কেউ মধ্যরাত-কেউ সেহরির পর টিকিটের লাইনে
ভোর তখন পৌনে ৬টা। কমলাপুর রেলস্টেশনের কাউন্টারগুলোর সামনে থেকে এঁকে-বেঁকে বাহিরের দিকে চলে এসেছে মানুষের দীর্ঘ লাইন। এই লাইনে যোগ দিতে কমলাপুর স্টেশনে কেউ এসেছেন গভীর রাতে, কেউবা সেহরির পর এসে যুক্ত হয়েছেন। ভোরের আলো ফোটার পর থেকে এই লাইন আরও দীর্ঘ হচ্ছে।
শনিবার (২৩ এপ্রিল) সকালে কমলাপুরে কাউন্টারগুলোর সামনে এত মানুষের অপেক্ষা বা দীর্ঘ লাইন মূলত ঈদের অগ্রিম টিকিটের জন্য। টিকিটপ্রত্যাশীরা আজ ২৭ এপ্রিলের ঈদযাত্রার টিকিট পাবেন।
বিজ্ঞাপন
এদিকে সময় যত যাচ্ছে লাইনে মানুষ এসে ততই যুক্ত হচ্ছে। তাদের সবার চোখ তখন হাতের মোবাইল অথবা ঘড়ির দিকে কখন বাজবে ৮টা? কারণ ৮টা বাজলেই কাউন্টারগুলো থেকে একযোগে শুরু হবে টিকিট বিক্রি। কাউন্টারের পাশাপাশি একই সময় অনলাইনেও পাওয়া যাবে নির্দিষ্ট দিনের কাঙ্ক্ষিত ট্রেনের টিকিট। এই দুই মাধ্যমেই পৃথকভাবে পাওয়া যাবে মোট টিকিটের ৫০ শতাংশ।
ঈদ আসলেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদ করতে নাড়ির টানে বাড়ি ফেরে মানুষ, যে কারণে প্রতি বছর ঈদের টিকিটপ্রত্যাশীদের এমন ভোগান্তি পোহানোর চিত্র দেখা যায়। যদিও গত দুই বছর করোনার কারণে ঈদের টিকিট এভাবে বিক্রি হয়নি কমলাপুর স্টেশন থেকে। দুই বছর পর ঈদের অগ্রিম টিকিট সংগ্রহের লক্ষ্যে স্বরূপে ফিরেছে চিরচেনা এই কমলাপুর।
পবিত্র ঈদুল ফিতরে স্বজনদের সঙ্গে ঈদ উদযাপনের লক্ষ্যে ইতোমধ্যে ঢাকা ছাড়তে শুরু করেছেন রাজধানীবাসী। আর ঈদ উপলক্ষে নির্দিষ্ট দিনগুলোর ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু হচ্ছে আজ। যে কারণে কাউন্টার গুলোর সামনে টিকিটপ্রত্যাশী মানুষের অপেক্ষা যেমন বাড়ছে, তেমনি নতুন মানুষের উপস্থিতিতেও আরও লম্বা হচ্ছে লাইন। কেউ পত্রিকা বিছিয়ে কাউন্টারের সামনে বসে, কেউবা গল্প আড্ডার মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছেন, মাঝে মাঝে আশপাশের লাইনে, সামনে পেছনে দাঁড়ানো অপরিচিত মানুষগুলোর সঙ্গে খোশ গল্পসহ নানা আলোচনায় মেতে উঠছেন তারা।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৭ এপ্রিলের টিকিট দেওয়া হবে আজ (২৩ এপ্রিল)। একইভাবে ২৮ এপ্রিলের টিকিট পাওয়া যাবে ২৪ এপ্রিল, ২৯ এপ্রিলের টিকিট ২৫ এপ্রিল, ৩০ এপ্রিলের টিকিট ২৬ এপ্রিল এবং ১ মের টিকিট ২৭ এপ্রিল বিক্রি করবে বাংলাদেশ রেলওয়ে।
দূর থেকে থেকে কাউন্টারের সামনে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ট্রেনগুলো নাম দেখে সেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী তামিম আহমেদ। ঢাকার উত্তরা থেকে তিনি কমলাপুরে এসে টিকিটের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি যখন কমলাপুরে এসে পৌঁছেছেন তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। কারণ তিনি আগেভাগেই সেহরি খেয়ে দ্রুত চলে এসেছেন কমলাপুরে। বারবার তিনি গুনতে চেষ্টা করছিলেন তার সামনে টিকিট কাউন্টার পর্যন্ত কত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি বলেন, সূর্যের আলো ফোটার আগে কমলাপুরে এসে দেখি আরও অনেক মানুষ আগে থেকেই লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন। আশা করছি টিকিট হয়ত পাব, কিন্তু কাঙ্ক্ষিত এসি টিকিটি নাও পেতে পারি। কারণ আমার সামনে আরও অনেকজন অপেক্ষা করছেন। আর ঈদের সময় সবারই প্রথম প্রত্যাশা থাকে এসি টিকিটের।
তিনি আরও বলেন, এবার ঈদে বাড়ি যাওয়ার জন্য একটু বেশি ছুটি পেয়েছি, তাই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আগেভাগেই বাড়ি যেতে চাই। যে কারণে শত ভোগান্তি ভুলে সেহরির পর থেকে লাইনে অপেক্ষা করছি। ঈদের সময় একেক জনের কাছে কাঙ্ক্ষিত টিকিট মানেই সোনার হরিণ। রাজশাহীগামী বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেনের তিনটি টিকিট যদি পেয়ে যাই তাহলে ওই টিকিটগুলোই আমার কাছে হবে সোনার হরিণ।
লাইনে দাঁড়ানো অবস্থায় আরেকজনকে মোবাইলে রেলওয়ের ই-টিকিট ওয়েবসাইটে ব্রাউজ করতে দেখা গেল। টিকিট কাউন্টারে তার সিরিয়াল প্রথম ১৫ থেকে ২০ জনের পরেই। আলাপকালে জানালেন তার নাম সাইফুল আলম। তিনি মধ্যরাতে কমলাপুরে টিকিট কাউন্টারে লাইনে দাঁড়িয়েছেন, সেহরিও করেছেন লাইনে বসে থেকে।
সাইফুল আলম বলেন, ২৭ তারিখের টিকিটের জন্য কেউ কেউ ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। সারারাত আশপাশের মানুষের সঙ্গে আলাপ করে, মোবাইল ব্রাউজ করে সময় কাটিয়েছি। বাসা থেকে পত্রিকা এনেছি, সেটা বিছিয়ে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যেহেতু কাউন্টারের পাশাপাশি অনলাইনেও টিকিট দেবে তাই মোবাইলে ওয়েবসাইটে ঢুকে রেডি হয়ে আছি। কারণ সিরিয়ালে দাঁড়ানোর পাশাপাশি যেন অনলাইনেও চেষ্টা করতে পারি।
কমলাপুরের কাউন্টারগুলোর পশ্চিম দিকের শেষের কাউন্টারটি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে নারীদের জন্য। সেই কাউন্টারে রংপুর এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিটের জন্য অপেক্ষমাণ টিকিটপ্রত্যাশী রেহেনা খাতুন জানান, তিনি ও তার স্বামী সেহেরি খেয়ে টিকিটের লাইনে এসে দাঁড়িয়েছেন।
স্বামীর পাশাপাশি তিনিও লাইনে দাঁড়ানোর কারণ হিসেবে তিনি জানান, নারীদের লাইনে মানুষের সংখ্যা সাধারণত একটু কম থাকে। তাই টিকিট পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি, ফলে দুজনই দাঁড়িয়েছেন যার ভাগ্যে আগে টিকিট জোটে।
রেহেনা খাতুন বলেন, রংপুর অনেক দূরের জেলা, সড়ক পথে যেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এছাড়া ঈদের সময় সড়কে থাকে তীব্র যানজট। তাই সব কষ্ট, ভোগান্তি ভুলে ঈদের ট্রেনের টিকিটের জন্য সেহরি খেয়েই লাইনে এসে দাঁড়িয়েছি। সবাই যেহেতু ট্রেনেই যেতে চায়, তাই টিকিটের লাইনও অনেক লম্বা। জানি না এত ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও শেষ পর্যন্ত টিকিট পাব কি না।
অগ্রিম টিকিট বিক্রির বিষয়ে কমলাপুর স্টেশন ম্যানেজার মাসুদ সারওয়ার জানিয়েছেন, অগ্রিম টিকিট বিক্রির সব প্রস্তুতি আমরা শেষ করেছি। আশা করছি সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিবেশে সুশৃঙ্খলভাবে টিকিট বিক্রি শুরু হবে। কাউন্টারের পাশাপাশি অনলাইনে ৫০ শতাংশ টিকিট বিক্রি হবে। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে যতক্ষণ টিকিট থাকবে যাত্রীরা টিকিট পাবেন। সার্বিক পরিস্থিতি ভালো রাখতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন। আমরা সার্বিক চেষ্টা করছি যাত্রীরা যেন নির্বিঘ্নে টিকিট পেতে পারেন।
বাংলাদেশ রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, ঈদের ৭ দিন আগে অর্থাৎ আগামী ২৫ এপ্রিল থেকে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত কোনো আন্তঃনগরের কোনো ট্রেনের অফ-ডে থাকবে না এবং ঈদের পরে যথারীতি অফ-ডে কার্যকর করা হবে। অফ-ডে প্রত্যাহারের ফলে অতিরিক্ত ৯২টি আন্তঃনগর ট্রেন বিশেষ ট্রিপে পরিচালিত হবে।
ঈদ যাত্রার বিশেষ ট্রেনগুলোর মধ্যে চাঁদপুর স্পেশাল ১ ও ২ ট্রেন চট্টগ্রাম-চাঁদপুর-চট্টগ্রাম রুটে ঈদের আগে ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে এবং ঈদের পর ৪ মে থেকে ৮ মে পর্যন্ত চলবে। আর দেওয়ানগঞ্জ স্পেশাল ট্রেন ঢাকা-দেওয়ানগঞ্জ-ঢাকা রুটে ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে এবং ঈদের পর ৪ মে থেকে ৮ মে পর্যন্ত চলবে। খুলনা স্পেশাল (মৈত্রী রেক দিয়ে) খুলনা-ঢাকা-খুলনা রুটে ২৯ এপ্রিল থেকে ১ মে পর্যন্ত চলবে। শোলাকিয়া স্পেশাল-১ ট্রেন ভৈরববাজার-কিশোরগঞ্জ-ভৈরববাজার রুটে এবং শোলাকিয়া স্পেশাল-২ ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ-ময়মনসিংহ রুটে শুধুমাত্র ঈদের দিন চলবে।
এবার ‘টিকিট যার, ভ্রমণ তার’ এই স্লোগান বাস্তবায়নে যাত্রীদের এনআইডির ফটোকপি কাউন্টারে দেখিয়ে টিকিট কিনতে হবে। এনআইডি ছাড়া অন্য কোনো পরিচয়পত্র দিয়ে ট্রেনের টিকিট কাটা যাবে না।
এদিকে অগ্রিম টিকিট কিনতে কমলাপুর রেলস্টেশনে যাত্রী চাপ কমাতে রাজধানীর পাঁচটি কেন্দ্র থেকে নির্দিষ্ট রুটের টিকিট বিক্রি করা হবে। এগুলোর মধ্যে কমলাপুর থেকে সমগ্র পশ্চিমাঞ্চলগামী ও খুলনাগামী স্পেশাল ট্রেনের টিকিট; বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী সব আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট; তেজগাঁও থেকে ময়মনসিংহ, জামালপুরগামী ও দেওয়ানগঞ্জ স্পেশালসহ সব আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট; ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জগামী মোহন ও হাওড় এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকিট এবং ফুলবাড়িয়া (পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন) থেকে সিলেট ও কিশোরগঞ্জগামী সব আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট বিক্রি করা হবে।
এএসএস/আইএসএইচ/এসএসএইচ