চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী এলাকায় বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুনের সূত্রপাত হয়। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে আগুনের তীব্রতা। ফায়ার সার্ভিস সদস্যদের প্রাণপণ চেষ্টার পরও টানা ছয় ঘণ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

এরই মধ্যে আগুনে দগ্ধ হয়ে ১৬ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। মৃত্যুর এ সারি আরও দীর্ঘ হওয়ার আশঙ্কা করেছে ফায়ার সার্ভিস। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ। ইতিহাসের ভয়াবহতম ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল সীতাকুণ্ড। স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে ডিপো এলাকা এবং চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চত্বর।  

এমন একটি ভয়াবহ ভোর দেখার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না সীতাকুণ্ড এলাকার মানুষ। রাত থেকেই প্রিয়জন হারানো মানুষের দিগ্বিদিক ছোটাছুটি লক্ষ্য করা গেছে। কখনো ডিপো এলাকা, কখনো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে ছোটাছুটি করে রাত কেটেছে স্বজনদের।

নিখোঁজদের অপেক্ষায় ঘটনাস্থলে রাত পার করেছেন অনেক স্বজন। আদৌ তারা বেঁচে আছেন কি না, মৃত্যুর তালিকায় তাদের নাম যুক্ত হয়েছে কি না, এ নিয়ে রয়েছে শঙ্কা। তারপরও প্রিয়জনকে এক নজর দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে রাত পার করেছেন স্বজনরা।  

এদিকে সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ৭টার মধ্যে সীতাকুণ্ডের কনটেইনার ডিপোর ভেতরের ধ্বংসস্তূপ থেকে দুইজনের মরদেহ উদ্ধার করেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এর মধ্যে একজন ফায়ার ফাইটার রয়েছেন। তবে তাদের নাম-পরিচয় জানা যায়নি। লাশ দুটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে বলে জানা গেছে।

ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়, শনিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের সূত্রপাত হয়। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের ১৫টি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু কর। কিন্তু তীব্রতা বেশি থাকায় পরবর্তীতে আরও নয়টি ইউনিট আগুনে নিয়ন্ত্রণে যোগ দেয়। ২৪টি ইউনিটের প্রাণপণ চেষ্টার পরও ভোর ৪টা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন তিন ফায়ার ফাইটার। সকাল ৭টা পর্যন্ত তাদের খোঁজ মেলেনি।  

চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস কন্ট্রোল রুমের ডিউটি অফিসার এম এ কফিল উদ্দীন ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনাস্থলে আমাদের ১৩টি ইউনিট কাজ করছিল। ফায়ার ফাইটাররা কাছ থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছিলেন। তখনই বিস্ফোরণ ঘটে। এখন পর্যন্ত ২১ জন ফায়ার ফাইটারের আহত হওয়ার খবর এসেছে। তাদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া ১০ পুলিশ সদস্যও আহত হয়েছেন।

তিনি বলেন, আহতের সংখ্যা বাড়তে পারে। কনটেইনারে রাসায়নিক ছিল বলে আমরা ধারণা করছি। তবে ঠিক কী রাসায়নিক ছিল, সে সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারিনি। আহত কয়েকজনের অবস্থা গুরুতর। ডিপো এলাকায় পানির সংকট রয়েছে। সেখানে একটি পুকুর থেকে পানি আনা হয়েছিল, সেই পানিও এখন শেষ পর্যায়ে। 

বিস্ফোরণের ঘটনায় মারা যাওয়াদের মধ্যে এখন পর্যন্ত চারজনের নাম-পরিচয় জানা গেছে। তারা হলেন- বাঁশখালীর মমিনুল হক (২৪),  মো. মহিউদ্দীন (২৪), ভোলা জেলার হাবিবুর রহমান (২৬) ও বাঁশখালীর রবিউল আলম (১৯)।

নিহত মমিনুল হকের বাবা ফরিদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিন মাস আগে বিএম কনটেইনার ডিপোতে চাকরিতে ঢোকে মমিনুল হক। শনিবার রাতে ছেলের সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়।

তিনি বলেন, ছেলে আগুন লাগার পরপরই আমাদের ফোনে জানায় বিষয়টি। ১০ মিনিট পর আবারও ফোন করে ছেলে বলে, বিস্ফারণে তার একটি পা উড়ে গেছে। এরপরই ফোনের লাইন কেটে যায়। রাতে হাসপাতালে এসে ছেলের মরদেহ পাই। এই কথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

চমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রাজীব পালিত ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুনের ঘটনায় রাত তিনটা পর্যন্ত দেড় শতাধিক ব্যক্তিকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এখনও আহতদের হাসপাতালে আনা হচ্ছে। 

চট্টগ্রামের বিভাগীয় পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের আইসিইউতে রোগী শিফট করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সিএমএইচে রোগী পাঠানো হচ্ছে। 

এদিকে দগ্ধদের সঠিক চিকিৎসা নিশ্চিতে চট্টগ্রামের সব চিকিৎসককে চমেক হাসপাতালে আসার আহ্বান জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী। শনিবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পরিদর্শন করে তিনি এ আহ্বান জানান।

সিভিল সার্জন ডা. ইলিয়াস চৌধুরী বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে করেছি আহত দেড়শজনের মতো হবে। কিন্তু এ অনেক বেশি। অনেক চিকিৎসক এরই মধ্যে এখানে পৌঁছেছেন। আমরা অন্যদেরও আসার আহ্বান জানিয়েছি। হাসপাতালের সব চিকিৎসক ও নার্স রোগীদের সেবায় আছেন।

এসকেডি