পাউবোর প্রধান প্রকৌশলী শহিদুলের সম্পদ কত?
সম্প্রতি পদোন্নতি পেয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হয়েছেন মো. শহিদুল ইসলাম। তার স্ত্রী আক্তিয়ারা বানু পেশায় গৃহিণী। আয়ের প্রধান উৎস পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) প্রকৌশলীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে চাকরি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে এই দম্পতির সম্পদের উৎসে ব্যাপক ঘাপলা পাওয়া গেছে। স্ত্রী আক্তিয়ারা বানু পেশায় গৃহিণী হলেও স্বামীর চেয়ে সম্পদের দিক থেকে এগিয়ে আছেন তিনি। এ বিষয়ে গত ১ মার্চ শহিদুল ইসলামকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
তাদের সম্পদের মধ্যে রয়েছে, রাজধানীর মিরপুরের পশ্চিম কাজিপাড়ায় দুই হাজার বর্গফুটের আয়তনের ৭ তলা বাড়ি, মিরপুরের মনিপুরে ৬ তলা বাড়ি, দক্ষিণ মনিপুরে সোয়া ৫ শতাংশের ওপর একটি বহুতল ভবন। এছাড়া মিরপুরের সেনপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমি, কুষ্টিয়ায় সাড়ে ৩০০ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে তাদের।
বিজ্ঞাপন
দুদক সূত্রে জানা যায়, শহিদুল দম্পতি বরাবরই দানশীল! কারণ রাজধানীর তিনটি বাড়ি কিংবা অন্যান্য জমি ক্রয়সূত্রে মালিক হলেও তা ইতোমধ্যে সন্তানদের দান করে দিয়েছেন তারা।
আয়কর বিবরণীতে কাগজে কলমে আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে রাখলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বড় ধরনের অমিল রয়েছে বলে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছর থেকে অনুসন্ধানে নামে সংস্থাটি। অভিযোগ অনুসন্ধানে নেমে অনুসন্ধান কর্মকর্তা দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক মনিরুল ইসলাম অবৈধ সম্পদের দীর্ঘ তালিকা পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান পর্যায়ে দেশের ৫৭টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান, রাজউক, দুই সিটি কর্পোরেশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, ভূমি অফিস ও সাব-রেজিস্ট্রার অফিসসহ শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শহিদুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও দুই মেয়ের নামে থাকা নথিপত্র তলব করে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা। যার অধিকাংশই এখন দুদকের হাতে পৌঁছেছে। অভিযোগ যাচাই-বাছাই করতে চলতি বছরের ১ মার্চ প্রকৌশলী মো. শহিদুল ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদও করে দুদক। যদিও অবৈধ সম্পদের অভিযোগ দুদকের কাছে অস্বীকার করেছে বলে জানা গেছে।
যেমনটি অস্বীকার করেছেন ঢাকা পোস্টের কাছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যান্ত্রিক সরঞ্জাম বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী হয়েছে মো. শহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, ’অভিযোগটি ভূয়া। দুদকের যখন অভিযোগটা দায়ের করা হয়েছে, তখন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ছিলাম। একটি শ্রেণি, বিশেষ করে এক জুনিয়র কর্মকর্তা আমার পদোন্নতি আটকানোর জন্য মূলত অভিযোগটা দায়ের করে। তবে আল্লাহর রহমতে গত ডিসেম্বরে আমার পদোন্নতি হয়েছে।’
অবৈধ সম্পদের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, ’আমার বাড়ি কিংবা জমি যা কিছু বলছেন তা এনবিআরে দাখিল করা আয়কর রিটার্নে দেখানো আছে। আমার কোনো অবৈধ সম্পদ নেই। সব সম্পদের হিসাব রয়েছে। দুদক কিছু পাবে না।’
অন্যদিকে দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো বক্তব্য না দিয়ে জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।
দুদকের অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে
অনুসন্ধান ও তার আয়কর রিটার্নে দেওয়া তথ্যানুযায়ী শহিদুল ইসলামের নিট সম্পদের পরিমাণ ২ কোটি ২১ লাখ ৬ হাজার ২৫৯ টাকা। তার পারিবারিক ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্যসহ মোট ব্যয় পাওয়া গেছে ১ কোটি ১৯ লাখ ৮৩ হাজার ৯২৩ টাকা। ব্যয় ও সম্পদের পরিমাণ যোগ করলে ৩ কোটি ৪০ লাখ ৯০ হাজার টাকা দাঁড়ায়।
অনুসন্ধানকালে তার গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ২ কোটি ৬৪ লাখ ৪৯ হাজার ৬৩৮ টাকা। অর্থ্যাৎ ৭৬ লাখ ৪০ হাজার ৫৪ টাকার সম্পদ বেশি পাওয়া যায়। যার প্রকৃত আয়ের উৎস বৈধ নয় বলে সন্দেহ দুদকের।
অন্যদিকে প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর নামে পাওয়া নিট সম্পদের পরিমাণ পাওয়া যায় ৩ কোটি ৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। পারিবারিক ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও অন্যান্য ব্যয় পাওয়া যায় ৪ কোটি ৫২ লাখ ৮৫ হাজার ২৪১ টাকা। সব মিলিয়ে মোট ৭ কোটি ৫৯ লাখ ৮৪ হাজার টাকার সম্পদ ও অর্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। অথচ দুদকের অনুসন্ধানে গ্রহণযোগ্য আয় পাওয়া যায় ৫ কোটি ৫৬ লাখ ৬৭ হাজার টাকার। এখানে সন্দেহজনক আয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৩ লাখ ১৬ হাজার টাকার বেশি। একজন গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তার এত সম্পদের উৎস কী সেটা বড় প্রশ্ন?
প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রীর আয়কর নথিতে যা রয়েছে
প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী দুজনেই খুলনার ভেড়ামারা সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেন। প্রকৌশলী শহিদুল ইসলামের ২০১৯-২০২০ সালের আয়কর নথি অনুযায়ী বছরে তার মোট আয়ের পরিমাণ ১৭ লাখ ৫৯ লাখ ৮২৮ টাকা। এর মধ্যে গৃহসম্পত্তি থেকে আয় দেখিয়েছেন ৮ লাখ ৩৭ হাজার টাকা। যার বিপরীতে তিনি কর দিয়েছেন ২ লাখ ২৫ হাজার ৩২৭ টাকা। সম্পদের বর্ণনায় মিরপুরে সাত তলা বাড়ি অর্ধেকাংশ, মিরপুরে সেনপাড়ায় তিনভাগে প্রায় ২০ শতাংশ জমিসহ টিনশেট বাড়ি ও কুষ্টিয়ায় কৃষিজমিসহ মোট ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৯৬৫ টাকা মূল্যের সম্পদ। এছাড়া স্ত্রী কাছে লোন ও ব্যাংক ঋণের কথা উল্লেখ করেছেন আয়কর রিটার্নে।
অন্যদিকে তার স্ত্রীর ২০১৯-২০২০ সালের আয়কর বিবরণী অনুসারে গৃহ-সম্পত্তি, কৃষি ও ব্যবসা থেকে আয় দেখিয়েছেন বছরে সাড়ে ১৫ লাখ টাকা। যার বিপরীতে প্রদেয় কর ১ লাখ ৮৬ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। সম্পদের মধ্যে রয়েছে মিরপুরর কাজিপাড়ায় ৪ কাঠা জমিসহ ৬ তলা ভবন, মিরপুরে সাত তলা বাড়ি অর্ধেকাংশ, ১০ বিঘা কৃষি জমি ও ৮০ ভরি স্বর্ণালংকারসহ মোট ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার টাকার সম্পদের বর্ণনা দিয়েছে আয়কর রিটার্নে।
প্রকৌশলী শহিদুল দম্পতির যত সম্পদ
দুদক ও এনবিআর সূত্রে দেখা গেছে, প্রকৌশলী শহিদুল ও তার স্ত্রীর যৌথ মালিকানায় মিরপুরের দক্ষিণ মনিপুরে সোয়া পাঁচ শতাংশ জমি ও বহুতল ভবন এবং মিরপুর ৫৩৫/১ এ যৌথ নামে ৭ তলা বাড়ি (প্রতি তলা ১৯৫০ বর্গফুট) মালিকানা রয়েছে। যদিও সম্পদের দায় এড়াতে ২০২০ সালে তা কন্যাদের নামে দান করে দিয়েছেন তারা। অন্যদিকে প্রকৌশলী শহিদুলের নামে মিরপুরের সেনপাড়ায় ১৫ শতাংশ জমির মালিকানা রয়েছে। যা তিনি ২০০৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে ক্রয়সূত্রে মালিক হয়েছে।
এছাড়া স্ত্রী মিসেস আক্তিয়ারা বানুর নামে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ওয়ার্ড নম্বর ১৪ এর আওতাধীন মিরপুরের পশ্চিম কাজীপাড়ায় সেনপাড়ায় ৬ তলা ভবনসহ ৬.৬০ জমি (বাড়ি নং ৮২৭/২/৫) ছিল। যার প্রতিটি ফ্লোর আড়াই হাজার বর্গফুটের। ওই ভবনও ২০১৯ সালে তাদের দুই মেয়েকে দান করেন। প্রকৃতপক্ষে শহিদুল ইসলাম ও তার স্ত্রী আক্তিয়ারা বানুর অর্জিত সম্পদ মেয়েদের নামে দান করেছেন। এছাড়া আক্তিয়ারা বানুর নামে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় ক্রয় সূত্রে প্রায় সাড়ে ৩০০ শতাংশ জমি মালিকানার অস্ত্বিত্ব পাওয়া গেছে অনুসন্ধানে।
এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে দুদকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনুসন্ধানকালে দেখা গেছে প্রকৌশলী শহিদুল ইসলাম বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে ৭৬ লাখ ৪০ হাজার টাকার উৎস বহির্ভূত সম্পদের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো তার স্ত্রী গৃহিণী হয়েও স্বামীর চেয়ে বেশি সম্পদের মালিক। আমাদের কাছে ২ কোটি টাকার বেশি সন্দেহজনক স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য রয়েছে। এছাড়া আরও অনেক সম্পদের খোঁজ মিলেছে যা যাচাই-বাছাই চলছে।
তিনি আরও বলেন, আক্তিয়ারা বানু তার পৈত্রিক সম্পত্তি এবং পিতার কোম্পানি থেকে প্রাপ্ত অর্থ, গৃহসম্পত্তির ও জমি বিক্রয় হতে আয় এবং বিভিন্ন ব্যাংক হতে গৃহীত ঋণ ছাড়া তার নিজস্ব কোনো আয়ের উৎস নেই। স্বামী পানি উন্নয়ন বোর্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করার সুবাদে বিভিন্ন দুর্নীতিমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উপার্জিত আয়ে সম্পদ গড়েছেন বলে প্রাথমিক প্রমাণ মিলেছে। অনুসন্ধানে হয়ত ভবিষ্যতে আরও অঢেল সম্পদের খোঁজ পাওয়া যাবে।
আরএম/এসএম