পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য সাড়ে তিন বিঘা জমি দিয়েছেন ৭০ বছর বয়সী সুলতান খাঁ। রানীগাঁও বাংলাবাজার-শিমুলিয়া বাজারে কথা হয় তার সঙ্গে। সুলতান খাঁ জানান, মাদারীপুর অংশে পদ্মা সেতুর জন্য তার পুরো পরিবারকে ১৩ বিঘা জমি দিতে হয়েছে। এর জন্য সরকার থেকে ক্ষতিপূরণের অর্থ পেয়েছেন তারা। পুরোনো বসতভিটার জন্য এখনও মন কাঁদে তার। তবে পদ্মা সেতুতে অবদান রাখায় গর্ববোধ করেন তিনি। নিজেকে পদ্মা সেতুর একজন অংশীদার মনে করেন সুলতান।

তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর জন্য আমাদের জায়গা-জমি যা নিয়েছে আমরা খুশি। সরকার যেটা করছে ভালোর জন্য করছে। পদ্মা সেতু হইছে, সবার উন্নতি হইছে; দেশের উপকার হইছে। কারও কারও অল্প খারাপ হইছে। তবে আমাদের ১২ আনা মানুষের ভালো হইছে। জমির জন্য কষ্ট হইলেও আমরা খুশি আছি। গর্ব করে বলি, পদ্মার (সেতু) জন্য আমি জমি দিছি।’
 
শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায় ৫০ বছর বয়সী লাবলু মিদ্রা প্রায় ১০ হাত লম্বা গাছ থেকে হাত দিয়ে আম পাড়ছেন। লাবলু জানান, গত আট বছর থেকে তিনি নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে বসবাস করছেন। পদ্মা সেতুর জন্য দেড় বিঘা জমি দিতে হয়েছে তাকে। বলেন, ‘বাপ-দাদার ভিটে-মাটি ছিল। পুরো পরিবার নিয়ে থাকতাম। সরকার দেড়গুণ টাকা দিছে। এখানে সরকার থেকে দুই শতাংশ কিনে বাড়ি করেছি। তিন সন্তান নিয়ে এখানে বসবাস করছি। পদ্মা সেতু চালু হলে সবার জন্য মঙ্গল হবে।’


 
লাবলুর প্লট পেরিয়ে কয়েক কদম সামনে গিয়ে দেখা যায়, এক বৃদ্ধা ঘরের জানালার পাশে বসে নিজের সঙ্গে বিড়বিড় করে কথা বলছেন। একটু সামনে যেতেই নিজ থেকে পরিচয় জানতে চান। সাংবাদিক পরিচয় দেওয়ার পর জানালেন তার নাম হাজেরা বিবি, স্বামীকে হারিয়েছেন বছর তিনেক আগে। দুই সন্তান নিয়ে নাওডোবা পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকছেন। পদ্মা সেতুর জন্য দুই একর জায়গা ছাড়তে হয়েছে তাদের।
 
হাজেরা বিবি বলেন, বাবারে, আগে তো নিজেদের জায়গায় ছিলাম। স্বামী মারা গেছে। দুই ছেলে কাজে গেছে। সারাদিন একা একা লাগে। আগের জায়গায় এমন লাগত না। পাশে কত লোক ছিল। একেক জন একেক জায়গায় চলে গেছে। বড় ছেলের বউটাও চলে গেছে। সারাদিন একা একা শূন্য ঘরটায় পড়ে থাকি।

পদ্মা সেতুতে জমি দিয়ে অবদান রাখায় খুশি কি না, জানতে চাইলে একগাল হাসি দিয়ে হাজেরা জানান, সবাই খুশি হইলে, আমরাও খুশি।

 
সবকিছু ঠিক থাকলে জুনের ২৫ তারিখ স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেতুর উদ্বোধন করবেন। সেতু চালু হলে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া প্রান্ত থেকে গাড়িতে চড়ে পার হওয়া যাবে শরীয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে। দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে সড়কপথে যুক্ত করবে পদ্মা সেতু। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে এ সেতু।
 
জমির মূল্য দেওয়া হয়েছে দেড় গুণ

পদ্মা সেতু প্রকল্প একনেকে পাস হয় ২০০৭ সালে। নানা জটিলতা পেরিয়ে মূল সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৪ সালের শেষের দিকে। তবে জমি অধিগ্রহণ, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনসহ অনেক কাজ শুরু হয় ২০০৮ সাল থেকে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য এক হাজার ১০০ হেক্টরেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণ (দ্বিতীয় সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পের নিবিড় পরিবীক্ষণ প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারণে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে তিন উপজেলার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১৭ হাজার ৪৯২টি। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ভূমি অধিগ্রহণ আইন ১৯৮২ অনুসারে জেলা প্রশাসক কর্তৃক ক্ষতিপূরণের টাকা অর্থাৎ জমির বাজার মূল্যের দেড় গুণ প্রদান করা হয়েছে।

জমির প্রকৃত মূল্য প্রদান নিশ্চিতকরণের জন্য গঠিত প্রবার্ট অ্যাডভাইজারি কমিটির (পিসিএ) সুপারিশ অনুসারে প্রকল্প থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ২০২০ সালের মে মাস পর্যন্ত ২৮ হাজার ২১২ জনকে ৬৭৮ দশমিক শূন্য ছয় কোটি টাকা প্রদান করা হয়েছে। পরবর্তীতে আরও অর্থ প্রদান করা হয়েছে, যার তথ্য এখনো প্রকাশিত হয়নি।
 
ভিটা উন্নয়ন সহায়তা প্রদান

বসতভিটা বা অবকাঠামো হারিয়েছে এমন ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বিকল্প জায়গায় বসতভিটা নির্মাণে সহায়তা করা হয়েছে। প্রকল্প থেকে ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ৭৯৯টি পরিবারকে ১৭ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা সহায়তা প্রদান করা হয়েছে।
 
৭টি পুনর্বাসন এলাকা, বিনামূল্যে প্লট পান ভূমিহীনরা

পদ্মা সেতু প্রকল্পের কারণে ভূমি হারানো ৫ হাজার ৮৭৭টি পরিবারের জন্য ১৬৫ দশমিক ৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন উপজেলায় ৭টি পুনর্বাসন এলাকা নির্মাণ করা হয়েছে। পুনর্বাসন এলাকায় মোট দুই হাজার ৯২৫টি আবাসিক এবং ১০০টি বাণিজ্যিক প্লট তৈরি করা হয়েছে। ২০২০ সালের মে পর্যন্ত ২ হাজার ৭৯৫টি তিন ধরনের (২.৫ শতক, ৫ শতক এবং ৭.৫০ শতক) প্লট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বরাদ্দকৃত প্লটসমূহের মধ্যে মূল্য প্রদান সাপেক্ষে ২ হাজার ৪৮টি প্লট এবং ভূমিহীন পরিবারসমূহকে বিনামূল্যে ২ দশমিক ৫ শতকের ৭৪৭টি প্লট বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে তিন বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে বসবাস করলেই একজন বরাদ্দ গ্রহীতা ৯৯ বছরের জন্য তার নামে ইজারা দলিল সম্পাদন করতে পারছেন। তবে প্লট রেজিস্ট্রেশনের পর একজন গ্রহীতা ১০ বছরের মধ্যে প্লটের মালিকানা হস্তান্তর করতে পারবেন না। যদি কোনো গ্রহীতা ১০ বছর পর মালিকানা হস্তান্তর করতে চান তাকে সেতু কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিতে হবে।
 
একইসঙ্গে ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন, এটা সারা বিশ্বে একটা উদাহরণ

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান বলেন, পদ্মা সেতুতে সরকার একদিকে যেভাবে ক্ষতিপূরণের টাকা দিয়েছে অন্যদিকে আবার পুনর্বাসনও করেছে। এটা একটা আদর্শ উদাহরণ। শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, সারা বিশ্বের জন্য। যারা যারা প্রাপ্য, তাদের সবাইকে টাকা দেওয়া হয়েছে। একসঙ্গে টাকাও পেয়েছে, আবার পুনর্বাসিতও হয়েছে।

তিনি বলেন, দু-একজন যারা টাকা পাননি, তাদের জমিতে ঝামেলা আছে। কিছু জমি নিয়ে মামলা আছে। এর সংখ্যা খুবই কম, এটা পয়েন্ট শূন্য এক পারসেন্টও (.০১%) হবে না। ঝামেলা মিটে গেলে টাকা দেওয়া হবে।
 
‘জমি গেলেও একটা আনন্দ আছে’

জাজিরা বেড়িবাঁধের পেছনে দিরা নাওডোবা অংশে পদ্মা সেতুর জন্য জমি দিতে হয় ফজল হক মুন্সিকে। তিনি বলেন, বাপ-দাদার অরিজিনাল সম্পত্তি ছিল, ১৫ বিঘা জমি। ২০০৭ সালে বিল পাইছি ১০ লাখ টাকা। এখন ওটার দাম হবে এক কোটি টাকা। সরকার থেকে ৫ শতাংশ জমি কিনে বাড়ি করছি। ৬০ হাজার টাকা করে শতাংশ প্রতি জমা দিছি, মোট ৩ লাখ টাকা।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হচ্ছে, এটা ভালো লাগতেছে। জমি গেলেও একটা আনন্দ আছে। পদ্মা সেতুর জন্যই আমাদের জমিটা গেল।

জাজিরা অংশে পদ্মা সেতুর জন্য জমি দেওয়া ইলিয়াছ শেখ জানান, আগে দুই বিঘা জায়গার মধ্যে বাড়ি ছিল। এখন বাড়ি করছি আড়াই শতাংশের মধ্যে। সরকার থেকে দেড় লাখ টাকা দিয়ে কিনতে হইছে। এর বাইরে সরকার যে ক্ষতিপূরণ দিছে সব বসে বসে খেয়ে দেয়ে শেষ। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর জন্যই তো আমাদের জমি ছাড়া। না হলে তো আমরা জমি ছাড়তাম না। পদ্মা সেতু হইতেছে ভালো। পদ্মা সেতুর কারণে রাস্তা-ঘাট উন্নত হইছে। চলতে ফিরতে শান্তি, ভালো লাগে। কিন্তু অর্থের দিক থেকে খারাপ অবস্থানে আছি। কাম-কাইজ নাই।

সেতুর জন্য ২৭ বিঘা জমি দিতে হয়েছে শরীয়তপুরের বাসিন্দা আব্দুর রউফ খালাশীর পরিবারকে। জমি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু ঝামেলা থাকায় এখনও সরকার থেকে অর্থ বুঝে পাননি তিনি। তবে পদ্মা সেতু চালু হবে, এতে খুশি খালাশী।

জাজিরা ঘাটে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ২৭ বিঘার মতো জমি গেছে। জমি রেকর্ড হয়ে গেছে। মামলা চলতেছে। আইনি প্রক্রিয়া শেষ হলে আশা করছি জমির অর্থ পাব। এখন অন্যের ক্ষেতে কাজ করলে চলতে পারি, না হলে পারি না। সরকার থেকে টাকাটা পেলে কিছু একটা করতে পারব।

পদ্মা সেতু একটা অনুভূতির জায়গা

মাদারীপুরের জেলা প্রশাসক ড. রহিমা খাতুন ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা সেতুর জন্য যাদের জমি দিতে হয়েছে মোটামুটি সবাইকে অর্থ বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি পুনর্বাসনের আওতায় নেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, এটা এমন একটা অনুভূতির জায়গা যেখানে অনেক মানুষের কষ্ট লুকিয়ে আছে। পদ্মা সেতু হওয়ার আগে ফেরি ঘাটে দক্ষিণবঙ্গের মানুষের কত দুঃখ-কষ্ট, কত আহাজারি; কত মানুষের স্মৃতি, কত হয়রানি, রোদের মধ্যে বিশেষ করে ঈদ বা উৎসবের সময়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা- কত মানুষের কষ্ট এখানে লুকায়িত আছে।

জেলা প্রশাসক বলেন, যারা জমি দিয়েছে বা জমি দেয়নি সবাই মিলে চেষ্টা করেছে। কষ্টগুলো যেন দূর হয়ে যায়। প্রধানমন্ত্রী সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন। মানুষ খুব খুশি। যাদের জমি গেছে তারাও খুশি। এটা দেশকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাবে, জিডিপি গ্রোথ থেকে শুরু করে সব দিক বিবেচনায় অনেক ভূমিকা পালন করবে এই সেতু। আমি মনে করি, যারা জমি দিয়েছেন তারা তো সৌভাগ্যবান। কারণ, তাদের জমির ওপর দিয়েই পদ্মা সেতুটা গেছে। তারাও এই গৌরবের অংশীদার। তারা গর্ব করে বলতে পারবেন, ‘আমার জায়গার ওপর দিয়ে পদ্মা সেতু গেছে।’

এনআই/এআর/জেএস