দেশের একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ পড়ার সময় দুই বন্ধু মশিউর ও রনি মিলে গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা শুরু করেন। রিজেক্টেড গার্মেন্ট পণ্য তারা বিক্রি করতেন নিউমার্কেটে। ২০১৯ সালে তারা ‘আকাশ নীল’ নামে একটি ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করেন। ট্রেড লাইসেন্সও নেন। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করেন। 

রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় অফিস নিয়ে প্রথমে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারির ব্যবসা শুরু করেন। করোনায় সুবিধা করতে না পেরে ক্ষতির সম্মুখীন হন। এরপর শুরু করেন প্রতারণামূলক ব্যবসা।

আকাশ নীলকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করেন দুই বন্ধু। ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মতো ডিসকাউন্ট অফারে মোটরসাইকেল বিক্রির রমরমা ব্যবসা শুরু করেন। তিন দফায় ৯ হাজারের বেশি গ্রাহককে আকৃষ্ট করে হাতিয়ে নেন প্রায় ৩২ কোটি টাকা।

আকাশ নীল-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর রহমান ও পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানায় র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)।

সোমবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে অবস্থিত র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করে র‌্যাব। সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গত ১৮ মার্চ এক ভুক্তভোগী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ‘আকাশ নীল’ এর এমডি ও ডিরেক্টরসহ ৯ জনের বিরুদ্ধে শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। আরও কয়েকজন ভুক্তভোগীও তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। এ পরিপ্রেক্ষিতে র‌্যাব গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায়।

এরই ধারাবাহিকতায় রোববার রাতে র‌্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-২ ও র‌্যাব-৮ এর যৌথ অভিযানে ফরিদপুর থেকে আকাশ নীলের এমডি মশিউর রহমান ওরফে সাদ্দাম (২৮) এবং পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান রনিকে (৩২) রাজধানী ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। অভিযানে উদ্ধার করা হয় দুটি মোবাইল ফোন, দুটি ল্যাপটপ ও একটি প্রাইভেটকার।

জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে কমান্ডার মঈন বলেন, আকাশ নীলের প্রতারণার মূলহোতা মশিউর। প্রথমে তার মাথায় ই-কমার্স ব্যবসার আইডিয়া আসে। তিনি অ্যামাজন, আলিবাবার মতো ব্যবসা করতে চান। এরপর ২০১৯ সালে আকাশ নীল কোম্পানি নামে ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ তৈরি করেন এবং ট্রেড লাইসেন্স নেন। প্রথমে তারা রাজধানীর কাঁঠালবাগান এলাকায় একটি অফিস নিয়ে নিত্যপণ্য এবং কৃষকদের কাছ থেকে শাকসবজি কিনে অনলাইনে হোম ডেলিভারি দেওয়ার ব্যবসা শুরু করে। তবে করোনা মহামারির কারণে ওই ব্যবসায় ক্ষতি হয়।

পরে মশিউর আকাশ নীলকে লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তরিত করে কাঁঠালবাগান থেকে পান্থপথে অফিস স্থানান্তর করেন। কোম্পানিটি ছিল পরিবারকেন্দ্রিক ব্যবসা, যাতে তার নিজের নামে ৭৭ শতাংশ, বোনের নামে ১০ শতাংশ, মায়ের নামে ৮ শতাংশ এবং স্ত্রীর নামে ৫ শতাংশ শেয়ার রাখেন। কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টরের চেয়ারে বসেন নিজেই। মাকে চেয়ারম্যান এবং তার বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচিত বন্ধু ইফতেখাইরুজ্জামান রনিকে বসান পরিচালকের আসনে।

ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের অফারে মোটরসাইকেলের রমরমা ব্যবসায় অনুপ্রাণিত হয়ে ২০২১ সালের জুন মাসে অফারে মোটরসাইকেল বিক্রির মাধ্যমে পুনরায় ব্যবসা শুরু করেন মশিউর। প্রথম ক্যাম্পেইনে ৩০ শতাংশ ছাড়ে দুই মাসের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে দুই শতাধিক মোটরসাইকেলের অর্ডার পান তারা।

দ্বিতীয় ক্যাম্পেইনে ২৫ শতাংশ ডিসকাউন্টে ৪৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির নিশ্চয়তায় এক হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার পায় আকাশ নীল। সর্বশেষ গত বছরের আগস্ট মাসে মোটরসাইকেলের তৃতীয় ক্যাম্পেইনে ২৩ শতাংশ ছাড়ে ২৫ দিনের মধ্যে ডেলিভারির আশ্বাসে ৯ হাজারের বেশি মোটরসাইকেলের অর্ডার পায় প্রতিষ্ঠানটি। পাশাপাশি মশিউর তার কোম্পানি থেকে লোভনীয় ছাড়ে দেন মোবাইল, ইলেকট্রনিক্স ও গৃহস্থালির অন্যান্য পণ্যের অফার।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ইভ্যালিসহ অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযানের ফলে গ্রাহকরা পণ্য অথবা টাকা রিফান্ডের জন্য চাপ দেওয়া শুরু করেন। গ্রাহকদের চাপে গত বছরের নভেম্বরে মশিউর অফিস বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যান।

কমান্ডার মঈন বলেন, তাদের অফার ব্যবসায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার গ্রাহক ছিল। তবে শেষ ক্যাম্পেইনে ছাত্র বা যুব সমাজের গ্রাহকরাই মোটরসাইকেলের অফারটি বেশি নেন। গ্রাহকদের টাকা সরাসরি মশিউরের নিজের ব্যাংক একাউন্টে জমা হতো। অন্যান্য ই-কমার্স ব্যবসার মতো গেটওয়ে সিস্টেম থাকলেও সরাসরি গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হতো। সরাসরি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে দেওয়া অর্থ নিয়েই তারা প্রতারণা করতেন।

গ্রেপ্তার হওয়া মশিউর ও রনিকে জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, আকাশ নীল লিমিটেড কোম্পানিতে প্রায় ৪০ জন অস্থায়ী কর্মচারী ছিল। যাদের মাসিক চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা বেতন দেওয়া হতো। গ্রাহকের টাকায় ধানমন্ডিতে তিন কোটি টাকায় একটি ফ্ল্যাট কেনেন মশিউর। তার রয়েছে ভিন্ন মডেলের দুটি দামি গাড়ি। এছাড়া তার কোম্পানির চারটি টাটা পিকআপ রয়েছে।

গ্রাহকের কাছে আকাশ নীলের দেনা প্রায় ৩২ কোটি টাকা

বর্তমানে গ্রাহকদের কাছে দেনা প্রায় ৩২ কোটি টাকা। বিভিন্ন ব্যাংকে মশিউরের চারটি অ্যাকাউন্টের তথ্য পাওয়া গেছে। দায় মেটানোর কোনো প্রক্রিয়া সম্পর্কে সদুত্তর দিতে পারেননি তারা। কোম্পানিটি প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে লোকসানে ছিল। কোনো ব্যবসায়িক লাভ ছিল না, উল্টো ছিল খরচ। যা গ্রাহকের টাকায় মেটানো হতো। ফলে দেনা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, পণ্যের মূল্যছাড়ের ফলে ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়। ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠানের বিশাল পরিমাণ দায় তৈরি হয়। দেনা না মিটিয়ে ব্যবসায়িক অপকৌশল হিসেবে নতুন গ্রাহকের ওপর দায় চাপিয়ে দিয়ে পুরোনো গ্রাহক ও সরবরাহকারীর দায়ের আংশিক পরিশোধ করতেন তারা। অর্থাৎ দায় ‘ট্রান্সফারের’ মাধ্যমে দুরভিসন্ধিমূলক অপকৌশল চালিয়ে যাচ্ছিল আকাশ নীল প্রতিষ্ঠানটি।

প্রতিষ্ঠানটির নেটওয়ার্কে গ্রাহকের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দায়ও বাড়তে থাকে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক মশিউর জেনেশুনেই নেতিবাচক অ্যাগ্রেসিভ পলিসিতে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছিলেন। ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে ক্রমান্বয়ে দায় বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় অচলাবস্থায় উপনীত হয়। নেতিবাচক ব্যবসায়িক স্ট্র্যাটেজির কারণে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ও অর্থ ট্রানজেকশন গেটওয়ে আকাশ নীল থেকে সরে আসে।

দায়মুক্তির পথ না পেয়ে দুবাই পালানোর পরিকল্পনা মশিউরের

দায় থাকায় এবং লাভ না হওয়ায় ব্যবসা নিয়ে সন্দিহান ছিলেন মশিউর ও রনি। সম্প্রতি মশিউর দুবাই পালানোর জন্য ভিসা ও বিমান টিকিটও কেনেন। তবে তার আগেই গ্রেপ্তার হন তিনি।

জেইউ/আরএইচ/জেএস