অর্থ আত্মসাৎ ও সন্দেহজনক লেনদেনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের (কেজিডিএসএল) নিবন্ধিত ঠিকাদার, মেসার্স রক প্রপার্টিজ ও মেসার্স মেটকো কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেছার আহমদকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত।

বুধবার (৩০ মার্চ) চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমানের  আদালতে আত্মসমর্পণ  করে জামিন চান নেছার আহমদ। আদালত জামিন আবেদন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) কাজী ছানোয়ার আহমেদ লাভলু।

তিনি বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশে আজ মহানগর দায়রা জজ আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চান নেছার আহমদ। আদালত শুনানি শেষে আসামিকে জামিন না দিয়ে কারাগারে পাঠিয়েছেন। তিনি ওই মামলার তিন নম্বর আসামি। মামলার বাকি তিন আসামি পলাতক  রয়েছেন।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ ফেব্রুয়ারি দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয় চট্টগ্রাম-১ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ৪ ( ২) ধারাসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক উপমহাব্যবস্থাপক আনিছ উদ্দিন আহমেদ ও তার স্ত্রী ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের চেয়ারম্যান কামরুন নাহার ওরফে পলি, মেসার্স রক প্রপার্টিজ ও মেসার্স মেটকো কনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নেছার আহমদ এবং নিবন্ধিত ঠিকাদার ও মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের স্বত্বাধিকারী নুর মোহাম্মদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন, ২০০৬ এর ৬৪ (৩) ও ৬৩ (৪) ধারা লঙ্ঘন করে নুর সিন্ডিকেট নামক প্রতিষ্ঠানের আড়ালে রক প্রপার্টিজ নামের প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ পাইয়ে দেয় এবং নির্মাণ কাজের পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকা আত্মসাৎ করেন। এছাড়া তারা যৌথ ও একক ব্যাংক হিসাব খুলে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর সম্পৃক্ত অপরাধ ‘দুর্নীতি ও ঘুষ’-এর মাধ্যমে অপরাধলব্ধ অর্থ হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরপূর্বক নয় কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করেন।

ঘটনার বিবরণে বলা হয়, ২০১১ সালের ২১ আগস্ট কর্ণফুলী গ্যাসের তৎকালীন ব্যবস্থাপক (পুর-নির্মাণ) আনিছ উদ্দিন সরকারি কর্মচারী হয়েও সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে কর্ণফুলী গ্যাসের নিবন্ধিত ঠিকাদার মেসার্স মেটকো কনস্ট্রাকশনের স্বত্বাধিকারী নেছার আহমদ ও স্ত্রী কামরুন নাহারকে নিয়ে রক প্রপার্টিজ নামে একটি ডেভেলপার কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি মেসার্স নুর সিন্ডিকেটের সঙ্গে দরপত্র পরিচালনা ও নির্মাণকাজের চুক্তি করেন।

চুক্তিতে উল্লেখ ছিল যে, কর্ণফুলী গ্যাসের চাঁদগাঁওয়ের আবাসিক এলাকায় একটি দশতলা ভবনের দরপত্রে অংশগ্রহণ ও নির্মাণকাজের বিল বাবদ পাওয়া অর্থ থেকে নুর সিন্ডিকেটকে দেড় শতাংশ কমিশন দেওয়া হবে। কাজ শেষে চুক্তিমতো নিজের দেড় শতাংশ হারে কমিশন রেখে বাকি টাকা আনিছ আহমেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান রক প্রপার্টিজের ব্যাংক হিসাবে হস্তান্তর করা হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ঠিকাদার নিয়োগের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এ জন্য ২০১২ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত তিনটি জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকা এবং সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়।

একই বছরের ১২ নভেম্বর দরপ্রস্তাব গৃহীত হলে দেখা যায়, ফোর স্টার সিন্ডিকেট নামে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠান দরপত্র দাখিল করে। তাদের কাগজপত্র ঠিক না থাকায় সেটি বাতিল হয় ও পরবর্তীতে ২৮ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনটি পত্রিকায় পুনরায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়।

ওই বছরের ১৮ ডিসেম্বর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটির বৈঠকে সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে মেসার্স নুর সিন্ডিকেটেকে নির্বাচন করে কার্যাদেশ প্রদানের সুপারিশ করা হয়। ৩০ ডিসেম্বর কার্য সম্পাদনের জন্য নুর সিন্ডিকেটের পক্ষে নুর মোহাম্মদ ও মেসার্স রক প্রপার্টিজের পক্ষে পরিচালক নেছার আহমদ চুক্তিপত্র সই করেন।

অনুসন্ধানে রেকর্ডপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আনিছ উদ্দিন আহমেদের স্ত্রী কামরুন নাহার কর্তৃক যেসব ব্যাংক হিসাব খোলা হয়েছে, সেগুলোতে আয়ের উৎস হিসেবে স্বামীর আয় এবং পেশা গৃহিণী উল্লেখ রয়েছে।  ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকা ব্যাংকের চট্টগ্রাম সিডিএ এভিনিউ শাখায় আনিছ উদ্দিন, কামরুন নাহার ও নেছার আহমদের নামে রক প্রপার্টিজ নামে একটি চলতি হিসাব খোলা হয়। ওই হিসাবের মাধ্যমে ২০১৫ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ৪ কোটি ৯৫ লাখ ৭৮ হাজার ৭১৫ টাকার সন্দেহজনক লেনদেন করা হয়। বর্তমানে কামরুন নাহারের ছয়টি ব্যাংক হিসাবে মোট এক কোটি ৭৫ লাখ ৮৪ হাজার ৯৪৪ টাকা রয়েছে, যা অবরুদ্ধকরণের (ফ্রিজ) প্রক্রিয়ায় রয়েছে।

এছাড়া, আনিছ উদ্দিন ও নেছার আহমদের একটি যৌথ হিসাবে নয় লাখ ৩৫ হাজার টাকা জমা করে উত্তোলন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে আসামিদের সর্বমোট নয় কোটি ৯৩ লাখ ১৬ হাজার ৮৭৭ টাকার সন্দেহজনক লেনদেনের বিষয়টি প্রমাণিত হয়েছে। আর অসৎ উপায়ে কাজ পাইয়ে দিয়ে পাঁচ লাখ ৮৬ হাজার ৬৫৩ টাকা আত্মসাৎ করে আনিছ উদ্দিন সিন্ডিকেট। আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা, মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২ এর ৪ (২) ধারাসহ ১৯৪৭ সনের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

কেএম/আরএইচ