প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) দেশে ফিরিয়ে আনতে ভারত ও ইন্টারপোলসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

এরইমধ্যে বাংলাদেশে অবস্থিত ইন্টারপোলের অফিস থেকে ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোতে (এনসিবি) একটি বার্তা পাঠানো হয়েছে আসামি প্রত্যর্পণেরে জন্য।

সোমবার (১৬ মে) দুদকের ভারপ্রাপ্ত সচিব সাঈদ মাহবুব খান সাংবাদিকের এসব তথ্য জানান। 

ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বারাসাতের অশোকনগর এলাকা থেকে দেশটির কেন্দ্রীয় আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা ইডি প্রশান্ত কুমার হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানতে পেরেছি। আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য আইনগত প্রক্রিয়ায় দুদকের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। 

তিনি বলেন, প্রশান্ত কুমার হালদারসহ ৬ জন গ্রেপ্তার হওয়ার তথ্য জানার পর এরইমধ্যে আগে জারি করা রেড এলার্ট নোটিশ এবং দুদকের দায়ের করা মামলার সূত্রে বাংলাদেশে অবস্থিত ইন্টারপোলের অফিস থেকে ভারতের দিল্লিতে অবস্থিত ন্যাশনাল সেন্টার ব্যুরোতে (এনসিবি) আসামিদের ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রত্যর্পণে ইলেক্ট্রনিক বার্তা পাঠানো হয়েছে।

শিগগিরই আরও কিছু কার্যক্রম নেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আসামিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য দুদক শিগগিরই আরও কিছু কার্যক্রম হাতে নেবে। আসামিদের ফেরাতে ভারতে অবস্থিত বাংলাদেশের দূতাবাসে চিঠি দেওয়া হবে। একইসঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হবে। ভারতে পাচার করা অর্থ ও ব্যাংক হিসাবের তথ্য সংগ্রহের জন্য বিআইএফইউ বরাবর পুনরায় চিঠি দেওয়া হবে।

ভারপ্রাপ্ত সচিব বলেন, আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত প্রায় আড়াইশ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানিলন্ডারিং অপরাধের দায়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি একটি মামলা রুজু করা হয়। মামলা তদন্তের সময় আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করা হলে তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। বিদেশে পলাতক থাকায় তাকে গ্রেপ্তার করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারপোলের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। পরে ইন্টারপোলের চাহিদা অনুযায়ী আদালতের আদেশে আসামির বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট অব অ্যারেস্ট জারি করা হয়। এরপর আদেশসহ আসামির আঙ্গুলের ছাপ এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ২০২১ সালের শুরুর দিকে ইন্টারপোল বরাবর পাঠানো হয়। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ইন্টারপোল আসামির বিরুদ্ধে ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে রেড এলার্ট জারি করে।

পরে নিয়মিত সংস্থাটির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে আসামির অবস্থান ও তথ্য জানার চেষ্টা করা হয়। এর আগে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক/ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ভারত, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিদেশে আর্থিক লেনদেনের তথ্য সংগ্রহ করে পাঠানোর জন্য বিআইএফইউ বরাবর যথাযথ প্রক্রিয়ায় চিঠি দেওয়া হয়েছিল।

কতদিনের মধ্যে ফেরত আনা যাবে, এমন প্রশ্নের জবাবে সাঈদ মাহবুব খান বলেন, ভারতে বেশকিছু মামলা হয়েছে, হয়ত আরও মামলা হবে। একটা মামলায় রিমান্ডেও নিয়েছে। এখন আমাদের দিক থেকে প্রেসার ও চেষ্টা থাকবে যে, যত দ্রুত তাকে আমরা আমাদের দেশে নিয়ে আসতে পারি। সেজন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে আমাদের অনুরোধ অব্যাহত থাকবে। সেখান থেকে কত দিনের মধ্যে ফেরত আনা যায় সেটা স্পেসিফিক বলা কঠিন। সেখানে মামলা বা এর বিচার কতদিন লাগবে অথবা বিচারের আগে ফেরত আনা যাবে কি যাবে না, এসব কারণে সময়ের বিষয়টি নির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।

আলোচিত পি কে হালদার সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর চার মাস পর প্রথম মামলা করে দুদক। ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ২৭৫ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেন সংস্থাটির উপ-পরিচালক মো. সালাউদ্দিন। পরে দুদকের আরেক উপ-পরিচালক গুলশান আনোয়ার প্রধানের নেতৃত্বে একটি টিম আর্থিক কেলেঙ্কারির বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে। ওই টিম বিগত দুই বছরে অন্তত ৩৪টি মামলা করে। এছাড়া অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলার চার্জশিট ২০২১ সালের নভেম্বরে দাখিল করা হয়। যেখানে ৪২৬ কোটি টাকার জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও বিভিন্ন ব্যাংক হিসাবে প্রায় ৬ হাজার ৮০ কোটি টাকা লেনদেনের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক এমডি পি কে হালদারসহ মোট ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় দুদক।

অন্যদিকে ৩৪ মামলার মধ্যে তিনটির তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। বাকিগুলো তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্তে এখন পর্যন্ত ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে উজ্জ্বল কুমার নন্দী, পি কে হালদারের সহযোগী শংখ বেপারী, রাশেদুল হক, অবান্তিকা বড়াল ও নাহিদা রুনাইসহ ১০ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এছাড়া এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ অবরুদ্ধ ও জব্দ করা হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের মাধ্যমে ৬৪ জনের বিদেশ যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। একই ইস্যুতে ৩৩ ব্যক্তির সম্পদ বিবরণীর নোটিশ জারি করা হয়েছে। এর মধ্যে দুজন সময়মতো জমা না দেওয়ায় তাদের বিরুদ্ধেও মামলা করা হয়।

গত শনিবার (১৪ মে) ভারতের কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের তদন্তকারী সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়ি থেকে পি কে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাকে আদালতে হাজির করলে তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন বিচারক।

এক বিবৃতিতে ইডি বলেছে, হাজার কোটি টাকা পাচারকারী পি কে হালদার নাম পাল্টে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশে বসবাস করতেন। প্রদেশের উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলার অশোকনগরের একটি বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন তিনি। বাংলাদেশি নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। প্রশান্ত কুমার হালদার নিজেকে শিব শঙ্কর হালদার নামে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন।

বাংলাদেশি এই অর্থপাচারকারী পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য থেকে ভারতীয় রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, প্যান এবং আধার কার্ডও সংগ্রহ করেছিলেন। প্রশান্ত কুমার হালদারের অন্য সহযোগীরাও ভারতীয় এসব কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে সংগ্রহ করেন।

আরএম/জেডএস