বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, যখন আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি ছিল, তখন প্রধানমন্ত্রী ক্যাপটিভ পাওয়ার দিয়েছিলেন। এখন আমাদের বিদ্যুতের ঘাটতি নেই। সরকার একদিকে ভর্তুকি দিচ্ছে, অন্যদিকে দাম কমানোর চেষ্টা করছে। বিদেশে জ্বালানির দাম বাড়ছে, আমাদের উপায় নেই।  
 
তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দামের বিষয়টি এখন এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের হাতে। আমি এতটুকু বলতে পারি, প্রধানমন্ত্রী এমন কিছু করবেন না, যাতে তা সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়ায়।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি ক্ষেত্রকে আমরা নিরবচ্ছিন্ন করতে চাই, সাশ্রয়ী মূল্য রাখতে চাই, ভবিষ্যতে এটিকে আধুনিক একটা সেক্টর বানাতে চাই। সেজন্য আগামী ৬-৭ বছরে প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলার ইনভেস্টমেন্ট লাগবে। 

বৃহস্পতিবার (২ জুন) জাতীয় প্রেস ক্লাবে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আয়োজিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস খাতের আর্থিক ঘাটতি সমন্বয়ের বিকল্প প্রস্তাব উপস্থাপন সংক্রান্ত নাগরিক সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। সভায় বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি না করে আর্থিক ঘাটতি মোকাবিলায় বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেন ক্যাবের সিনিয়র সহ-সভাপতি ড. শামসুল আলম। সভায় ক্যাব কর্তৃক ‘বাংলাদেশ জ্বালানি রূপান্তর নীতি (প্রস্তাবিত)’ শীর্ষক বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

সভায় প্রতিমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ (রাশিয়া-ইউক্রেন) পরবর্তী সময়ে জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম ঠিক রাখতে অনেক দেশই হিমশিম খাচ্ছে। তবে, আমাদের লক্ষ্য নির্ধারিত, কাদের জন্য ভর্তুকি দিতে চাই, কত দর রাখতে চাই। আমাদের একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যে মূল্য আসে, তা দেওয়ার সক্ষমতা নেই। তাই সরকার ভর্তুকি দেয়। তবে আমি ভর্তুকি বলি না, বলি বিনিয়োগ। কারণ তারা এ টাকা যেন নিজের উন্নয়নে কাজে লাগাতে পারে। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার কাজে, পুষ্টিকর খাদ্যের কাজে যেন এটা খরচ করতে পারে। সারে ব্যাপক ভর্তুকি দেওয়া হচ্ছে। তাই কোভিডকালেও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ আমরা।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সৃষ্টির ৫০ বছর এবং জাতির জনকের শতবর্ষে আমরা বলেছিলাম, সারা দেশকে শতভাগ বিদ্যুতের আওতায় আনব। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমরা শতভাগ গ্রিড লাইন করে ফেলেছি। এমন কোনো অঞ্চল নেই, যেখানে এখন বিদ্যুৎ নেই। অ-গ্রিড এলাকায় আমরা সোলার ও সাবমেরিন কেবল দিয়েছি। এলএনজিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা কর দিচ্ছি, এ কর না দিলেই তো হয়ে যায়। বিদ্যুতেও ২০ থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকার মতো হবে। আমরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছি।

সমুদ্রে গেলেই গ্যাস পাওয়া যাবে, এমন ধারণার বিষয়ে তিনি বলেন, সার্ভে করার পরও অনেক সময় ড্রিল করে গ্যাস পাওয়া যায় না। অনেকে মনে করেন সমুদ্রে গেলে কালই গ্যাস পাওয়া যাবে। এমন ধারণা সঠিক নয়, গ্যাস পেলেও আনতে ১০ বছর সময় লাগবে। সাগরে মাল্টি ক্লেইন সার্ভে হচ্ছে, তারপর দেখব এটা আনা সাশ্রয়ী হবে কি না। ২০০৯ সালে ১১০০ এমএমসি গ্যাস ছিল, এখন ২৫০০ এমএমসি গ্যাস। তারপরও কেন গ্যাসের অভাব! আমরা গ্যাস দিচ্ছি, চাহিদা আরও বেড়ে যাচ্ছে। নতুন নতুন শিল্প কারখানা হচ্ছে। এখনো ৫৫০ থেকে ৬০০ শিল্প সংযোগের আবেদন পড়ে রয়েছে। গ্যাস আমদানি করতে খরচ পড়ছে ৫৯ টাকা। গ্যাস বিক্রি করছি ৭ টাকায়।
 
নসরুল হামিদ বলেন, আমরা স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। প্রথম পরিকল্পনা ছিল দ্রুত বিদ্যুৎ দেব। তেল দিয়ে উৎপাদনে গেছি, সেখানে সফল হয়েছি। শিল্পের উৎপাদন বেড়েছে, মানুষের জীবনমান বেড়েছে। শিল্প মালিকরা গ্রামে যেখানে কম দামে জমি পেয়েছে, সেখানে কারখানা করেছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ক্যাবের উদ্যোগটা ভালো, আমি কিছু অংশ দেখেছি। তবে আরও গঠনমূলক পরামর্শ দিতে পারেন যাতে কাজে আসে। আরও একটু আধুনিক করা যায় কি না ভেবে দেখা দরকার।

তিনি বলেন, জমি নিয়ে যদি কয়লা উৎপাদন করি তাহলে কী হবে, ফসল উৎপাদন কমে যাবে। যে কারণে কয়লা উত্তোলন বন্ধ রয়েছে। সামান্য পরিমাণে উত্তোলন করা হচ্ছে।

ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য সারা দেশে বিদ্যুৎ সংযোগ স্থাপন করা হচ্ছে। তবে এটা কিন্তু ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড নয়। এটা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং সামাজিক উন্নয়নের পদক্ষেপ। তাই এই যে বিপুল ব্যয়ভার, তা যদি অন্যান্য ভোক্তাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তা বোধহয় সঠিক হবে না। তাই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে বাড়বে। এটাই বোধ হয় স্বাভাবিক। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকার সাধারণ মানুষের কল্যাণে অর্থ ব্যয় করতে কার্পণ্য করবে না।

তিনি বলেন, ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে রাখা গেলে অনেক সাশ্রয় হতো। জ্বালানির ক্ষেত্রে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। এখান থেকে বের হয়ে আসতে না পারলে সংকট থেকেই যাবে। দেশের কয়লা ক্ষেত্রগুলো ফেলে রাখা হয়েছে। সব জিনিসের দাম বাড়ছে, মানুষের অবস্থা খারাপ। সরকার বলছে, বিশ্বব্যাংক বলছে, মানুষের আয় বেড়েছে। হয়তো বেড়েছে, কিন্তু বেসরকারি চাকরিজীবী ও সাধারণ জনগণ অনেক সংকটে রয়েছে।

ক্যাব সভাপতি বলেন, আমেরিকার মতো মূল্যস্ফীতি আমাদের দেশে হয়নি। এর প্রধান কারণ হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মতো পণ্যের প্রশাসনিক প্রাইস। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি হলে মানুষের মনের আগুন দাবানলে রূপ নিতে পারে।

ক্যাবের বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, বিতরণ ও সঞ্চালন লাইসেন্সির পুঞ্জিভূত নিট মুনাফার পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। এমন মুনাফা বিইআরসি আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন এবং লুণ্ঠনমূলক। গ্যাসের চুরি কমানো গেলে দৈনিক ৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি কম করলেও চলে। চুরি কমানো, উৎস ও অগ্রিম আয়কর প্রত্যাহার করা হলে ভর্তুকি অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব। জ্বালানি খাতে সর্বক্ষেত্রে লুণ্ঠনমূলক ব্যয় এবং অবচয় সমন্বয় হলে ভর্তুকি কিংবা মূল্যবৃদ্ধি কোনোটিরই প্রয়োজন পড়ে না। বরং ইউনিট প্রতি ১৬ পয়সা কমানোর সুযোগ রয়েছে।

বিদ্যুৎ খাতের বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, কম্বাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো ৭০ শতাংশ হারে চালানো গেলে নিট উৎপাদন বাড়ে ৪১২ কোটি ইউনিট। হ্রাসকৃত গ্যাস সমন্বয়ের পর নীট খরচ বাড়ে ২ হাজার ৩০৮ কোটি ঘনফুট। অন্যদিকে ফার্নেস অয়েল প্লান্টে দশমিক ৫ শতাংশ কমানো হলে ৫ হাজার ৪৭৩ কোটি টাকা কমানো যায়। পাইকারি বিদ্যুতে নতুন করে করারোপ না করলে ২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা সাশ্রয় হয়। আমদানি পর্যায়ে ফার্নেস অয়েলের ওপর শুল্ক কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করায় ৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকা খরচ বেড়েছে। পাইকারি মূল্যহারের সমন্বয়হীনতা দূর করা গেলে ১১ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা ঘাটতি কমানো যায়।

ইকুইটির ওপর পিডিবি ৩ শতাংশ, পাবলিক কোম্পানি ১২ শতাংশ, যৌথ মালিকানাধীন কোম্পানি ১৬ শতাংশ মুনাফা পাচ্ছে। কুইক রেন্টালের তথ্য পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হয় ১৮ শতাংশের কম না। বিইআরসির মানদণ্ডে এ মুনাফা ৭ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা না। এখানে মুনাফা কমানো গেলে খরচ সাশ্রয় হয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আজকের এ সংকটের মূলে রয়েছে চড়া দামে এলএনজি আমদানি। আমরা স্পট থেকে আর দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি করছি। দাম বেড়েছে স্পট মার্কেটে। আমরা যদি যথাযথভাবে গ্যাস উত্তোলন ও অনুসন্ধান করতে পারতাম তাহলে আজকে স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে হতো না। বঙ্গবন্ধু সরকার ছাড়া আর কোনো সরকার গ্যাস অনুসন্ধানে সঠিক ভূমিকা রাখতে পারেনি। এখানে মনোযোগ দেওয়া জরুরি, না হলে সংকট থেকেই যাবে।

আলোচনায় অংশ নেন ক্যাবের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবীর ভূইয়া, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান, অধ্যাপক এমএম আকাশ প্রমুখ।

এএজে