স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছি শুনে অবাক হয়েছি : ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া
চিকিৎসার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় বেসামরিক পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া। প্রখ্যাত এ নিউরোসার্জন দেশের সর্বোচ্চ চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২১ সালের মার্চে তিনি অবসরে যান।
মঙ্গলবার (১৫ মার্চ) স্বাধীনতা পুরস্কার- ২০২২ এর জন্য মনোনীতদের নাম ঘোষণা করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। জাতীয় পর্যায়ে ‘গৌরবোজ্জ্বল ও কৃতিত্বপূর্ণ’ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১০ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২২ এর জন্য চূড়ান্তভাবে মনোনীত করা হয়। সেখানে ডা. কনক কান্তি বড়ুয়ার নাম স্থান পায়। পুরস্কার পাওয়ার খবরে অনুভূতি জানতে ফোন দেওয়া হয় বিশেষজ্ঞ এ চিকিৎসককে। ফোনে স্বাধীনতা পুরস্কারের কথা শুনে অনেকটা চমকে যান তিনি। অবাক হয়ে আবারও জিজ্ঞাসা করেন, সত্যিই কি আমি এ পুরস্কার পেয়েছি!
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্টকে দেওয়া তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এভাবেই নিজের অনুভূতি ব্যক্ত করেন গুণী এ চিকিৎসক। প্রখ্যাত এ নিউরোসার্জনের সঙ্গে কথোপকথনের খণ্ডচিত্র তুলে ধরা হলো-
হ্যালো, স্যার। আপনি তো স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। আপনাকে অভিনন্দন। কী বলেন! খবরটা সঠিক কি? জ্বি স্যার। আজই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। আমি খুবই অবাক হয়েছি। জানি না আমি এতটা সম্মানের যোগ্য কি না! আমাকে সরকারিভাবে এখনও জানানো হয়নি। আমি খুবই খুশি হয়েছি
ঢাকা পোস্ট : দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ‘স্বাধীনতা পুরস্কার’ পাচ্ছেন। আপনার অনুভূতি কী?
ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া : আমি খুবই অভিভূত ও আনন্দিত। আমি জানি না এ সম্মাননার উপযুক্ত আমি কি না। একজন নিউরোসার্জন হিসেবে সরকারের এ স্বীকৃতি আমার জন্য কত বড় আনন্দের, তা বলে বুঝাতে পারব না। এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে আমার সহকর্মীদের মধ্যে যারা দীর্ঘ পথচলায় আমাকে সহযোগিতা করেছেন, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-চিকিৎসক, নার্সসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা রইল।
ঢাকা পোস্ট : একজন খ্যাতিমান চিকিৎসক হিসেবে স্বাস্থ্যখাত নিয়ে আপনার চাওয়া কী? কেমন দেখতে চান দেশের স্বাস্থ্যখাত?
ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া : আমরা এখন একটি সংকটময় সময় পার করছি। শুরুর দিকে সারাবিশ্বে করোনা সম্পর্কিত কোনো ভবিষ্যদ্বাণী ছিল না। আমেরিকা-ইউরোপের মতো বড় বড় দেশ যখন করোনা সংকটে তাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় সাংঘাতিক একটি সংকটে পড়েছিল, সেই তুলনায় কিন্তু আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা অনেকটা সন্তুষ্টিজনক। আমাদের সরকার, স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও চিকিৎসকদের প্রচেষ্টায় আমরা ভালোভাবে করোনা মোকাবিলা করতে পেরেছি।
স্বাস্থ্যখাতে গত দুই বছরে আমরা অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছি। আমাদের চিকিৎসাসেবার উন্নতি হয়েছে। তবে উন্নতির কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই। আমাদের আরও উন্নতি করতে হবে। কাঙ্ক্ষিত উন্নতির জায়গাগুলো নির্দিষ্ট করে সেগুলোতে মনোনিবেশ করে এগিয়ে যেতে হবে। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি গবেষণাতেও আমাদের আরও মনোনিবেশ করা উচিত। পাশাপাশি আমাদের চিকিৎসক-নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণে আরও বেশি নজর দেওয়া উচিত। এমনকি উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ করা উচিত না বলে আমি মনে করি।
ঢাকা পোস্ট : আপনি তো দেশের একটি সর্বোচ্চ চিকিৎসা-গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য ছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা গবেষণায় কতটুকু এগিয়েছি? পাশের দেশগুলোর তুলনায় আমাদের অবস্থান কোন পর্যায়ে?
ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া : চিকিৎসা-গবেষণায় আমরা অনেক পিছিয়ে আছি- এটা অবশ্যই আমাদের স্বীকার করতে হবে। এখানে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। যেমন- আমরা অনেক বেশি ব্যস্ত ক্লিনিক্যাল কাজগুলোতে। রিসার্চের চেয়ে ক্লিনিক্যাল কাজে আমরা বেশি সময় ব্যয় করছি। আমাদের চিকিৎসকরা প্রতিদিন যে সংখ্যক রোগী দেখেন, বিশ্বের কোনো দেশে একজন স্পেশালিস্ট এত রোগী দেখেন না। আমাদের চিকিৎসক অনুপাতে জনসংখ্যার হার এত বেশি, আর জনসংখ্যা অনুপাতে আমাদের স্পেশালিস্টের সংখ্যা এত কম যে ক্লিনিক্যাল সার্ভিস দিতে গিয়ে পরে আর গবেষণায় সময় দেওয়া হয়ে ওঠে না।
পরিস্থিতি যাই হোক, আমাদের অবশ্যই গবেষণার দিকে নজর দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীও বারবার গবেষণায় আমাদের উৎসাহিত করেছেন। কিন্তু বাস্তবতার দিক থেকে যেমন- আমি একজন নিউরোসার্জন, আমি যদি সপ্তাহের প্রতিদিন অপারেশন করি, আমার প্রতিটি অপারেশনে অন্তত তিন ঘণ্টা থেকে ছয় ঘণ্টা বা আট ঘণ্টা, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ১০ ঘণ্টাও লেগে যায়। ফলে গবেষণার জন্য আলাদা সময় ও সুযোগ হয়ে ওঠে না। তারপরও আমাদের সুযোগ বের করে নিতে হয়।
একনজরে অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া
কনক কান্তি বড়ুয়া ১৯৫৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭৭ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। ১৯৯০ সালে এফসিপিএস, ২০০৩ সালে এমএস (নিউরো সার্জারি), ২০০৪ সালে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনস থেকে এফসিপিএস অর্জন করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুশল্যবিদ্যা বিভাগের (নিউরোসার্জারি) সভাপতি এবং শল্যবিদ্যা অনুষদের ডিনের দায়িত্বপালন করেন। ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ২০১৮ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এখন পর্যন্ত তার ৪৭টিরও বেশি গবেষণাপত্র দেশি-বিদেশি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
তিনি ১৯৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এফআইসিএস, ২০১২ সালে শ্রীলঙ্কা থেকে সম্মানসূচক এফএসএলসিএস এবং কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জন্স, পাকিস্তান থেকে সম্মানসূচক এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করেন। নিউরোসার্জারিতে অসামান্য অবদানের জন্য আন্তর্জাতিক ‘বিএমএএনএ রিকোগনিশন অ্যাওয়ার্ড-২০১৮ লাভ করেন। ২০১৯ সালে অধ্যাপক পিএস রামানি লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া।
টিআই/জেডএস