রাজধানীর গ্রিন লাইফ হাসপাতালের চিকিৎসক সাবিরা রহমান লিপি হত্যাকাণ্ডের এক বছর পার হচ্ছে। কে খুনি, খুনের নেপথ্যের কারণ কী— এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। নানা প্রশ্নের ঘুরপাকে স্বামীকেই সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে রেখেছেন তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা।

গত বছরের ৩১ মে রাজধানীর কলাবাগানের প্রথম লেনের একটি ভবনে ভাড়া করা ফ্ল্যাট থেকে চিকিৎসক সাবিরার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই ঘটনায় তার ভাই রেজাউল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

মামলার তদন্ত থানা পুলিশ থেকে এর গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), পরে ডিবি থেকে ন্যস্ত হয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে।

গত বছরের ৩১ মে সকালে চিকিৎসক সাবিরা রহমানের (৪৬) রক্তাক্ত ও অর্ধদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করা হয় / ফাইল ছবি

চিকিৎসক সাবিরা হত্যায় ‘পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আলাদা বাসা ভাড়া নেওয়া, স্বামীর আগের দুই বিয়ের তথ্য গোপন এবং খুনের রাতে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা কাটাকাটি’সহ বেশকিছু তথ্য পেয়েছে পিবিআই। এছাড়া নিহত স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর লেখা তিন পৃষ্ঠার অভিযোগের ডায়েরিও উদ্ধার করা হয়েছে। সেখানে পারিবারিক কলহ ও দ্বন্দ্বের বিভিন্ন তথ্য পেয়েছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

এসব তথ্যের ভিত্তিতে স্বামী এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদকে (৬৫) খুনি হিসেবে জোর সন্দেহ তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)।

চিকিৎসক সাবিরা রহমানের হত্যার আলামত নষ্ট করতে তার ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় / ছবি- সংগৃহীত

সর্বশেষ গত ১৯ এপ্রিল চিকিৎসক সাবিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত অভিযোগে এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। তাকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি এখন জেলে আছেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসক সাবিরা হত্যার ঘটনায় এর আগে অন্তত দুই ডজন পরিচিত বন্ধু, স্বজন, আত্মীয় ও বাসাটির বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তবে আমলযোগ্য কোনো তথ্য মেলেনি।
 
মামলার বাদী রেজাউল হক ‘সাবলেট থাকা তরুণী হত্যায় জড়িত থাকতে পারেন’ বলে সন্দেহ পোষণ করলেও তাকেসহ হেফাজতে নেওয়া সবাইকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চিকিৎসক সাবিরা যে হত্যাকাণ্ডের শিকার তা শতভাগ নিশ্চিত। আগে হত্যা, পরে আগুন দিয়ে আলামত নষ্টের অপচেষ্টাও স্পষ্ট। কিন্তু কে খুনি, কেনই বা খুন হতে হলো সাবিরাকে— এর উত্তর এখনও মেলেনি।

হত্যার সুষ্ঠু বিচার হবে— এমন আশাবাদ ব্যক্ত করা স্বামী এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদ এখন সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে আছেন / ঢাকা পোস্ট

তবে পিবিআই বলছে, প্রধান সন্দেহভাজন স্বামী এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদ জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। সেসব তথ্য ধরে তদন্ত এগোচ্ছে।

চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস এ হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসক সাবিরা হত্যায় যৌক্তিক কিছু কারণ সামনে আসায় হত্যাকাণ্ডে সন্দিগ্ধ হিসেবে স্বামী সামছুদ্দিন আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে দেখা হচ্ছে। তিনি এখন জেলে আছেন।

গত বছরের ৩১ মে সকালে রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেনের একটি ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের শোবার ঘর থেকে চিকিৎসক সাবিরা রহমানের (৪৬) রক্তাক্ত ও অর্ধদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ

‘জিজ্ঞাসাবাদে স্বামী সামছুদ্দিন আজাদ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গোপন করেন। তিনি সাবিরাকে বিয়ে করার আগে আরও দুটি বিয়ে করেছিলেন। প্রথম ঘরে একটা মেয়ে এবং দ্বিতীয় ঘরেও একটা মেয়ে আছে তার। সর্বশেষ সাবিরার ঘরেও তার একটা মেয়ে রয়েছে। তবে, সাবিরার কাছে প্রথম বিয়ের কথা তিনি গোপন করেছিলেন। এ নিয়ে দুজনের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়েছিল।’

চিকিৎসক সাবিরা রহমান হত্যার তদন্তে ঘটনাস্থলে উপস্থিত বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা / ছবি- সংগৃহীত

ঘটনার আগের রাতে চিকিৎসক সাবিরার সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে দীর্ঘ ২৮ মিনিট কথা হয় সামছুদ্দিন আজাদের। ওই কথোপকথনে তিনি উচ্চস্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। খুনের দিন সকালে তিনি ফজরের নামাজের জন্য ওঠার পর তার মোবাইলে ইনকামিং ও আউটগোয়িং কল বন্ধ পাওয়া যায়। অর্থাৎ ওই সময় তার মোবাইল বন্ধ ছিল। আর গাড়িচালক কখনওই তার বাসায় রাতে থাকতেন না। খুনের রাতে মালিবাগের নিজ বাসায় ছিলেন চালক। সবমিলে সন্দিগ্ধ আসামির তালিকায় শীর্ষে আছেন স্বামী এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদ। আমরা সব আমলে নিয়েই তদন্ত করছি— বলেন তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা। 

ফরেনসিক পরীক্ষায় কোনো আলামত পাওয়া গেছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ- সিআইডির রাসায়নিক ফরেনসিক পরীক্ষাতেও বিশেষ কারও ফুটপ্রিন্ট বা আলামত পাওয়া যায়নি। আলামত মূলত আগুন লাগিয়ে নষ্ট করা হয়েছে।

চিকিৎসক সাবিরা হত্যায় ‘পারিবারিক দ্বন্দ্ব, আলাদা বাসা ভাড়া নেওয়া, স্বামীর আগের দুই বিয়ের তথ্য গোপন এবং খুনের রাতে ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে কথা কাটাকাটি’সহ বেশকিছু তথ্য পেয়েছে পিবিআই। এছাড়া নিহত স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর লেখা তিন পৃষ্ঠার অভিযোগের ডায়েরিও উদ্ধার করা হয়েছে

উদ্ধার হওয়া তিন পাতার ডায়েরির বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, স্বামী সামছুদ্দিন আজাদের সঙ্গে বিরোধের কারণে চিকিৎসক সাবিরা কলাবাগানে বাসা ভাড়া নিয়ে আগের স্বামীর ঘরের ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। যদিও বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় সাবিরা বলেছিলেন, তার স্বামী বিদেশে থাকেন। তবে, আজাদ সাবিরার বাসায় যাতায়াত করতেন।

ডায়েরিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘বিয়ের কারণে নিজে খুবই জুলুমের শিকার হয়েছেন। তার আগের দুই ঘরের দুই মেয়ের সঙ্গে করা হতো বিরূপ আচরণ। চিকিৎসক সাবিরা প্রায়ই বিয়ে নিয়ে নিজের হতাশা এবং অন্য কাউকে বিয়ে করলে ভালো হতো বলতেন।’

‘চিকিৎসক সাবিরা কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ বা লিভ টুগেদারে বিশ্বাসী ছিলেন’ উল্লেখ করে ডায়েরিতে আজাদ আরও লেখেন, ‘স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিক ভাবনায় নিমগ্ন ছিলেন সাবিরা। সংসার নয় টাকাই ছিল মুখ্য। বিয়ের নামে সাইনবোর্ড, বিয়ের নামে মূলত আর্থিক ডিলিংস করেছেন সাবিরা। পারিবারিক শিক্ষা ও জ্ঞানের অপপ্রয়োগ ও সাংসারিক দায়িত্বহীনতা, মানবিক মূল্যবোধের অভাব ছিল তার।’ চিকিৎসক সাবিরাকে ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত ও উন্মাদ’ বলেও মনে করতেন স্বামী আজাদ।

ডায়েরিতে আজাদ আরও লেখেন, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিক ভাবনায় নিমগ্ন ছিলেন সাবিরা। সংসার নয় টাকাই ছিল মুখ্য। বিয়ের নামে সাইনবোর্ড, বিয়ের নামে মূলত আর্থিক ডিলিংস করেছেন সাবিরা। পারিবারিক শিক্ষা ও জ্ঞানের অপপ্রয়োগ ও সাংসারিক দায়িত্বহীনতা, মানবিক মূল্যবোধের অভাব ছিল তার
রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেনের এই ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের শোবার ঘর থেকে চিকিৎসক সাবিরার মরদেহ উদ্ধার করা হয় / ছবি- সংগৃহীত   

আলোচিত এ মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর (উত্তর) বিশেষ পুলিশ সুপার মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক সংস্থাই এখানে কাজ করছে। আমরাও শুরু থেকে ছায়া তদন্ত করে আসছি। মূল তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর ভিন্ন কিছু খুঁজতে গিয়ে মূলত স্বামী আজাদকে গ্রেপ্তার করা। তিনি জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন।

‘জিজ্ঞাসাবাদে তিনি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে উত্তর দিয়েছেন। অনেক কিছু এড়িয়ে যাওয়ারও চেষ্টা করেন। সরাসরি এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত কে বা কারা, তা স্পষ্ট না হলেও বেশকিছু তথ্যের ভিত্তিতে স্বামী আজাদকে সন্দেহের তালিকায় শীর্ষে রাখা হয়েছে। আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। আশা করছি দ্রুত খুনিকে এবং খুনের মোটিভ (উদ্দেশ্য) বের করতে সক্ষম হবো।’

গত বছরের ৩১ মে সকালে রাজধানীর কলাবাগান প্রথম লেনের একটি ভবনের তৃতীয় তলার ফ্ল্যাটের শোবার ঘর থেকে চিকিৎসক সাবিরা রহমানের (৪৬) রক্তাক্ত ও অর্ধদগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে ওই বাসা থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আগুন লাগার খবর দেওয়া হয়। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুনের ধোঁয়া দেখতে পান। আগুন নেভানোর পর চিকিৎসক সাবিরার শরীরের কিছু অংশ দগ্ধ, গলা কাটা ও পিঠে ধারাল অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান তারা।

খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ক্রাইম সিন ইউনিট। আলামত সংগ্রহের পর তারা জানায়, চিকিৎসক সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা (ব্রুটালি কিলড) করা হয়েছে। তাকে ধারাল অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। দাহ্য পদার্থ না থাকায় আগুন তেমন ছড়ায়নি। তবে, সাবিরার শরীরের কিছু অংশ এতে দগ্ধ হয়।

সাবিরা রহমান লিপি রাজধানীর বেসরকারি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (সনোলজিস্ট) ছিলেন।

জেইউ/এমএআর/