রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পে ৭৭ কাঠা জমি বরাদ্দে নয়-ছয়!
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) নিয়ন্ত্রণাধীন পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের ৭৬ দশমিক ৮৩ কাঠা আয়তনের জমি বরাদ্দ নিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। জমিটি পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে প্রাথমিক বরাদ্দ দেওয়া হলেও অদৃশ্য ক্ষমতা ও রাজউকের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর জালিয়াতিতে নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে চূড়ান্ত বরাদ্দ দেওয়া হয়।
অথচ পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূইয়া যখন আবেদন করেন তখন সৈয়দা ফেরদৌসী আলম নীলা সহযোগী হিসেবে রাজউক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। যখন কোম্পানিটি প্রাথমিকভাবে বরাদ্দ পায় এরপরই পুরো চিত্র উল্টো যেতে থাকে।
বিজ্ঞাপন
রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশে সৈয়দা ফেরদৌসী আলম নীলা পৃথক কোম্পানি খুলে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দ বাগিয়ে নেয়। সবশেষে উচ্চ আদালতের নির্দেশনায় রাজউকের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এমন ঘটনার সত্যতাও পাওয়া গেছে। ওই তদন্ত রিপোর্ট ঢাকাপোস্টের কাছে রয়েছে।
ওই তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরেই এমন অভিযোগের অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দ দেওয়াসহ রাজউক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবৈধ সম্পদ অর্জন ও পাঁচ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগও রয়েছে দুদকের আমলে নেওয়া অনুসন্ধানের নথিপত্রে। শিগগিরই অভিযোগটি অনুসন্ধান করতে টিম গঠন করবে কমিশন।
এ বিষয়ে দুদকের পরিচালক (দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেল) উত্তম কুমার মন্ডলের সই করা এক চিঠিতে বলা হয়েছে, রাজউকের এস্টেট শাখার কয়েকজন চিহ্নিত দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের যোগসাজশে সৈয়দা ফেরদৌসী আলম নীলার কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দকৃত প্লট নিয়ম বহির্ভূত ও অবৈধভাবে নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। নতুন নাম দেওয়া হয়েছে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেড। একই সঙ্গে কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দসহ উচ্ছেদ অভিযানের নামে ঘুষ গ্রহণ, নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে পাঁচ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগটি ২০২১ সালের ২১ সেপ্টেম্বরে দাখিল করা হয়েছিল। অভিযোগটি রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রহমান ও অন্যান্যদের বিরুদ্ধে দুদকে দাখিলকৃত অভিযোগের সঙ্গে অনুসন্ধানের জন্য কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
অভিযোগ বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের ১৬ অক্টোবর রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দের বিজ্ঞপ্তি পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। আবেদনের শেষ ছিল তারিখ একই বছরের ২৩ নভেম্বর। ওই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ২০১৭ সালের ১৯ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের ছাড়পত্রের জন্য জয়েন্ট স্টক কোম্পানিতে আবেদন করে এবং নিবন্ধন প্রাপ্ত হয় ৭ অক্টোবর। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূইয়া ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাজারুল হক শহিদ। আর পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের ছাড়পত্রের জন্য ২০১৮ সালের ৩১ অক্টোবর আবেদন করে এবং নিবন্ধন প্রাপ্ত হয় ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর। এ কোম্পানির চেয়ারম্যান সৈয়দা ফেরদৌসি আলম নীলা, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহ আলম ফটিক ও পরিচালক মিস শাহরিয়া আলম।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ১১ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দে দেওয়ার জন্য আবেদন জমা দেওয়া হয়। আবেদনের সঙ্গে শর্ত অনুযায়ী ১৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমার রশিদ দেওয়া হয়। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর রাজউকের ১৩তম বোর্ড সভায় পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্লট বরাদ্দ দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর একই বছরের ৩ অক্টোবর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে পূর্বাচল প্রকল্পের ১ নম্বর সেক্টরের ২০৪ নম্বর সড়কের ৭৬ দশমিক ৮৩ কাঠা আয়তনের ৩ নম্বর প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। পরে ২০১৮ সালের ৫ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দকৃত প্লটটি পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে বরাদ্দ দেওয়ার জন্য রাজউকে আবেদন করা হয়।
আবেদনের পরদিন নাম পরিবর্তন বিষয়ে নথিতে উপস্থাপন করা হলে রাজউক চেয়ারম্যান প্রস্তাব অনুমোদিত লিখে স্বাক্ষর করে দেন। এরপর ২০ নভেম্বর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের পরিবর্তে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নাম পরিবর্তন সংক্রান্ত পত্র জারি করা হয়।
তথ্য বলছে, সাময়িক বরাদ্দপত্র ইস্যুর পর সৈয়দা ফেরদৌসী আলম নীলা ২০১৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি প্লটের প্রথম কিস্তির তিন কোটি এক লাখ ৩২ হাজার টাকা জমা দেন। পরে ২০১৯ সালের ২৫ জুলাই দ্বিতীয় কিস্তির দুই কোটি ২৫ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং ২০২০ সালের ১৫ অক্টোবর তৃতীয় কিস্তির দুই কোটি ৫৩ লাখ ১০ হাজার ৮৮০ টাকা জনতা ব্যাংকে জমা দেন।
অভিযোগ রয়েছে, রাজউকের কোনো প্লট বা ফ্ল্যাট যে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়া হয় তা পরিবর্তন করতে হলে যিনি প্রদান করবেন এবং যাকে প্রদান করবেন তাদের উভয়কে জাতীয় পরিচয়পত্র ও ছবিসহ রাজউকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার নিকট হাজির হতে হয়। অথচ রাজউকের পূর্বাচল শাখার কর্মকর্তারা এক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দকৃত প্লটটি আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেওয়ার আগে এ বিষয়ে কোনো শুনানি করেনি। এমনকি প্লট পরিবর্তনের যে ফি জমা দিতে হয়, সেটিও জমা হয়নি। ঘুষের বিনিময়ে রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পের কর্মকর্তাসহ কতিপয় কর্মকর্তা-কর্মচারী এক প্রতিষ্ঠানের প্লট আরেক প্রতিষ্ঠানের নামে বরাদ্দ দেয়।
তথ্য বলছে, বিষয়টি জানার পর পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের চেয়ারম্যান কফিল উদ্দিন ভূইয়া রাজউকে আবেদন করেন। কিন্তু রাজউক বিষয়টি সমাধান না দিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। উপায়ান্ত না পেয়ে তিনি হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট ঘটনাটি তদন্ত করে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে আদেশ জারি করেন। এরপর রাজউকের সদস্যকে (এস্টেট ও ভূমি) প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটির অপর সদস্যরা হলেন- প্রধান প্রকৌশলী (বাস্তবায়ন), প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ ও পরিচালক (আইন)। কমিটি তদন্ত শেষে সংস্থাটির চেয়ারম্যানের কাছে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সার্বিক বিষয় বিবেচনা করে প্রতীয়মান হয়েছে কফিল উদ্দিন ভূইয়া ও সৈয়দা ফেরদৌসি আলম নীলার দাবিকৃত পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেড একই প্রতিষ্ঠান। পূর্বাচল কনভেনশন লিমিটেডের নাম পরিবর্তন করে পূর্বাচল নীলা কনভেনশন লিমিটেডের নামে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় ত্রুটি রয়েছে।
এ বিষয় রাজউক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মো. মুনির হোসেন খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন।
আরএম/ওএফ