পুরনো ছবি

গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস একটি এমডি পদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধ করিয়েছিলেন বলে অভিযোগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বুধবার (৮ জুন) একাদশ জাতীয় সংসদের অষ্টাদশ অধিবেশনে ‘প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে’ আনীত সাধারণ প্রস্তাব আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ অভিযোগ করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, ভেবেছিলেন আমরা আত্মসমর্পণ করব। একটা কথা মনে রাখবেন, আমি শেখ মুজিবের মেয়ে। অন্যায়ের কাছে মাথানত করি না।

তিনি বলেন, আপনারা জানেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে জাপান সফরে যান। তখন কিন্তু পদ্মা সেতু, যমুনা সেতু সবগুলো নিয়ে আলোচনা হয়। উত্তরবঙ্গে সব সময় দুর্ভিক্ষ লেগে থাকায় ওই সময় বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ওপরই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। যমুনা সেতু তখন জাপান সরকারের প্রচেষ্টায় ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়। সেই সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন। পরবর্তীতে জিয়া ক্ষমতায় এসে সেটি বন্ধ করে দেন। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর উদ্যোগ নেন এবং ভিত্তিপ্রস্তরও স্থাপন করেন। কিন্তু ডিজাইন সবগুলো তখনো সম্পন্ন হয়নি।

তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর এই যমুনা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করি এবং সম্পন্ন করি। তখনো যমুনা সেতুর সঙ্গে কিন্তু রেললাইন ছিল না। বিদ্যুৎ ছিল না, গ্যাস লাইন ছিল না। এগুলো সব করে ওই সেতুটি নির্মাণ করি। তখন ওয়ার্ল্ড ব্যাংক বলেছিল রেল লাইন দিয়ে এই সেতু লাভজনক হবে না। আর আমার কথা ছিল, এটা লাভজনক হবে। এতই লাভজনক হয়েছে যে এখন তারা উল্টো টাকা দিচ্ছে আলাদাভাবে রেল লাইন করতে। এটা হচ্ছে তাদের বিবেচনা।

সরকার প্রধান বলেন, আমি ৯৬ সালে সরকার গঠনের পর যখন জাপানে যাই, তখন তাদের বলেছিলাম যে আমার বাবা এসেছিলেন আপনারা যমুনা সেতু দিয়েছিলেন। আমি পদ্মা সেতু এবং রূপসা সেতু- এই দুইটা চাই। আমি জানি পদ্মা অত্যন্ত খরস্রোতা নদী। এটার ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে অনেক সময় লাগবে। তাই রূপসা আগে করতে বলি। সেটা আমরা করে ফেলেছি। আর পদ্মার ফিজিবিলিটি স্টাডি হয়। পরে তারা যে পয়েন্টটি ঠিক করে, আমরা তখন শুধু একটা রোড ব্রিজ করে প্রকল্প তৈরি করে সেটার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি। ২০০১ সালের ৪ জুলাই ওখানে আমরা ভিত্তিপ্রস্তর দেই।

তিনি বলেন, ২০০১ সালের অক্টোবরে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেই প্রকল্প বাতিল করে দেয়। তারা বলেছে, এখানে হবে না তারা আরিচায় করবে। সেতুর কাজ বন্ধ করে দিল। যাক একদিকে ভালোই, আমরা দ্বিতীয়বার সরকারে আসার পর আবার উদ্যোগ নেই। এর মাঝে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আবার একটা উদ্যোগ নিয়েছিল, যেটা কিছুক্ষণ আগে একজন মাননীয় সংসদ সদস্য বলেছেন। মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু সেই সেতুর সঙ্গে রেল ছিল না, বিদ্যুৎ ছিল না। গ্যাসের লাইনও ছিল না। সেই সেতু মাত্র ৫ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ করেছিল।

পরে আমরা যখন ক্ষমতায় আসলাম ২০০৯ সালে। আমাদের কথা ছিল, এই সেতুটি যখন করব, তখন রেল, সড়ক, তার সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং এমনকি ওয়াইফাই কানেকশন অর্থাৎ ডিজিটাল কানেকশনটাও হবে। এসব কিছু মিলেই কিন্তু আমরা সেতুর প্রকল্প নেই।

পদ্মা সেতু আমাদের আত্মবিশ্বাস তৈরি করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, টেকনোলজি সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান হয়েছে। ভবিষ্যতে আরো উন্নত কাজ করতে পারব। বাংলাদেশ যে নিজেরা পারে এই ধারণাটা সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে।

ড. ইউনূসের সমালোচনা করে শেখ হাসিনা বলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি ড. ইউনূস বেআইনিভাবে ৭১ বছর পর্যন্ত এমডি পদে ছিলেন। তাকে কোনো অপমান করা হয়নি। বরং তাকে ব্যাংকের উপদেষ্টা এমেরিটাস হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাকে এমডি থাকতে হবে।

১৯৯৮ সালের বন্যার সময় গ্রামীণ ব্যাংককে আমরা ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছিলাম। গ্রামীণ ফোনের লাভের টাকা ব্যাংকে যাওয়ার শর্ত ছিল। কিন্তু তিনি তার একটি টাকাও ব্যাংককে দেননি। বরং গ্রামীণ ব্যাংকের যত টাকা, সব নিজে খেয়ে গেছেন। তা নাহলে একজন ব্যাংকের এমডি এত টাকার মালিক হয় কীভাবে? দেশে-বিদেশে এত বিনিয়োগ করে কীভাবে? ক্লিনটন ফাউন্ডেশনে লাখ লাখ ডলার কীভাবে অনুদান দেয়? কার টাকা দিলেন? কীভাবে দিলেন- সেটা তো কেউ খোঁজ নিলো না।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে বলা হলো। আমি, আমার বোন রেহানা, আমার ছেলে কেউ বাদ যায়নি। ড. মসিউর রহমান, আমাদের সচিব মোশাররফ, মন্ত্রী আবুল হোসেন এদের ওপর যে জুলুম তারা করেছে এবং যখন অসত্য অপবাদ দিয়ে যখন পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দিলো, তখন আমরা বললাম আমরা নিজের টাকায় করব। অনেকে বোধহয় ভেবেছিলেন এটা অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমরা করতে পারব। এই আত্মবিশ্বাস আমার ছিল।

সরকার প্রধান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশের পর ইউনূস বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করলেন। কিন্তু প্রত্যেকটি মামলায় হেরে গেলেন। কারণ আইন তো তাকে কাভার দিতে পারে না। আইন তো কারো বয়স কমাতে পারে না। হেরে গিয়ে আরো ক্ষেপে গেলেন। হিলারি ক্লিনটনকে দিয়ে আমাকে ফোন করিয়েছেন। টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী শেরি ব্লেয়ারকে দিয়ে ফোন করিয়েছেন। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টের প্রতিনিধি আসলেন, সবার কথা ইউনূসকে ব্যাংকের এমডি রাখতে হবে।

তিনি বলেন, জাতির কাছে প্রশ্ন করছি ব্যাংকের এমডির পদে কী মধু ছিল যে ওইটুকু উনার না হলে চলতো না। তিনি (ইউনূস) তো নোবেল প্রাইজ পেয়েছেন। নোবেল প্রাইজ যে পায় সে একটি এমডি পদের জন্য এত লালায়িত কেন? সেটা সবার চিন্তা করে দেখা উচিত। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যেন টাকাটা বন্ধ করে সেজন্য বার বার ইমেইল পাঠানো- হিলারির সঙ্গে দেখা করা, তাকে দিয়ে ইমেইল পাঠানো; এবং তার সঙ্গে আমাদের একজন সম্পাদকও ভালোভাবে জড়িত ছিলেন। আমার প্রশ্ন এদের মধ্যে কী কোনো দেশপ্রেম আছে?

শেখ হাসিনা বলেন, এত চাপ। মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি। আমি যখন ডিমান্ড করলাম আমাকে কাগজ দাও। আমি দুর্নীতির এভিডেন্স চাই। একটা ডায়রির কাগজ। পেনসিল দিয়ে লেখা। সেখানে তারিখ নেই, কিছু নেই। কোথায় বসে লিখেছে। এটা নাকি ওয়েস্টিন হোটেলে বসে লেখা। আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আমেরিকানদের জবাব দিয়ে বলেছিলাম- হ্যাঁ আমার সঙ্গে তো হিলারি ক্লিনটন দেখা করতে এসেছিলেন। তিনি বলেছিলেন এই এই কোম্পানিকে কাজ দিন তাহলে এত পারসেন্ট পাবেন। আমার ডায়রিতে লেখা আছে। দেবো বের করে? তখন চুপ হয়ে গেছে। একজন আন্ডার সেক্রেটারি এসে খুব হুমকি ধমকি। অ্যাম্বাসেডর এসে বার বার অফিসারদের হুমকি দিতেন। ইউনূসকে এমডির থেকে বের করলে পদ্মার টাকা বন্ধ করা হবে। একটা এমডির পদের জন্য একটা দেশের এত বড় ক্ষতি!

তিনি বলেন, ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট তার শেষ কর্মদিবসে পদ্মা সেতুর টাকা বন্ধ করে দেন। তারপর তাদের চাপ হলো- অমুককে গ্রেপ্তার করতে হবে, বাদ দিতে হবে। তাহলে আমরা টাকা দেবো। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমার কোনো অফিসারকে এই অপমান করতে দেবো না। মসিউর রহমান ও আবুল হোসেন সাহেবকে গ্রেপ্তার করতে হবে। মোশাররফ সাহেবকে গ্রেপ্তার করায়ই দিল। কিন্তু আমি বললাম এটা করতে দেবো না। কারণ কোনো টাকা ছাড় হয়নি। দুর্নীতিটা হলো কোত্থেকে। আমি তো তাদের কাছে এভিডেন্স চেয়েছি, কিন্তু তারা দিতে পারেনি। একটা কাগজও দিতে পারেনি। তাহলে তাদের এই অপবাদ আমরা নেবো কেন?

একটি মানসিক যন্ত্রণা আমার পরিবারের ওপরে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমার মেয়ে, ছেলে, বোনের ওপর মানসিক চাপ দেওয়া হয়েছে। জয়কে নিয়ে স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলেছে, তোমার মাকে বলো, তা নাহলে তোমার বিরুদ্ধে অডিট হবে। সে বলেছিল হ্যাঁ করো। আমার মাকে এটা বলতে পারব না। আমার বিরুদ্ধে যত এনকোয়ারি আছে করতে পার। আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমার সবকিছু লিগ্যাল। আমি ভয় পাই না। কাকে না তারা চাপ দিয়েছে।

এমন অবস্থাতেও আমি দমে যাইনি। সততা আমার শক্তি। আমার শক্তি বাংলাদেশের জনগণ। জনগণকে অপমান করে কোনো কিছু করব? এটা নয়। এই একটা সিদ্ধান্ত। যখন আমরা সেতু করতে শুরু করলাম, সবার টনক নড়লো। সবাই সমীহ করতে শুরু করল। যে না বাংলাদেশ পারে। এই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, যাবে।

তিনি বলেন, আমরা সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। নিজেদের অর্থায়নে করব বলেছিলাম, সেটা পেরেছি। রেললাইন কেন করলাম সেটা নিয়েও আমাদের অর্থনীতিবিদরা প্রশ্ন তুলেছেন। এই সেতুর দরকারটা কী ছিলো এই কথাটাও কেউ কেউ বললেন। যখন নির্মাণ কাজ শুরু করি অনেক জ্ঞানীগুণী বলেছিলেন- হ্যাঁ আওয়ামী লীগ ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে পারবে, কিন্তু সেতু সম্পন্ন করতে পারবে না। তাদের কেউ কেউ আমাদের সরকারের সঙ্গেও ছিলেন। কত কথা শুনতে হয়েছে। এর একটাই কারণ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ছাড়া কিছু করা যাবে না। তাদের খবরদারি ছাড়া কিছু হবে না। আমাকে এটাই বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে। আমি বলেছি, না। আমি মানি না, আমরা পারব। আর যদি পারি করব। না পারলে করব না।

সরকার প্রধান বলেন, আমি বলেছি যেদিন নিজের টাকায় পারব, সেদিন পদ্মা সেতু করব। কিন্তু আমার দেশকে অপমান করে টাকা নিয়ে করতে হবে! আমাকে ভয় দেখানো হয়েছে যদি এটা না হয়, ইলেকশনের কী হবে। আমার কথা, জনগণ ভোট না দিলে ক্ষমতায় আসব না। ২০০১ সালেও তো আমাকে আসতে দেওয়া হয়নি।

এ সময় পদ্মা সেতু নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান শেখা হাসিনা।

এর আগে প্রস্তাবটি আনায় সরকার দলীয় চিফ হুইপকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেওয়ায় সরকারি দল, বিরোধী দল সহ সকল সংসদ সদস্যকে ধন্যবাদ জানান সংসদ নেতা।

এইউএ/এমএইচএস