস