মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশের সীমান্তে আসতে শুরু করেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট।

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো সহিংসতাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকা আশা করছে, যুক্তরাষ্ট্র মিয়ানমারের ওপর বেশি পরিমাণে চাপ দেবে। আর এতে করে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে গতি পাবে।

আজ মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে এসব কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন।

ড. মোমেন বলেন, ‘আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ, আমাদের বন্ধুপ্রতীম দেশের সেক্রেটারি অব স্টেট (মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী) অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর সহিংসতাকে গণহত্যার স্বীকৃতির ঘোষণা দিয়েছে। আমরা এটাকে স্বাগত জানাই। দেরিতে হলেও এটাকে আমরা স্বাগত জানাই। এটা ভালো সংবাদ।’

রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের ঘটনা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। সোমবার ওই সিদ্ধান্তেরই আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথম রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সহিংসতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিল।

আর এর ফলে বাংলাদেশের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে বলে মনে করছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এটা দেওয়ার ফলে আমাদের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। এর ফলে আইসিজেতে যে কেইস (মামলা) চলছে এটা আরও শক্তিশালী হতে পারে। গণহত্যার বিষয়টি যেহেতু তারা স্বীকার করেছে, আমার বিশ্বাস বড় দেশ হিসেবে তারা যদি পুশ করে বা প্রেশার (চাপ) দেয়, প্রত্যাবাসনে একটা সমাধান আসবে।’

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন। ফাইল ছবি। 

‘আমার মনে হয়, তারা অনেক বেশি চাপ প্রয়োগ করবে মিয়ানমার সরকারকে। এতে করে তারা (মিয়ানমার) লোকগুলোকে দেশে ফেরত নেবে। আমার ধারণা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) এ ব্যাপারে আরও সজাগ হবেন, যাতে মিয়ানমার থেকে বিতাড়িদের প্রত্যাবাসন হয়,’ বক্তব্যে যোগ করেন মোমেন।

মোমেন বলেন, ‘গণহত্যার স্বীকৃতির ফলে আমাদের অবস্থান শক্তিশালী হোক আর না হোক, কেউ যদি হিউম্যান রাইটস ভায়োলেশন করে; যদি এ ধরনের গণহত্যা করে, তারা যেন শাস্তি পায়। আমরা গণহত্যা চাই না। এগুলো বন্ধ করার একমাত্র উপায় স্বীকৃতি এবং শাস্তি দেওয়া। এ ধরনের গণহত্যা যেন আর কখনও না হয়।’

প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ধীরগতি করছে উল্লেখ করে মোমেন বলেন, ‘তারা (মিয়ানমার) কিন্তু কথা দিয়েছে, তারা বলেছে; নিয়ে যাবে, কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে ধীরগতি করছে। আমাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের যেন মঙ্গল হয় এবং তাদের একটা সুন্দর ভবিষ্যত যেন তারা গড়ে তুলতে পারে। আমরা আশা করব, তারা তাদের নিজেদের লোকগুলোকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিয়ে যাবে।’

বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবর্তন শুরু করতে পারলে মিয়ানমারের অপরাধ কিছুটা কমবে বলেও মনে করছেন ড. মোমেন। 

সু চি সরকারের গড়িমসি সেনাশাসনেও 
মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ঢল বাংলাদেশের সীমান্তে আসতে শুরু করেছিল ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট। সে সময় ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

লক্ষ লক্ষ রোহিঙ্গা কক্সবাজারের টেকনাফ এবং উখিয়ায় আশ্রয় নেয়। তাদের ফেরত পাঠানোর জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বারবার চেষ্টা করা হলেও মিয়ানমারের তরফ থেকে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি; যদিও মিয়ানমারে অং সান সু চি'র সরকারের সাথে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ চুক্তি সই করেছিল।

চুক্তি বাস্তবায়নে মিয়ানমারের সেই সরকারেও গড়িমসি ছিল। এরইমধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে দেশটিতে সেনাশাসন আসার পর পুরো প্রক্রিয়াতে আরও ধীরগতি আসে।  

মিয়ানমারে সামরিক সরকার যতদিন থাকবে, ততদিন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে দ্বিপাক্ষিকভাবে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া কতটা সম্ভব হবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। 

জাতিসংঘ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সেভাবে ভূমিকা রাখেনি বলেও অভিযোগ রয়েছে।  

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রাখাইনে গণধর্ষণ, হত্যা ও ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। 

যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতিতে কী হবে
মিয়ানমারে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের ওপর যে দমন-পীড়ন চলেছে যুক্তরাষ্ট্র যেন সেটিকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেয় বহুপক্ষেই সে দাবি জানিয়ে আসছিল।  বাইডেন প্রশাসনের আগে ট্রাম্প প্রশাসনের ওপরও এ ঘোষণা দেওয়ার জন্য চাপ দিয়েছিল মানবাধিকার সংগঠনগুলো। 

এখন মিয়ানমারের কর্মকাণ্ডকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করার অর্থ এই নয় যে দেশটির সামরিক শাসকদের ওপর নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে। তবে ২০১৭ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর দমন-পীড়ন শুরুর পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কিছু নিষেজ্ঞার মধ্যে রয়েছে মিয়ানমার।  

দ্য হেগে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল আরও আগেই। এখন যুক্তরাষ্ট্রও এটিকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করায় মিয়ানমার সরকারের ওপর আরও চাপ বাড়বে বলে মনে করা হচ্ছে। 

মানবাধিকার সংগঠন রিফিউজিস ইন্টারন্যাশনাল এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। সংগঠনটি এক বিবৃতিতে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ ঘোষণা খুবই অর্থবহ একটি পদক্ষেপ। 

এনআই/এনএফ