বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রকল্পটিতে পরামর্শক প্রতিষ্ঠানই নিয়োগ দেওয়া যায়নি। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভারতীয় ঋণে নেওয়া এই প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগে সে দেশের এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদন দরকার। এই অনুমোদন দিতে তারা অনেক দেরি করেছে। তদের সঙ্গে চিঠি চালাচালিতেই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের ‘খুলনা থেকে দর্শনা জংশন সেকশনে ডাবল লাইন রেলপথ নির্মাণ’ শীর্ষক প্রকল্পের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটেছে।

এ প্রকল্পের প্রধান কার্যক্রম হচ্ছে- খুলনা হতে দর্শনা জংশন পর্যন্ত আনুষঙ্গিক কাজসহ ১২৬.২৫ কিলোমিটার ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ এবং ১৪.৪০ কিলোমিটার ব্রডগেজ লুপলাইন ট্র্যাক নির্মাণ। এছাড়া ১৬টি স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ, ১৪৭টি ব্রিজ নির্মাণ (গার্ডার ব্রিজ ৪টি এবং বক্স কালভার্ট ১৪৩টি), ৩৭টি প্ল্যাটফর্ম নির্মাণ ও পুনর্নির্মাণ (নতুন ২৫টি এবং পুনর্বাসন ১২টি), ২০টি প্ল্যাটফর্ম শেড নির্মাণ (নতুন ১৭টি এবং পুনর্বাসন ৩টি), ১৭টি ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ, ১৮টি কম্পিউটার বেইজড সিগন্যালিং সিস্টেম স্থাপন এবং ১১০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করার কথা রয়েছে। 

প্রকল্পটি নিয়ে গত ১ মার্চ রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে প্রজেক্ট স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর সভাপতিত্ব করেন। সম্প্রতি সভার কার্যবিবরণী পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছে রেল মন্ত্রণালয়। 

পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, পিএসসি সভায় রেল সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীরকে প্রকল্প পরিচালক জানান, ‘প্রকল্পের পরামর্শক নিয়োগের বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি গ্রহণে দীর্ঘ সময় লেগেছে এবং চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে। এজন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুবিধার্থে মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন।’

সভায় জানানো হয়, ইতোমধ্যে প্রায় ৩ বছর ১০ মাস অতিবাহিত হয়েছে। এখনও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতি গ্রহণে সময় কম লাগলে প্রকল্প বাস্তবায়ন সহজ হতো। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের মাধ্যমে এই বিষয়টি সুরাহা করার লক্ষ্যে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা প্রয়োজন।

পিএসসি সভার সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে- নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করা সম্ভব নয় বিধায় প্রকল্পের মেয়াদ এক বছর বৃদ্ধি করতে হবে। দ্রুত পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত করার জন্য প্রকল্প পরিচালককে সচেষ্ট থাকতে হবে।

প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এই প্রকল্পটি এলওসি ঋণের প্রকল্প। এলওসির প্রকল্পে এমনিতে প্রসিডিউরাল সময় বেশি লাগে। এই প্রকল্পের দুটি পার্ট। প্রথম পার্টে ছিল ফিজিবিলিটি স্টাডি, ডিটেইল ডিজাইন এবং টেন্ডারিং সার্ভিস। দ্বিতীয় পার্টে হলো বাস্তবায়ন।’

তিনি বলেন, ‘প্রথম পার্টে আমাদের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করার কথা। যেটাতে আমাদের তিনবার ইওআই কল করতে হয়েছে। এই তিনবার ইওআই কল করারও অনেকগুলো কারণ আছে। প্রথমবার পর্যাপ্ত বিডার পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয়বার একই সমস্যাতে পড়তে হয়েছে। আর তৃতীয়বার এলওসির শর্ত নিয়ে ভারতের সঙ্গে কথা বলতে প্রায় এক বছর সময় চলে গেছে। সবকিছু মিলিয়ে প্রকল্পটি একটু দেরি হয়ে গেছে।’ 

প্রকল্প পরিচালক আরও বলেন, ‘আশার কথা হলো এখন সবকিছু এড্রেস করে পরামর্শক নিয়োগের জন্য পারচেজ প্রপোজাল সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত কমিটিতে আছে। আমরা আশা করছি, এ সপ্তাহে না হলেও পরের সপ্তাহে পারচেজে অনুমোদন হবে। ক্রয় কমিটিতে অনুমোদন পেলেই আমরা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করতে পারব।’

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক পরামর্শক নিয়োগে কেন অনুমতি দিচ্ছে না, এর কারণ বের করতে হবে। বৈদেশিক ঋণের আওতায় আমরা ভারত থেকে খুবই অল্প মাত্রার ঋণ পাই। এই চিহ্নিত প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন না হওয়ায় সাধারণ জনগণ এর উপকার পাবে না।’

এরকম ঋণ বাংলাদেশকে নেওয়া উচিত কি না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই ঋণের পরিমাণ খুবই সামান্য। সময় মতো ঋণের টাকা না পেলে ঋণ বাদ দিয়ে নিজেদের অর্থায়ন বা অন্য কোনো সোর্স থেকে টাকা এনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। যেকোনো ঋণের ক্ষেত্রে অর্থ ছাড়ের আশঙ্কা তৈরি হলে অন্যান্য দেশের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন করতে হবে। আমার মতে এই তিন বছর সময় নষ্ট করার কোনো মানে নেই। প্রকল্প কর্তৃপক্ষ সর্বোচ্চ ছয় মাস থেকে এক বছরের মধ্যে ঋণের টাকা পেলে নেবে, নতুবা অন্য উপায় খুঁজবে। তাহলে অনেক প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।’

ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে দীর্ঘ চিঠি চালাচালি

প্রকল্প পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী জানান, ‘একনেক সভায় অনুমোদনের পর ২০১৮ সালের ১০ মে এই প্রকল্পের আওতায় প্রথমবার পরামর্শক নিয়োগে আগ্রহ প্রকাশের জন্য অনুরোধ (ইওআই) টেন্ডার নোটিশ প্রকাশ করা হয়। যা একই বছরের ২৬ জুলাই উন্মুক্ত করা হয়। মূল্যায়নের পর ২টি মাত্র প্রতিষ্ঠান শর্টলিস্টেড হওয়ায় ১৯ আগস্ট এটি বাতিলের সুপারিশ করা হয়। ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতিতে ২য় বার ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর ইওআই নোটিশ প্রকাশ করা হয়, যা ১৩ নভেম্বর উন্মুক্ত করা হয়। মূল্যায়নের পর ৩টি প্রতিষ্ঠানকে শর্টলিস্টেড করে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক-এর সম্মতির জন্য পাঠানো হয় ২০১৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি। তাতে সম্মতি না দিয়ে পুনরায় ইওআই নোটিশ জারির অনুরোধ করে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। এরপর ওই বছরের ২৫ মে খসড়া ইওআই নোটিশ ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়। বিভিন্ন দফায় আলোচনা ও পত্র যোগাযোগের পর ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারি ইওআই নোটিশে সম্মতি দেওয়া হয়। পরে ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পুনরায় ইওআই নোটিশ প্রকাশ করা হয়, যা ওই বছরের ৮ মার্চ উন্মুক্ত করা হয়। মূল্যায়নের পর ৫টি প্রতিষ্ঠানকে শর্টলিস্টেড করা হয়, যাতে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক সম্মতি দেয়।’

পিডি আরও জানান, ‘এক্সিম ব্যাংকের সম্মতির পর ২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর শর্টলিস্টেড হওয়া পরামর্শকদের আরএফপি ডকুমেন্ট দাখিলের জন্য বলা হয়, যা ১০ ডিসেম্বর উন্মুক্ত করা হয়। পিএসসি কর্তৃক মূল্যায়ন করে ২০২১ সালের ৩১ মার্চ ভারতীয় এক্সিম ব্যাংকের অনুমোদনের জন্য পাঠানো হলে ২ জুন কিছু পর্যবেক্ষণসহ তারা ফেরত দেয়। পর্যবেক্ষণ মোতাবেক পুনরায় ২৭ জুন প্রেরণ করা হলে ৩ জুলাই তারা সম্মতি দেয়। এরপর ২০২১ সালের ১৯ জুলাই ফিন্যানসিয়াল অফার উন্মুক্ত করা হয় এবং ১০ নভেম্বর নেগোসিয়েশন সভা অনুষ্ঠিত হয়।’ 

এসআর/এসএম