দেশে করোনার ২ বছর
‘নতুন ভ্যারিয়েন্ট আসার প্রবল আশঙ্কা আছে’
দেশে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে কেউ কেউ বলছেন, ওমিক্রনের মাধ্যমেই এই মহামারির বিলুপ্তি ঘটতে চলেছে। আবার অনেকেই বলছেন, কেউ ওমিক্রনে আক্রান্ত হলে তাকে আর অন্য কোনো ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত করবে না। এসব বক্তব্যে আশা দেখা দেওয়ায় জনজীবন আবারও স্বাভাবিক পর্যায়ে ফিরে আসতে শুরু করেছে। হাঁট-বাজার, রাস্তাঘাট সব জায়গায় মানুষ মাস্ক ছাড়াই ঘুরে বেড়াচ্ছে।
তবে এ অবস্থাকে ভয়ানক ও আত্মঘাতী বলে মন্তব্য করেছেন সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর।
বিজ্ঞাপন
আজ ৮ মার্চ দেশে করোনাভাইরাস শনাক্তের দুই বছর হয়েছে। এ উপলক্ষে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি, সফলতা-ব্যর্থতা ও করণীয়সহ নানা বিষয়ে ঢাকা পোস্টের সঙ্গে কথা বলেছেন ডা. আলমগীর। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রতিবেদক তানভীরুল ইসলাম।
ঢাকা পোস্ট : দেশ করোনা সংক্রমণের দুই বছর অতিবাহিত করছে, সংক্রমণও কমে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আপনার মন্তব্য কী?
ডা. এএসএম আলমগীর : করোনাভাইরাস সংক্রমণের সার্বিক চিত্রটা আসলে এমন নয়। বাংলাদেশের যে চিত্রটা আমরা দেখছি, প্রতিদিন ৫০০ বা ৭০০ মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে, ৫ বা ৭ জন মারা যাচ্ছে, এটা সংক্রমণের সার্বিক চিত্র নয়। আসল চিত্র বুঝতে বিশ্বের দিকে তাকাতে হবে।
আমরা জানি, বিশ্বে এখন প্রতিদিন ৮ থেকে ১০ লাখ মানুষের করোনা শনাক্ত হচ্ছে। আবার এটাও জানি যে, শনাক্তকৃত মানুষের এ সংখ্যার চেয়েও আক্রান্তের সংখ্যা আরও অন্তত ৫ গুণ বেশি, যা প্রতিনিয়তই হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছে। এ হিসাব করলে বিশ্বের ৫০ লাখ মানুষ এখনো প্রতিদিন করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। ৫ থেকে ৭ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। আমরা আসলে বিশ্ব মহামারির একটি পর্যায়ে আছি।
যদিও আমরা দেখছি তুলনামূলক রোগীর সংখ্যা কমেছে, মৃত্যুর সংখ্যা কমেছে, রোগের সিভিয়ারিটি অনেকটা কমেছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে পৃথিবীর অধিকাংশ উন্নত দেশ তাদের জনসংখ্যার একটা বড় অংশকে ভ্যাকসিনেশনের আওতায় নিয়ে এসেছে। কোথাও কোথাও ৮০ ভাগের বেশি মানুষকে দুই ডোজ টিকার আওতায় আনা হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও ৭০ ভাগের বেশি দুই ডোজ টিকার আওতায় আনা হয়েছে। আর এজন্যই করোনায় আক্রান্ত হলেও সিভিয়ারিটি কম হচ্ছে এবং হাসপাতালে কম রোগী আসছে।
সারা বিশ্বেই ভাইরাসটি এখনো বিদ্যমান। মানুষের শরীরে এটি বিরাজ করছে এবং প্রতিনিয়ত মানুষকে আক্রমণ করছে। তাই ভাইরাসটি মিউটেশন (নতুন রূপ ধারণ) হওয়ার প্রবল আশঙ্কা আছে। তবে, ভাইরাসটির এতো মিউটেশন বা পরিবর্তিত রূপের কারণে এতটা সিভিয়ার (তীব্র) নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে। তাই মহামারির এ পর্যায়ে আমাদের আশঙ্কা হলো, নতুন করে রূপ বদলালে ভাইরাসটি দুর্বলও হতে পারে, আবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, ভাইরাসটি পরিবর্তন হয়ে মারাত্মক আকারও ধারণ করতে পারে।
ঢাকা পোস্ট : বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের টিকা আবিষ্কার হয়েছে। আমরাও আমাদের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর শতভাগকে টিকার আওতায় আনতে পেরেছি। তবুও কেন ঝুঁকি থেকে যায়?
ডা. এএসএম আলমগীর : সারা পৃথিবীতেই এখন টিকা কার্যক্রম জোরালোভাবে চলছে। তবে আমরা দেখছি আফ্রিকার দেশগুলোতে অনেক কম টিকা দেওয়া হয়েছে। সে দেশগুলোতে সর্বোচ্চ ১০ থেকে ২০ শতাংশ মানুষকে টিকার আওতায় আনা গেছে। এক্ষেত্রে পৃথিবীর কোনো জায়গাতেই যদি ভাইরাসটি থেকে যায়, তাহলে এটি পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে মিউটেশনের মাধ্যমে আরও শক্তিশালী হয়ে ফের সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই অবস্থায় আমাদের করণীয় হলো সতর্কতার সঙ্গে ভাইরাসটিকে পর্যবেক্ষণ করা। শতভাগ মানুষকে টিকার আওতায় আনা। যারা টিকা নেওয়ার যোগ্য, তাদের সবাইকেই টিকা দেওয়া। জনগণের উচিত এখনো যারা টিকা নেননি, তারা যেন নিজেরাই সচেতনভাবে টিকা নিয়ে প্রতিরক্ষার মধ্যে চলে আসেন।
ঢাকা পোস্ট : অনেকেই বলছে ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্টের মাধ্যমে ভাইরাস নিজেকে নিজেই দুর্বল করে ফেলেছে, এটি কতটুকু সত্য? এ বিষয়ে আইইডিসিআরের পর্যবেক্ষণ কী?
ডা. এএসএম আলমগীর : সারা পৃথিবীতেই একটি কথা প্রচলিত আছে যে, কাউকে যদি ওমিক্রন আক্রান্ত করে, তাহলে তাকে অন্য কোনো নতুন ভ্যারিয়েন্ট আক্রান্ত করবে না। কিন্তু এসব গবেষণাগুলোর প্রত্যেকটিই আদিম বা সেকেলে এবং একদম প্রাথমিক পর্যায়ের গবেষণা। ওমিক্রন এসেছে গত বছরের ডিসেম্বরের প্রথম বা নভেম্বরের শেষ দিকে, সেটি মাত্র তিন বা চার মাস হলো। এই অল্প সময়ের গবেষণার মাধ্যমে এরকম কোনো ফলাফলে নির্ভরশীল হওয়া কঠিন। শুধু করোনাভাইরাস নয়, কোনো ভাইরাসেরই এরকমভাবে উপসংহার টানা যায় না।
করোনাকালে অনেকে নতুন করে মহামারির বিশেষজ্ঞ হয়েছেন। তাদের অনেকেই আছেন স্ট্যান্ডবাজি করেন, যেমনটি নিওকোভ নিয়ে করা হয়েছে। আবার অনেকে আছেন ধারণাগতভাবে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে মহামারির এমন সময়ে গুগল করে কোনোভাবেই মতামত দেওয়া ঠিক নয়। সংকটময় সময়ে আপনাকে যদি কোনো তথ্য দিতে হয় তাহলে আপনাকে সে বিষয়ে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। তা না হলে যে কোনো ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারে। কারণ সারা পৃথিবীর জনস্বাস্থ্য এটির সঙ্গে জড়িত।
‘ওমিক্রন এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি করে, এটিতে আক্রান্ত হলে অন্য করোনাভাইরাস আক্রমণ করবে না’- এটি একটি ভুল ধারণা। ওমিক্রন আসার পর এখন পর্যন্ত আর কোনো নতুন ধরনের ভ্যারিয়েন্ট আমরা লক্ষ্য করিনি, সুতরাং আক্রমণ করবে কি করবে না, সেটি আমরা কেউ জানি না। যে কোনো ধরনের ভাইরাস আক্রমণ করলেই শরীরে এক ধরনের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু সেগুলো দীর্ঘস্থায়ী নয়। এমনকি আমরা করোনার ক্ষেত্রে দেখেছি, ২৮ দিন থেকে তিন মাসের মধ্যেই অ্যান্টিবডি কমতে শুরু করে। সুতরাং নতুন ভ্যারিয়েন্টের এখনো আশঙ্কা আছে। তাই আমাদের সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে হবে। একইসঙ্গে টিকা কার্যক্রম পরিচালনা করে যেতে হবে।
ঢাকা পোস্ট : টিকা মানুষকে কতটুকু সুরক্ষিত করতে পারে? এই সুরক্ষা কতদিন পর্যন্ত থাকে?
ডা. এএসএম আলমগীর : টিকা মানুষকে সুরক্ষিত করে এটি বাস্তব। কিন্তু একজন মানুষকে কতদিন সুরক্ষিত রাখে সেটি আমরা জানি না। স্বাভাবিকভাবে টিকা নিলে এক ধরনের প্রতিরক্ষা তৈরি হয়, যার কারণে অন্তত মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি কমে যাবে।
ঢাকা পোস্ট : আবারও নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসলে আমাদের প্রস্তুতি কতটুকু আছে বলে মনে করেন?
ডা. এএসএম আলমগীর : করোনার শুরুর দিকে এমন একটা অবস্থা ছিল যখন আমরা এর বিষয়ে কোনো কিছুই জানতাম না। এর চিকিৎসা সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না, আমাদের কাছে কোনো টিকা ছিল না। তবুও আমরা সে সময় কিছুটা হলেও ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে এখন মারাত্মক কোনো ভ্যারিয়েন্ট আসলেও আমরা মোকাবিলা করার জন্য মোটামুটি ভাবে প্রস্তুত। আমাদের কাছে পর্যাপ্ত টিকা রয়েছে। আমি মনে করি বিজ্ঞানের একটি সেরা আবিষ্কার হলো মহামারির এক বছরের মধ্যেই করোনা টিকা আবিষ্কার করা এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিভাইরাল। হোক সেটি ৩০ শতাংশ কাজ করে, কিন্তু এর মাধ্যমে আমরা কিছুটা হলেও সুরক্ষা তো পাচ্ছি। এরকম অনেকগুলো অ্যান্টিভাইরাল আছে। এছাড়া আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থারও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। সবমিলিয়ে যেকোনো নতুন ঢেউ মোকাবিলায় বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেরও প্রস্তুতি আছে।
ঢাকা পোস্ট : করোনা সংক্রমণ কমে আসায় ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি দেশ করোনা পরীক্ষা ছাড়াই কেবল টিকা সনদ দিয়ে প্রবেশের সুযোগ দিয়েছে, এক্ষেত্রে আমাদেরও এরকম সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ হয়েছে কি না?
ডা. এএসএম আলমগীর : বিভিন্ন দেশ তাদের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে এ ধরনের সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আমি মনে করি এই মুহূর্তে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি। কারণ আমাদের দেশের একটি বিমান বিভিন্ন দেশের যাত্রী বহন করে থাকে। এদিকে হাতেগোনা কয়েকটি দেশ জানিয়েছে করোনা পরীক্ষা ছাড়াই শুধু টিকা কার্ড নিয়ে আসা যাবে, আর বাকি সব দেশেই পূর্বের সিদ্ধান্ত রয়ে গেছে। এখন একই বিমানে একেক দেশের জন্য একেকে নিয়ম হয়ে যায়। সুতরাং এখানে এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়া কঠিন।
আমাদেরকে একটি কথা মনে রাখতে হবে, অনেকগুলো দেশ মাঝখানে একবার চেষ্টা করেছিল, করোনা পরিস্থিতি একধরনের স্বাভাবিক অবস্থায় নিয়ে আসতে। এতে কিন্তু মারাত্মক ফলাফল পেয়েছে ফ্রান্স এবং ইতালিসহ কয়েকটি দেশ। এখন আবারও অনেক দেশ চেষ্টা করছে জোর করে স্বাভাবিকতা নিয়ে আসার। তারা চাচ্ছে করোনা পরিস্থিতিকে নরমাল করে দেখানোর জন্য। আমি মনে করি, একটি মহামারির সময়ে ধীরেসুস্থে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে তারপরই এই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত এবং এখানে বৈজ্ঞানিক উপায়ে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
আমাদেরকে কখনোই অতি উৎসাহিত হয়ে স্বাভাবিক অবস্থা দেখানো উচিত হবে না। মহামারি আছে, এখনো ভাইরাসটি মানুষকে আক্রান্ত করছে এবং প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছে -এটাই সত্য।
দুই বছরে দেশের করোনা পরিস্থিতির সার্বিক চিত্র
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট করোনা পরীক্ষা হয়েছে ৩২ লাখ ২৭ হাজার ৫৯৮টি। এতে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৫১০ জনের। তাদের মধ্যে মোট সুস্থ হয়েছেন ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৪৫৯ জন। আর মৃত্যু হয়েছে ৭ হাজার ৫৫৯ জনের।
তথ্য বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চের ৭ তারিখ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ১ কোটি ৩৫ লাখ ৪৬ হাজার ৯৫০টি। এতে মোট করোনা শনাক্ত হয়েছেন ১৯ লাখ ৪৭ হাজার ৭০২ জন। আর সুস্থ হয়েছেন ১৮ লাখ ৪৬ হাজার ৮৮৪ জন। মারা গেছেন ২৯ হাজার ৮৯ জন। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৮ হাজার ৫৬৯ জন। আর নারী রয়েছেন ১০ হাজার ৫২০ জন।
বেশি মৃত্যু ঢাকায়, কম ময়মনসিংহে
বিভাগভিত্তিক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, করোনায় ঢাকায় সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এখানে মারা গেছেন ১২ হাজার ৭৭৫ জন। সবচেয়ে কম মারা গেছে ময়মনসিংহে। সেখানে ৮৭৯ জন মারা গেছেন।
এছাড়া চট্টগ্রামে ২০ দশমিক ১৫ শতাংশ, খুলনায় ১২ দশমিক ৭৭ শতাংশ, রাজশাহীতে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ, রংপুরে ৪ দশমিক ৮৭ শতাংশ, সিলেটে ৪ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বরিশালে ৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
এক দিনে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা হয়েছে ৫৭ হাজার ২৯৭টি। পরীক্ষা হয়েছে ৫৫ হাজার ২৮৪টি। শনাক্ত সর্বোচ্চ হয়েছে ১৬ হাজার ২৩০টি। সুস্থ হয়েছেন ১৬ হাজার ৬২৭ জন। এক দিনে মৃত্যু হয়েছে ২৬৪ জন। শনাক্তের হার সর্বোচ্চ ৩৩ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সুস্থের হার ৯৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ। মৃত্যুর হার ১২ দশমিক ৮২৫ শতাংশ।
টিআই/আইএসএইচ