তৈরি বাইরে, বিক্রি ঢাকায়
বৈধ ভেন্ডরের সুযোগে অবৈধ জাল স্ট্যাম্পের কারবার
ঢাকার নিকটবর্তী ও ঢাকার অদূরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের নজরদারি এড়িয়ে তৈরি হচ্ছে জাল জুডিশিয়াল ও নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প রেভিনিউ স্ট্যাম্প। যা বৈধ ও অবৈধ ভেন্ডরদের মাধ্যমে বিক্রি করা হচ্ছে। এতে সরকার যেমন হারিয়েছে কোটি টাকার রাজস্ব, তেমনি গত তিন বছরে কয়েক হাজার মানুষ এসব কিনে ভোগান্তিতে পড়েছেন।
র্যাব-৩ ও এনএসআই’র যৌথভাবে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ জাল জুডিশিয়াল ও নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি তৈরি চক্রের মূলহোতা ফরমান আলীসহ চার জনকে গ্রেপ্তারের পর এমন তথ্য দিয়েছে র্যাব। শনিবার (২১ মে) রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ।
বিজ্ঞাপন
তিনি বলেন, সম্প্রতি র্যাব-৩ ও এনএসআই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানতে পারে যে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অধিক লাভের আশায় জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রেভিনিউ স্ট্যাম্প, প্রতারণামূলকভাবে সাধারণ জনগণের কাছে বিক্রি করে আসছে। এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (২০ মে) র্যাব-৩ ও এনএসআই’র যৌথ দল রাজধানীর মতিঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে অবৈধ জাল জুডিশিয়াল ও নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি তৈরি চক্রের মূলহোতা ফরমান আলী সরকার (৬০), সহযোগী তুহিন খান (৩২), আশরাফুল ইসলাম (২৪) ও মো. রাসেলকে (৪০) গ্রেপ্তার করে।
অভিযানে ১০০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৬৫০০টি, ৫০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৩০০০টি, ৩০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৪০০টি, ২৫ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৫০০টি, ২০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৪০০০টি, ১০ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ২৫০০টি, ৫ টাকা মূল্যমানের স্ট্যাম্প ৬৫০০টি, ২ টাকা মূল্যমানের অনুলিপি স্ট্যাম্প ১৫০০টিসহ মোট ২৪ হাজার ৯০০টি নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়, যার মূল্য ৯ লাখ ৬৫ হাজার টাকা।
অভিযানে ৫০০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ২০০টি, ১০০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৩৬৪০টি, ৫০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৪২০০টি, ২৫ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ১৬০টি, ২০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৩৭২০টি, ১০ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ১১২৮০টি, ৫ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ১৪২৮০টি, ৪ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ২৪০টি ও ২ টাকা মূল্যমানের রাজস্ব স্ট্যাম্প ৪৮০টিসহ মোট ৩৮ হাজার ২০০টি রাজস্ব স্ট্যাম্প জব্দ করা হয়। যার মূল্য ৯ লাখ ৩৮ হাজার ৫২০ টাকা। সব মিলিয়ে উদ্ধার করা সব স্ট্যাম্পের সর্বমোট মূল্য ১৯ লাখ ৩ হাজার ৫২০ টাকা।
এছাড়া কার্টিজ পেপার ৫০০০টি, মনিটর একটি, সিপিইউ একটি, প্রিন্টার একটি এবং নগদ ৮ লাখ ৮৬ হাজার ৪৬০ টাকা জব্দ করা হয়।
ভেন্ডর না হয়েও জাল স্ট্যাম্প কারবারে চক্রের সদস্যরা
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তাররা র্যাবকে জানিয়েছে, দীর্ঘদিন ধরে জাল জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, নন-জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রেভিনিউ স্ট্যাম্প সংগ্রহ করে প্রতারণামূলকভাবে বিক্রি করে অন্যায়ভাবে লাভবান হয়ে আসছে চক্রের সদস্যরা। উদ্ধার করা স্ট্যাপের বিষয়ে তারা কোনো ধরনের কাগজপত্র দেখাতে ও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি।
জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা ফরমান আলী
জালিয়াতি চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তার হওয়া ফরমান আলী সরকার। তিনি কুড়িগ্রাম সরকারি ডিগ্রী কলেজ হতে ডিগ্রি পাসের পর ১৯৯৩ সাল থেকে স্ট্যাম্প ভেন্ডারের ব্যবসায় জড়িত হন। একই অপরাধে ২০১৭ সালেও পল্টন থানায় ফরমান আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেছিল সিআইডি। ওই মামলায় তিনি কারাভোগ করেছেন। জামিনে বেরিয়ে আবারো একই অপরাধে জড়ান। গ্রেপ্তারের সময় তিনি নিজেকে ভেন্ডার হিসেবে পরিচয় দিলেও জব্দ সব স্ট্যাম্প সম্পর্কে সে তার রেজিস্টারপত্রে সঠিক হিসাব দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন।
গ্রেপ্তার তুহিন খান শনির আখড়ার একটি মাদরাসায় অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। তিনি অবৈধ জাল স্ট্যাম্প মতিঝিলের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ দোকানে আর্থিক লাভের আশায় প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রি করতে ফরমান আলীর সহযোগী হিসেবে কাজ করেন। তিন-চার বছর ধরে তিনি এ প্রতারণা ও জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।
গ্রেপ্তার আশরাফুল ইসলাম লালমনিরহাটের পুটিকাটা সিন্দুরমতি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছেন। তিনি আগে গ্রামীণফোন কোম্পানিতে চাকরি করতেন। গত দুই বছর ধরে ফরমান আলীর সহযোগী হিসেবে কাজ করে আসছিলেন।
গ্রেপ্তার রাসেল নেত্রকোনার কোনাপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেছেন। তিনি অবৈধ জাল স্ট্যাম্প মতিঝিলের বিভিন্ন স্থানে ভ্রাম্যমাণ দোকানে আর্থিক লাভের আশায় প্রতারণার মাধ্যমে বিক্রি করে আসছিলেন। তিনিও তিন/চার বছর ধরে এ প্রতারণা ও জাল জালিয়াতিতে জড়িত। রাসেলের নামে রাজধানীর পল্টন থানায় ২০১২ সালের একটি অস্ত্র আইন ও একটি অপহরণের মামলা রয়েছে।
র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, সরকারিভাবে দি সিকিউরিটি প্রিন্টিং কর্পোরেশন বাংলাদেশ লিমিটেড গাজীপুর থেকে সব স্ট্যাম্প সংগ্রহ করার বিধান প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু চক্রটি অবৈধভাবে সব ধরনের জাল জুডিশিয়াল ও নন জুডিশিয়াল স্ট্যাম্প, রেভিনিউ স্ট্যাম্প, কোর্ট ফি স্ট্যাম্প তৈরি, মজুত ও বিক্রি করে আসছিল।
তিনি বলেন, জব্দ করা স্ট্যাম্পগুলোর কাগজ ও মুদ্রণ সঠিক নয়। এগুলো ছিদ্রবিহীন এবং পেছনে আঠালো প্রলেপের কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। স্ট্যাম্পের নিরাপত্তা বৈশিষ্ট্যযুক্ত নয়।
বৈধ ভেন্ডরদের অনেকে বিক্রি করছেন জাল স্ট্যাম্প
এক প্রশ্নের জবাবে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গত বৃহস্পতিবার সিআইডি’র একটি দল তিন জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আমরা তথ্য পেয়েছি বৈধ ভেন্ডরদের মধ্যে অনেকে বৈধতার সুযোগ নিয়ে আসল স্ট্যাম্পের সঙ্গে নকল বা জাল স্ট্যাম্প বিক্রি করছেন। আমরা গ্রেপ্তারদের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি তালিকা প্রস্তুত করেছি। সেই তালিকা ধরে জালিয়াতি চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারে চেষ্টা চলছে।
কীভাবে কোথায় এই জাল স্ট্যাম্প তৈরি হচ্ছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ঢাকার অদূরে ও ঢাকার বাইরে কয়েকটি স্থানের নাম আমরা জেনেছি যেখানে জালিয়াতি চক্রের একটি গ্রুপ জাল স্ট্যাম্প তৈরি করছে। অভিযান ও গ্রেপ্তারের স্বার্থে আমরা তা প্রকাশ করছি না।
জেইউ/এসএসএইচ