সাধারণের খেরোখাতা
বেতন ছাড়া বেড়েছে সবকিছুই
গত জানুয়ারি মাসে বাসা ভাড়া বেড়েছে ৫০০ টাকা, বাজারে সব পণ্যের যে অবস্থা তাতে অল্প স্বল্প জিনিস কিনতে পারি, শখ হলেও ভালো কিছু কেনার ক্ষমতা নেই, বাজারে এমন কিছু নেই যার দাম বাড়েনি, শুধু বাড়েনি আমাদের বেতন। বেতন ছাড়া আর সবকিছুই বেড়েছে।
কথাগুলো বলছিলেন গুলশানের একটি শপিং সেন্টারের একটি দোকানের কর্মচারী রুবেল আহমেদ। ১৫ হাজার টাকা বেতনে তিনি দোকানটিতে ম্যানেজার হিসেবে চাকরি করছেন কয়েক বছর হলো।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, প্রতিদিনই ক্রেতাদের সঙ্গে নানা জিনিসের দাম নিয়ে দর কষাকষি করতে হয়। সব জিনিসের দাম বেড়েছে এটা বোঝাতে পারি না। আমরাও বাজারে যখন নিত্যপণ্যসহ অন্যান্য জিনিস কিনতে যাই তখন দেখি সব জিনিসেরই দাম বেশি। বাজারের এমন পরিস্থিতি হয়েছে যে সব জিনিসের দামই বাড়তি। মানুষের বেতন ছাড়া বেড়েছে সবকিছুর দামই।
শুধু এই রুবেল আহমেদই নয়, এমন আক্ষেপ অন্যান্য সাধারণ মানুষেরও। তাদের মতে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে তাদের জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো পণ্য নেই যেগুলোর দাম বাড়েনি। এরমধ্যে ফের ঘোষণা এসেছে- গ্যাসের দাম বেড়েছে। আবাসিকে গ্যাসের এক চুলার বর্তমান দাম ৯৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৯৯০ টাকা, দুই চুলা ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১ হাজার ৮০ টাকা করা হয়েছে।
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বিপণন বিভাগে চাকরি করেন হায়দার আলী। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে মিরপুর কাজীপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকেন। মহাখালীতে অফিসের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাসে ফিরছিলেন বাসায়। বাসের অন্যান্য যাত্রীদের সঙ্গে তিনি কথা বলছিলেন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে।
আলোচনার ফাঁকেই কথা হয় হায়দার আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করি। বেতনের বড় একটি অংশ চলে যায় মাসের প্রথমে বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতেই। বাসা ভাড়া ১২ হাজার টাকার সঙ্গে ইউটিলিটি আরও দুই হাজার টাকা, সব মিলিয়ে ১৪ হাজার। বাকি টাকা দিয়ে পুরো মাস সংসার খরচ, ছেলে-মেয়েদের পড়া-লেখার খরচ, আমার যাতায়াত। এক পয়সাও সঞ্চয় থাকে না কোনো মাসে, অনেক সময় ধার দেনা করতে হয়। বাজারে ঢুকলে শুধু সবজি ডিম কিনতে চাই, তাও বাড়তি দাম। মাছ-মাংস বা অন্যকিছুর তো কথাই নেই। আজ আবার বাড়ল গ্যাসের দাম। আমরা সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েছি। কিছুই করার নেই, কোনো মতে টিকে আছি। সব কিছুরই দাম বেড়েছে, শুধু বেতনটাই বাড়েনি আমাদের।
মিরপুর শেওড়াপাড়ায় আলাপ হয় আরেক বেসরকারি চাকরিজীবী তোফাজ্জল হোসেনের সঙ্গে। বর্তমান বাজার পরিস্থিত নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, বাজার জুড়ে সব পণ্যই বর্তমানে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। সব কিছুর দাম বেড়ে গেছে। আগে অফিসে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়ে বড় রাস্তায় এসে বাসে উঠতাম। মাঝখানের এই পথটা রিকশায় আসতাম ২০ টাকা ভাড়া দিয়ে। গত ১ তারিখ থেকে এই রিকশা ভাড়া বেড়ে হয়েছে ৩০ টাকা। রিকশাওয়ালার সঙ্গে দরদাম করতে লাগলে তারা বলে স্যার সবকিছুর দাম বেশি, ভাড়া বেশি না নিলে পোষায় না। দেশি বাদ দিয়ে ব্রয়লার মুরগি কিনি, তাও দাম আগের চেয়ে বেশি। আর চাল, তেলসহ অন্যান্য জিনিসের দাম না হয় নাই বললাম।
তোফাজ্জল হোসেন বলেন, বাজার জুড়ে সব কিছুর দামে লেগেছে আগুন। আমরা সাধারণ মানুষ কীভাবে যে এই বাজারে টিকে আছি এটা শুধু নিজেরাই জানি। চাকরি করি, বেতন পাই, সংসার চালাই। কিন্তু ভিতরের যে কী অবস্থা এটা শুধু নিজেরাই উপলব্ধি করতে পারি। বাজারে সব জিনিসের দাম বেড়েছে ঠিকই কিন্তু এরসঙ্গে জীবন-জীবিকার সমন্বয় করে আমাদের বেতন তো বাড়েনি। এই নির্দিষ্ট বেতনের টাকার মধ্যেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে আমাদের টিকে থাকা দিন দিন অসম্ভব হয়ে পড়ছে। আজ বাড়ল আবার গ্যাসের দাম।
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বাজার পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাজারে সব কিছুর দাম বাড়তি। বর্তমানে এমন কোনো পণ্য নেই যার দাম বাড়েনি। বিস্কুট-পাউরুটি থেকে শুরু করে সব জিনিসের দাম বেড়েছে। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে সবকিছু। বেতন ছাড়া সবকিছুর দামই বেড়েছে, এতে করে সমস্যায় পড়েছে সাধারণ মানুষ। পাশাপাশি ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া, শিক্ষা উপকরণ, স্বাস্থ্য চিকিৎসা এবং ঔষধপত্রের দামও বেড়েছে।
তিনি আরও বলেন, একসময় যেখানে ৩৫-৪০ হাজার টাকা আয় করা ছিল মানুষের স্বপ্ন, এখন ওই বেতনে সংসার চালানোই কষ্টকর। আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে আমন্ত্রণ থাকলেও এখন সহজে কেউ যেতে চায় না। এমনকি নিজেদের অনুষ্ঠানেও কাউকে দাওয়াত দিতে চায় না। অতি মুনাফার আশায় অসাধু ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে আমদানি করে বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করছে ফলে দাম বাড়ছে। খুব দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে সাধারণ মানুষ তাদের জীবন চালাতে পারবে না। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের দিকে বিশেষ দৃষ্টি রেখে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এএসএস/এনএফ