কাজী মোহাম্মদ আলী। কখনও নাস্তা খরচ, কখনও গাড়ি ভাড়া বাঁচিয়ে ১০, ২০, ৫০, ১০০ করে টাকা জমিয়েছেন টিনের কৌটায়, মাটির ব্যাংকে। টাকার অংক বড় হলে এক সময় জমা রাখেন ব্যাংকে। ৪০ বছরে তিলে তিলে জমিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা। আর সেই টাকা তুলে দিয়েছেন ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য।

সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকে ওয়াক্ফ হিসাব খুলে ৫০ লাখ টাকা জমা করে রেখেছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতির নামে। সম্প্রতি পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওয়াক্ফ হিসাবের কাগজপত্র তাদের কাছে হস্তান্তর করেন কাজী মোহাম্মদ আলী। ওয়াক্ফ হিসাবের মূল টাকা ব্যাংক থেকে তুলতে পারবেন না মোহাম্মদ আলী বা তার স্বজন, এমনকি রোগী কল্যাণ সমিতিও। কেবল বছর শেষে মুনাফা পাবে সমিতি। বছর শেষে সেখান থেকে পাওয়া যাবে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা। আর এই টাকা ব্যয় করতে পারবে ১৮ বছরের নিচের ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুর চিকিৎসায়। মুনাফার টাকা তোলা যাবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ও সাধারণ সম্পাদকের স্বাক্ষরে।

বুধবার (২০ এপ্রিল) কাজী মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে কথা হয় ঢাকা পোস্টের। প্রায় ২০ মিনিটের আলাপচারিতায় কথা হয় টাকা জমানো ও তা ব্যয়ের প্রসঙ্গে। উঠে এসেছে ব্যক্তিগত নানা বিষয়ও।

আলাপের শুরুতে কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, ৫০ লাখ টাকা রোগীদের কল্যাণে দিতে পেরে অর্ধেক আশা পূরণ হয়েছে। আমার টাকার সুবিধা নিয়ে কোনো শিশু যদি সুস্থ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যায় তাহলে বাকি অর্ধেক সন্তুষ্ট হব। জীবিত থেকে এটা দেখে যাওয়ার অনেক ইচ্ছা।

তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বড় হয়েছি। দুঃখ, কষ্ট, দুর্দশা নিজের চোখেই দেখা। সেখান থেকেই আমার ভেতর একটা ইচ্ছা ছিল, ভবিষ্যতে পড়াশোনা করে চাকরি করে টাকা-পয়সা আয় করব। আর ইচ্ছা ছিল আমি এমনভাবে চলব যাতে টাকা পয়সা সেভ (জমা) করতে পারি, এমন লক্ষ্য ছিল আমার।

‘আমাদের ছয় ভাই, তিন বোনের সংসার ছিল। বাবা রেলওয়েতে চাকরি করতেন। বাবা যে বেতনে চাকরি করতেন তাতে আমাদের ১১ জনের সংসার টানাহেঁচড়া করে চলত। তখনই আমার কষ্ট লাগত। বাবাকে মাসের শেষে টাকা ধারকর্জ করতে হতো। এসব দেখে নিজের মনে দাগ কেটে ছিল। তখন থেকেই চিন্তা ছিল টাকা আয় করার সঙ্গে সঙ্গে টাকা জমানোর।’

তিনি বলেন, গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর চিন্তা করলাম চাকরি করব। ২৩ বছর বয়সে চাকরি পেলাম। ১৯৬৬ সালে বেসরকারি ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিলাম। প্রথমে ফাইজার কোম্পানিতে বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলাম। পরে তা রেনেটা হয়।

কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, আমার কাজ ছিল ডাক্তারদের সঙ্গে প্রোডাক্ট প্রমোশন করা। আমার কর্মস্থল ছিল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ। যে কারণে প্রতিদিনই ডাক্তার ও রোগীদের সঙ্গে আমার দেখা হতো। দেখতাম অনেক গরিব, দুস্থ রোগী চিকিৎসার অভাবে কষ্ট পাচ্ছে। চিকিৎসার অভাবে ভালো হচ্ছে না। তখনই গরিব রোগীদের সাধ্যমতো ওষুধ দিতাম। অনেক সময় কোম্পানির কাছ থেকে খুঁজে নিয়েও ওষুধ দিতাম গরিব রোগীদের। এতে কেউ কেউ হাসি মুখে বাড়ি যেত। আবার অনেক রোগীকে দেখতাম ঠিক মতো ওষুধ না পেয়ে হাসপাতালেই দিনের পর দিন ভর্তি থাকতে। এসব বিষয় আমার মনে দাগ কেটেছে। তখন চিন্তা করলাম তাদের জন্য টাকা জমিয়ে কিছু করার। তারপর টাকা জমানো শুরু করলাম।

‘১৯৮০ সাল থেকে আলাদা টাকা জমানো শুরু করেছি। একটা টিনের বাক্সে, একটি আইসক্রিমের কোটায় টাকা জমানো শুরু করি। প্রথমে ১০, ২০, ৫০, ৬০, ১০০, ২০০ টাকা করে টিনের কোটায় রাখতাম।’

তিনি বলেন, বেতনে ভালো টাকা পেতাম। তা দিয়ে আমার সংসার চলত। এছাড়া আমি বোনাস, ইনসেন্টিভ, কনভিন্স ও বিনোদনের জন্য টাকা পেতাম। সেগুলো থেকে টাকা সেভ করে টিনের বক্সে রাখতাম। আমাকে রিকশা ভাড়া দেওয়া হতো অফিস থেকে, কিন্তু আমি হেঁটে যেতাম। সেখানে আমার টাকা সেভ হতো। সেই টাকা সেভ করে দীর্ঘদিন ধরে সঞ্চয় করলাম। ভালো অংকের একটা টাকা হলো। তারপর চিন্তা করলাম গরিব বাচ্চাদের জন্য কিছু একটা করার।

টাকার অংক বড় হতে লাগল, আর আমার চাকরি থেকে অবসরেরও সময় হতে লাগল। তখন আমি টার্গেট ঠিক করলাম। কেননা জীবনের প্রথমে টার্গেট ঠিক করতে হবে। জীবনে অর্জন কীভাবে করবেন তার পরিকল্পনা করতে হবে। এরপর টার্গেট ফিল হলে কাজে লাগাতে পারবেন। এটা নিজে কাজ করার সময় শিখছি, যোগ করেন তিনি।

১৯৪৩ সালের ১ মে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করা কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, ২০০০ সালে যখন বড় একটির অংকের টাকা হলো তা মা ও বাবার নামে ‘কাজী অ্যান্ড হোসনা ফাউন্ডেশন’ নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে জমা করি। সেখানে টাকা জমা রাখলে কিছু প্রফিট পাব, আর টাকাটাও বাড়বে। সেই চিন্তা থেকে টাকা জমা রাখলাম।

টাকার সঞ্চয় বাড়ানোর জন্য ভিন্ন পন্থাও অবলম্বন করতেন মোহাম্মদ আলী। ব্যাংক থেকে যে পরিমাণ প্রফিট দিত, সেই মুনাফায় পরিচিত গরিব-মধ্যবিত্ত ব্যবসায়ীদের টাকা ধার দিতেন। পরে তারা মুনাফাসহ আসল টাকা ফেরত দিলে তা ওই ফাউন্ডেশনের হিসাবে জমা করতেন ভবিষ্যতে দান করবেন বলে।

তিনি বলেন, এভাবে টাকা জমাতে জমাতে ৫০ লাখ টাকা হলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিলাম টাকাটা ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীদের দেব। সিদ্ধান্ত নিলাম টাকা ক্যান্সার আক্রান্ত বড় রোগীদের না দিয়ে ১৮ বছরের নিচের শিশুদের দেব। কারণ বড়রা ক্যান্সার আক্রান্ত হলে বেশি দিন বাঁচে না। এছাড়া বড়দের নিজস্ব আয় থাকে, যা দিয়ে তারা নিজেরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে পারবে। কিন্তু একটা ছোট বাচ্চা ক্যান্সার আক্রান্ত হলে অনেক গরিব পরিবার চিকিৎসা করাতে পারে না। তাছাড়া কেউ চিকিৎসায় ভালো হলে পুরো পরিবারকে দেখতে পারবে।

চিকিৎসকদের কাছে বাচ্চাদের ক্যান্সার নিরাময়যোগ্য শুনেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, বাচ্চাদের মধ্যে ৯০ শতাংশই সুস্থ হয়ে যায়। আমি মনে করলাম একটা বাচ্চা যদি আমার জমানো টাকা দিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ হয়ে পরিবারের কাছে ফিরে যায়, স্কুল, কলেজে যায়, চাকরি করে তাহলেই আমার জীবনটা সার্থক হবে।

‘টাকাটা রোগী কল্যাণ সমিতিতে দিয়ে আমার ৫০ শতাংশ অর্জন হয়েছে। রোগী কল্যাণ সমিতিকে ৫০ লাখ টাকা ওয়াক্ফ অ্যাকাউন্ট করে দিয়েছি। সেখান থেকে বার্ষিক প্রফিট আসবে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা। সেই টাকা শিশুদের চিকিৎসায় ব্যয় করতে পারবে। আর ব্যাংকে রাখা ৫০ লাখ টাকা আমার পরিবার, রোগী কল্যাণ সমিতি কেউ তুলতে পারবে না। কিন্তু প্রতি বছরের প্রফিট তুলে চিকিৎসা করতে পারবে। আর ব্যাংক থেকে চমকে হাসপাতালের পরিচালক ও রোগী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদকের সামনে টাকাটা তুলতে পারবে। চমেকের ক্যান্সার বিভাগের চিকিৎসক যদি তাদের বলে কোনো শিশুর চিকিৎসার জন্য টাকা দরকার, তখন তারা টাকা তুলে চিকিৎসার জন্য দিতে পারবে।

কাজী মোহাম্মদ আলী বলেন, এখন আমার রুল হচ্ছে আমি মাঝে মধ্যে গিয়ে দেখতে পারব কোন বাচ্চাকে টাকাটা দেওয়া হয়েছে, তার চিকিৎসা হচ্ছে কি না। আমার এখন প্রধান ইচ্ছা হচ্ছে আমি জীবিত থাকা অবস্থায় যেন দেখে যেতে পারি আমার জমানো টাকায় শিশুর চিকিৎসা চলছে। শিশুরা ভালো চিকিৎসা পেয়ে মা-বাবার কাছে ফিরে গিলে পুরোপুরি সন্তুষ্টি আসবে। এরপর শিশুরা যখন সুস্থ হয়ে চাকরি করবে তা আমার নাতিপুতিরা দেখবে।

৮০ বছরের এই বৃদ্ধ বলেন, গত বছর ব্যাংকে ৫০ লাখ টাকা ডিপোজিট করলেও এ বছরের ২৭ মার্চ রোগী কল্যাণ সমিতিকে কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়েছি। অলরেডি এক বছরের প্রফিট অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। ইচ্ছে করলে যেকোনো মুহূর্তে একটি বাচ্চার চিকিৎসা শুরু করতে পারবে। আমি চাই একটা বাচ্চার চিকিৎসা শুরু হোক।

তিনি বলেন, আমি যখন চাকরি করি তখন আমার নানা ক্যান্সারে মারা যান, তারপর আজ থেকে ৪০ বছর আগে মা মারা গেছেন ক্যান্সারে। আর চার বছর আগে ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন আমার ছোট বোনের মেয়ে। সে কারণে ক্যান্সারের প্রতি আমার একটা বেদনা ছিল। বিশেষ করে মা ক্যান্সারে মারা গেছেন। সেখানে যদি আমি সেই ক্যান্সার রোগীদের জন্য কিছু করতে পারি, তাহলে আমার জীবনটা সার্থক হবে। বাচ্চাদের ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে সুস্থতার হার বেশি ও ক্যান্সারের চিকিৎসা খুব ব্যয়বহুল। যা গরিব বাচ্চাদের পরিবারের জন্য বহন করা কষ্টকর। তাই আমার জমানো ৫০ লাখ টাকা ক্যান্সার আক্রান্ত শিশুদের চিকিৎসার জন্য দান করেছি।

‘মানুষ আমার প্রশংসা করছে। তা নিয়ে এখন আমার পরিবারের সদস্যরা গর্ববোধ করছে। প্রথমে যখন পরিবারের সদস্যদের ৫০ লাখ টাকা ক্যান্সার আক্রান্তদের দেওয়ার কথা জানাই, তখন তারা কিছুটা অবাক হয়েছিল। কারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে এটা বড় অ্যামাউন্ট। পরে পরিবারের সদস্যদের বুঝালাম। এখন সবাই আমার এ কাজের প্রশংসা করছে। পরিবারের সদস্যরাও এখন গর্ববোধ করছে। এখন বলছে আমি সঠিক জায়গায় সঠিক কাজ করছি।’

তিনি আরও বলেন, আমি এখনও মিতব্যয়ী। অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে চাই না। এখনও সময় পেলে তিন-চার কিলোমিটার হেঁটে চলে যায়। প্রয়োজনে বাসে চলি, তারপরও রিকশা-সিএনজিতে চড়ি না। আমি যে পরিবার থেকে এসেছি, সেভাবেই চলছি। মিতব্যয়ী ছিলাম বলেই ৫০ লাখ টাকা জমাতে পরেছি।

কাজী মোহাম্মদ আলীর দুই সন্তানের জনক। তার ছেলেরা ব্যবসা করছেন। ২০০৫ সালে বিক্রয় ব্যবস্থাপক পদ থেকে অবসরে যান তিনি। বর্তমানে থাকছেন চট্টগ্রাম নগরের মুরাদপুরের হামজারবাগ এলাকার পৈতৃক বাড়িতে।

কাজী মোহাম্মদ আলীর এমন উদ্যোগে খুশি ছেলে ও তার ভাইয়েরা। ছেলে কাজী খালেদ মাহমুদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, টাকা জমানোর কথাটা আমরাও জানতাম না। টাকা দেওয়ার কিছুদিন আগে এটা নিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলেছেন বাবা। আমরা প্রথমে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। এখন খুবই ভালো লাগছে। এ উদ্যোগের জন্য বাবাকে ধন্যবাদ জানাই। আমরাও বাবার এ কাজের জন্য গর্ববোধ করতে পারছি। আমার পরিবারের সবাই খুশি।

মোহাম্মদ আলীর ছোট ভাই কাজী রাশেদ আলী জাহাঙ্গীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, মানবসেবা সবার কপালে জোটে না। ভাই নিঃস্বার্থভাবে দান করেছেন। কোন প্রতিদান ছাড়া তিনি এ উদ্যোগ নিয়েছেন। আমরা গর্বিত। এ দান থেকে মানুষ সেবা পেলে আরও আনন্দিত হব।

ভাতিজি জাসিয়াতুল নাজিফা ঢাকা পোস্টকে বলেন, বড় আব্বুর দানে আমরা গর্বিত। আমরা নতুন প্রজন্ম উনার থেকে শিক্ষা পাই। আমিত্ব থেকে বের হয়ে মানবসেবা করার শিক্ষাটা উনার থেকে পাওয়া আমাদের। আমরা চমকে গিয়েছিলাম প্রথমে। এত বড় একটা কাজ, আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। উনার এ কাজের জন্য আমরা গর্বিত।

জানতে চাইলে চমেকের রোগী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক অভিজিৎ সাহা বলেন, যখন শুনলাম ৫০ লাখ টাকা, তখন আমরাও আশ্চর্য হয়েছি। তার মানবিকতা অন্যদের জন্য একটা উদাহরণ হতে পারে।

কেএম/এসএসএইচ