বাঁচবে সময়, বাড়বে কর্মসংস্থান; দক্ষিণে পালাবদলের সুর
পদ্মা সেতু কেবল একটি নাম নয়, এটি একটি স্বপ্ন। যে স্বপ্ন এখন বাস্তব। কাঙ্ক্ষিত এ সেতুর মাধ্যমে একদিকে যেমন দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানীর সরাসরি যোগসূত্র তৈরি হবে, ঠিক তেমনি এই সেতু ঘিরে ওই অঞ্চলে নতুন নতুন শিল্পকারখানা গড়ে উঠবে। সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে। রাজধানীতে যাতায়াতে সময় লাগবে আগের তুলনায় অর্ধেক।
বলা হচ্ছে পদ্মা সেতু চালু হলে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দুঃখ ঘুচবে, সেই সাথে পাল্টে যাবে তাদের অর্থনৈতিক জীবন। আসলে কী হবে, কতটা পাল্টাবে পদ্মার ওপারের জীবনচিত্র? এ নিয়ে কী ভাবছেন ওইসব অঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষ, কী ভাবছেন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা? সম্প্রতি এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে দক্ষিণের নানা শ্রেণি পেশার মানুষ আর স্থানীয় পরিষদের সঙ্গে কথা বলে ঢাকা পোস্ট।
বিজ্ঞাপন
পচবে না আম, ‘ট্রিপ’ মারা যাবে বেশি
সেতুর জাজিরা প্রান্তে কথা হয় শরীয়তপুরের গাড়ী চালক মেহেদি হাসান রিপনের সঙ্গে। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ‘৩০ বছর ধরে অনেক কষ্টে নদী পার হইতেছি। ঘাট পার হতেই জীবনটা শেষ হইয়া যায়। শুনতেছি ২৫ তারিখে প্রধানমন্ত্রী সেতু খুলে দিবে, এখন তাইলে আর আমাগো কষ্ট থাকব না।’
সাতক্ষীরা থেকে আম নিয়ে ঘাটে এসে বসে আছেন মোহাম্মদ হোসেন। ঢাকা পোস্ট কে তিনি বলেন, ‘আমি রাত তিনটার সময় এসেছি, এখন বাজে দুপুর ১২টা। কখন যে ঘাট পার হতে পারব তার নিশ্চয়তা নাই। গাড়িতে দেড় লক্ষ টাকার আম আছে, এই আমি সব পচে যেতে পারে! সেতু চালু হলে তখন আর এই টেনশন থাকবে না।’
ঘাটে বসে থাকা রেন্ট এ কারের চালক শাহিন আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমার গাড়িতে একজন যাত্রী আছেন, তিনি বিদেশে যাবেন। 8 ঘণ্টা ফেরি ঘাটে বসে আছি, এখনো ফেরিতে উঠতে পারিনি। ঘাটে বসে থাকলে আমাদের সব দিকে লস হয়, নিজের শরীরের অনেক ক্ষতি হয়।’
তিনি বলেন, সেতু চালু হলে আমরা দিনে বেশি ট্রিপ মারতে পারব। এতে আয়-রোজগার বাড়বে। ফেরির কারণে যে ক্ষতি হতো তা আর হবে না।
টেকেরহাট থেকে আসা মাইক্রোবাসের চালক লুৎফর রহমান বলেন, সকাল ১১টায় এসেছি, এখন রাত ৯টা বাজে। এত ঘণ্টা ধরে ঘাটে বসে থেকেও নদী পার হতে পারিনি।
তিনি বলেন, সেতু হলে আমাদের টেকেরহাট থেকে ঢাকা যেতে আড়াই থেকে ৩ ঘণ্টা সময় লাগবে। যেখানে এখন ঘাটেই বসে থাকতে হয় ১৩-১৪ ঘণ্টা।
সকালে ঢাকা, বিকেলে শরীয়তপুর!
ফেরি পাওয়ার অপেক্ষায় অনেকক্ষণ বসে আছেন বেসরকারি চাকরিজীবী শহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, আমাদের বাড়ি শরীয়তপুর। ছুটিতে বাড়ি এসেছিলাম, এখন ঢাকায় যাব। আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা ঘাটেই বসে আছি।
পদ্মা সেতু চালু হলে বাড়ি থেকেই চাকরি করতে পারব। দেড় থেকে দুই ঘণ্টা লাগবে ঢাকা যেতে। সকাল-বিকাল যাওয়া-আসা করা যাবে- বলেন শহিদুল।
শরীয়তপুরের কাজির হাট থেকে ট্রাকে করে ছাগল নিয়ে ঢাকায় যাচ্ছেন মোহাম্মদ আলী। ঢাকা পোস্টকে তিনি বলেন, ছাগল নিয়ে আমরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে আছি। গরমে অনেক সময় ছাগল মারা যায়। সেতু চালু হলে এই দুর্ভোগ আর থাকবে না।
কী বলছেন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিরা-
কলকারখানা হবে, বাড়বে কর্মসংস্থান
ফরিদপুর জেলার আলফাডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ কে এম জাহিদুল হাসান জাহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতু দক্ষিণাঞ্চলের সাথে ঢাকা শহরের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করবে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানান। বলেন, আমাদের এখান থেকে ঢাকা যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টার মতো সময় লাগবে। এখন যেখানে সময় লাগে ১০-১২ ঘণ্টা। পদ্মা সেতু চালু হলে এই সমস্যা আর থাকবে না। অনেকেই বাড়ি থেকে গিয়ে ঢাকায় অফিস করবেন।
তিনি বলেন, আমাদের পাশের জেলা গোপালগঞ্জ। সেখানে কলকারখানা ও ইপিজেড হবে। আমাদের এখানকার লোকজনের কর্মসংস্থান হবে। তারা বাড়ি থেকে গিয়েই কারখানায় কাজ করতে পারবে। এতে আমাদের অঞ্চলের মানুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবে।
ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান এস এম হাবিবুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হলেও দক্ষিণের মানুষ এতদিন অবহেলিত নিষ্পেষিত ছিল। আগামী ২৫ জুন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতু খুলে দিবেন। আমরা তাকে অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, আপনি ভাঙ্গা এলাকায় আসলে চিনতে পারবেন না, এটা কোন বাংলাদেশ! মনে হবে আপনি কোনো বাহিরের দেশে আছেন।
তিনি আরো বলেন, এখানকার মানুষের ভাগ্যের চাকা ঘুরবে কল-কারখানা এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে উঠবে। অনেক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। এই সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের সরাসরি রাজধানীর সাথে যোগসূত্র তৈরি হবে।
বেড়েছে জমির দাম
মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ মোল্লা ঢাকা পোস্টকে জানান, পদ্মা সেতু চালু হলে কী পরিবর্তন হবে সেটা দেশের সবাই জানে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে এই অঞ্চলের জমির দাম কোথাও কোথাও শতাংশ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। অনেক ব্যবসায়ী এখানে আগে থেকেই জায়গা কিনে রেখেছেন। তারা এখানে কল কারখানা তৈরি করবেন।
তিনি আরো বলেন, এখানে যখন কল কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে তখন এই অঞ্চলের মানুষ সেখানে কাজ করে তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন। জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সোনার বাংলা এগিয়ে যাচ্ছে। আমি তাকে শিবচর উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। তিনি আমাদের জন্য এমন মহৎ একটি কাজ করেছেন।
ভারতে মালামাল যাবে দ্রুত
যশোর জেলার শার্শা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো. সিরাজুল হক মঞ্জু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আপনারা জানেন আমাদের উপজেলাটি ভারতের সীমান্ত ঘেঁষা। বেনাপোল বর্ডার এখানে, সব সময় আমদানি-রপ্তানিতে ব্যস্ত থাকে সবাই। পদ্মা সেতু হওয়ার মাধ্যমে আমাদের উপজেলা আগে থেকে আরও বেশি উন্নত হবে, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে।
তিনি আরো বলেন, ভারত থেকে যেসব মালামাল বাংলাদেশে আসে এবং বাংলাদেশ থেকে যেসব মালামাল ভারতে যায় পদ্মা সেতু না থাকার কারণে তাদের ঘাট পারাপারের জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। সেতু চালু হলে সেই অপেক্ষা আর করতে হবে না। এক্ষেত্রে দেশের আমদানি-রপ্তানি আগের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। আবহাওয়া খারাপ থাকলে, ঝড়-বৃষ্টি হলে ফেরি বন্ধ থাকত। তখন ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের বসে থাকতে হতো। এখন আর সেই চিন্তা করতে হবে না।
গড়ে উঠবে হোটেল-মোটেল, ন্যায্য দাম পাবেন কৃষক
শরীয়তপুর জেলার জাজিরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোবারক আলী সিকদার ঢাকা পোস্টকে জানান, শরীয়তপুর জেলা একটি অবহেলিত জেলা। এখান থেকে ঢাকায় সরাসরি কোনো পরিবহন চলে না। মানুষ লঞ্চে করে, নৌকায় করে, স্টিমারে করে ঢাকায় যেত। আমাদের এখানে কল-কারখানা না থাকায় কর্মসংস্থানেরও অনেক অভাব। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার খবরে শরীয়তপুর বাসী তথা জাজিরাবাসী অনেক আনন্দিত। এখন আমাদের এলাকার জায়গা জমির দাম অনেক বেড়েছে। পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন ব্যবসায়ী এখানে জায়গা কিনেছেন। সেতু চালু হওয়ার পর এখানে কলকারখানা হোটেল-মোটেল গড়ে উঠবে। সেখানে এই অঞ্চলের মানুষ কাজ করলে তাদের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরবে।
তিনি আরও বলেন, এই এলাকায় অনেক শাকসবজি উৎপাদন হয়। যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা না থাকায় এলাকার কৃষকরা ভালো দাম পান না। ফসল উৎপাদন করে তারা একটি হিমাগারে রাখবে, এখানে সে ব্যবস্থাও নেই। আমি নিজ উদ্যোগে একটি হিমাগার করার পরিকল্পনা নিয়েছি। সেখানে তারা তাদের উৎপাদিত সবজি রাখতে পারবেন। ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালু করার ঘোষণা দেওয়ায় জাজিরার মানুষের পক্ষ থেকে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
এসএএ/জেএস