লিজে বিমানের গচ্চা ১১শ কোটি
তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেই শেষ হয় দুদকের অভিযান
মিশর থেকে বোয়িংয়ের দুটি উড়োজাহাজ লিজ সংক্রান্ত ১১শ কোটি টাকার অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধানে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রধান কার্যালয় বলাকায় অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান টিম।
বুধবার (১ জুন) বেলা ১১টা থেকে বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত দুদক উপ-পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও সহকারী পরিচালক জেসমিন আক্তারের সমন্বয়ে একটি টিম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বলাকা অফিসে অভিযান চালায়।
বিজ্ঞাপন
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র জানায়, চার ঘণ্টার বেশি অভিযানকালে তারা লিজ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে। এর পাশাপাশি যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের বর্তমান অবস্থান ও কার কতটুকু দায়িত্ব ছিল সে সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয় অনুসন্ধান টিম। এছাড়া অভিযোগ সংশ্লিষ্ট নথিপত্র দ্রুত দুদকের পাঠানোর অনুরোধ করে দুদক টিম।
অন্যদিকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও সিইও ড. আবু সালেহ মোস্তফা কামাল এ বিষয়ে গণমাধ্যমে বলেন, যেহেতু বিষয়টি নিয়ে ইনকোয়ারি হয়েছে। বিষয়টি সংসদীয় কমিটিতে ছিল তারা সেটি রেফার করেছে। সেটি রেফারের পরিপ্রেক্ষিতে দুদকের টিম এসেছে। আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাই। দুদক যেন নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করতে পারে সেজন্য আমাদের লোকজন সেখানে কাজ করছে। দুদককে সর্বোচ্চ সহযোগিতার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, বিমানের ফ্লাইট সংক্রান্ত ডকুমেন্টগুলো আমরা দেখি। আজ দুদকের দুজনের টিম এসেছে। আমার টিমের বাকি লোকজন সেখানে আছেন। আমাদের সব তথ্য প্রিজার্ভ (সংরক্ষিত) আছে। আমি ২০১৮ সালে জয়েন করেছি। এর আগে কয়েকবার তদন্ত হয়েছে। আমি দেখেছি ইজিপ্টের দুটি বিমান ভিয়েতনামের বিমানবন্দরে আছে, যেখান থেকে ঠিক করে ফেরত দেওয়ার কথা। এই জটিলতার মধ্যে আমরা কাজ শুরু করেছি। আমিসহ আমাদের একটি টিম নিয়ে মিশরে গিয়েছিলাম। বিশেষ করে ফেরত দেওয়ার যে নেগোসিয়েশন (আলোচনা) সেগুলোতে আমি ছিলাম।
২০১৪ সালে পাঁচ বছরের চুক্তিতে ইজিপ্ট এয়ার (মিশর) থেকে বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর নামে দুটি উড়োজাহাজ লিজ নেয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কিন্তু বছর না যেতেই ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ফ্লাইট পরিচালনার পর একটি উড়োজাহাজের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। উড়োজাহাজটি সচল রাখার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকেই ভাড়ায় আনা হয় আরেকটি ইঞ্জিন। পরে ওই ইঞ্জিনও নষ্ট হয়ে যায়। সেই ইঞ্জিন মেরামত করতে পাঠানো হয় যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রতিষ্ঠানে। এতসব প্রক্রিয়ায় ইজিপ্ট এয়ার ও মেরামতকারী কোম্পানিকে পাঁচ বছরে বাংলাদেশ বিমানের গচ্চা দিতে হয়েছে ১১শ কোটি টাকা।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির তদন্তে বেরিয়ে আসে এসব তথ্য। এ ব্যাপারে অধিকতর তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) পাঠানোর সুপারিশ করে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
বিষয়টি দুদকে আসার পর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর দুই সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করা হয়। ওই টিম গত ২৮ মে অভিযোগ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নথিপত্র চেয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চিঠি পাঠায়।
এ বিষয়ে গত ৩০ মে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ড. মো. মোজাম্মেল হক খান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের কাছে একটি চিঠি পৌঁছেছে। সেই চিঠির বিষয়বস্তু হচ্ছে- ওই মন্ত্রণালয় মিশর থেকে দুটি বোয়িং ২০১৪ সালে লিজ নিয়েছিল। সেই লিজ নেওয়া দুটি বোয়িং যথাযথভাবে কাজ করেনি। সে বিষয়ে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর জাতীয় সংসদের সংসদীয় কমিটির প্রাথমিক তদন্তে দুর্নীতি, অনিয়ম এবং সরকারি অর্থ তসরুপের সত্যতা পাওয়া গেছে। সে বিষয়ে একটি তদন্ত প্রতিবেদন অধিকতর তদন্তের জন্য দুদকের কাছে পাঠানো হয়েছে। চিঠি পাওয়ার পর দুদক অনুসন্ধানের জন্য একজন উপ-পরিচালকের নেতৃত্বে দুই সদস্য বিশিষ্ট টিম গঠন করেছে। আমরা আশা করছি এই টিম অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রকৃত কারণ উদঘাটন করে দুদক আইন অনুসারে ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হবে।
অনুসন্ধান টিম লিজ নেওয়ার দরপত্রসহ অন্তত ১৩ ধরনের নথিপত্র তলব করে চিঠি দেয় যার মধ্যে রয়েছে-
ইজিপ্ট এয়ার কর্তৃক রিপোর্ট অব ফিজিক্যাল ইন্সপেকশন অব টু ৭৭৭-২০০ ইআর এয়াক্রাফট শীর্ষক পরিদর্শন প্রতিবেদনের ছায়ালিপি। ২০১৩ সালের ২৮ অক্টোবর ওই বিমান লিজ গ্রহণের জন্য গঠিত টিম, তাদের আদেশ ও এ সংক্রান্ত নথির ছায়ালিপি, ২০০৯ সালের ১১ জুনে অনুষ্ঠিত ফ্লাইট প্ল্যানিং কমিটির লিজ গ্রহণ সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্তের ছায়ালিপি, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ক্রয় নীতিমালা ও আর্থিক কার্যক্রমের সত্যায়িত ছায়ালিপি, বিমান লিজ গ্রহণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের সিদ্ধান্ত সংক্রান্ত নথি, টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি ও নোটসহ পূর্ণাঙ্গ নথির সত্যায়িত ছায়ালিপি, লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক দরপত্র ও বিজ্ঞপ্তি কোন কোন পত্রিকায় এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে তার রেকর্ডপত্র, দরপত্র উন্মুক্তকরণ কমিটির প্রতিবেদন ও দরপত্রে অংশগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান বা কোম্পানিগুলোর তালিকা, লিজ গ্রহণ প্রক্রিয়ায় দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির প্রতিবেদন, দরপত্র বিজ্ঞপ্তি থেকে শুরু করে এয়ারক্রাফট ২টি লিজ গ্রহণ এবং ফেরত দেওয়া পর্যন্ত যাবতীয় ব্যয়ের বিল-ভাউচার, রেজিস্ট্রার, ব্যাংক হিসাব বিবরণী, মুড অব ট্রান্সজেকশন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি, এয়ারক্রাফট লিজ গ্রহণের উদ্দেশ্যে গঠিত ইন্সপেকশন টিম সদস্যদের নাম, পদবি ও বর্তমান ঠিকানাসহ তালিকা, তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত নথির সত্যায়িত ছায়ালিপি, পাসপোর্টের প্রথম ২ পৃষ্ঠার ফটোকপি এবং মিশরে অবস্থান সংক্রান্ত যাবতীয় রেকর্ডপত্রের সত্যায়িত ছায়ালিপি, এয়ারক্রাফট দুটির বর্তমান অবস্থা ও অবস্থান সংক্রান্ত তথ্যাদি, বিমানের ৩টা চেক (এ.সি.ডি) সংক্রান্ত নিয়মাবলী বা নির্দেশিকা সংক্রান্ত ছায়ালিপি এবং এয়ারক্রাফট উড্ডয়নের সক্ষমতা, যোগ্যতা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক স্বীকৃত নিয়মাবলী বা নির্দেশিকা।
গত ২৪ মার্চ সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকে মিশরীয় উড়োজাহাজ লিজ নেওয়ার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ দুদকের মাধ্যমে তদন্তের জন্য কার্যবিবরণীর অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে দুটি মিশরীয় এয়ারক্র্যাফট লিজ প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে গঠিত সংসদীয় সাব কমিটির প্রতিবেদন, বিশেষ করে চুক্তিপত্র প্রণয়ন এবং যান্ত্রিক পরীক্ষা-নিরীক্ষাকরণ টিমের কার্যক্রম ত্রুটিপূর্ণ থাকায় স্থায়ী কমিটির সুপারিশসহ এসব বিষয়ে অধিকতর তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে দুদকে পাঠানোর সুপারিশ করা হয়।
কমিটির সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে কমিটির সদস্য ও প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, কাজী ফিরোজ রশীদ ও তানভীর ইমাম অংশ নেন। এরপরই তা দুদকে পাঠানো হয়েছে বলে জানা যায়।
আরএম/ওএফ