দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পিছিয়ে নেই নারী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল। দেশের ১৬ কোটি জনগণের ৮ কোটি নারী। কৃষিখাত, বস্ত্রশিল্পখাত এবং বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়োজিত রয়েছেন নারীরা। বাংলাদেশ পুলিশের ক্ষেত্রেও পিছিয়ে নেই নারীরা। তবে পুলিশে পুরুষের তুলনায় নারীর সংখ্যা খুবই কম। নারীদের পুলিশে নিয়োগেও রয়েছে ধীরগতি ও নানা বাধা।
পুলিশের ঊর্ধ্বতন নারী কর্মকর্তা ও সাবেক পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্বায়নের যুগে সার্বিক উন্নতির মাপকাঠিতে অনেক বিষয়ই মূল্যায়ন করা হয়। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে গেলেও সমাজের সব নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে পুলিশ বাহিনীতে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। নারীর উন্নতি, অগ্রগতি ও সহিংসতারোধে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডেও নারীকে সর্বক্ষেত্রে সম্পৃক্ত ও নারীর কর্মক্ষেত্র বৃদ্ধি করতে হবে।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর পুলিশ বাহিনীতে ছিল না নারীর অংশগ্রহণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে আটজন নারী কনস্টেবল নিয়োগ দেন। তবে তারা কাজ করতেন সাদা পোশাকে। এরপর পুলিশের পোশাকে নারী সদস্যদের নিয়োগ শুরু হয় ১৯৭৬ সালে। মাত্র ১১ জন নারী সদস্য নিয়োগের মধ্য দিয়ে যে পথচলা শুরু সেখানে আজ পুলিশে নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। গত বছরের তুলনায় প্রায় ১ শতাংশ নারী পুলিশের সংখ্যা বেড়েছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত মোট জনবলের সংখ্যা ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৯ জন। এরমধ্যে নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৯ জন। যা মোট জনবলের ৮.০২ শতাংশ।
পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ বাহিনীতে ক্রমেই বাড়ছে নারীর প্রাধান্য। যোগ্যতা-সুযোগ অনুযায়ীই বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে পদোন্নতি ও দায়িত্ব পাচ্ছেন তারা। শুধু তা-ই নয়, দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনেও উজ্জ্বল ভূমিকায় নারী পুলিশ সদস্যরা। সমান তালে, সমান চ্যালেঞ্জে পুলিশে নারীরা অভাবনীয় সাফল্য পাচ্ছে। মিলছে স্বীকৃতিও। পুলিশকে নারীবান্ধব হিসেবে ঘোষণা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইজিপিও।
বাংলাদেশ পুলিশ উইমেন নেটওয়ার্ক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত মোট নারীর সংখ্যা ১৩ হাজার ৪০২, যা ছিল সেসময়কার বাংলাদেশ পুলিশের মোট জনবলের ৭.১০ শতাংশ।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যানুযায়ী, সর্বশেষ ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পুলিশে কর্মরত মোট জনবলের সংখ্যা ১ লাখ ৮৯ হাজার ৭৯৯ জন। এরমধ্যে নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার ২৩৯ জন। যা মোট জনবলের ৮.০২ শতাংশ।
পুলিশে উচ্চপর্যায়ে অর্থাৎ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত প্রথম শ্রেণির নারী পুলিশ কর্মকর্তা ২৯৬ জন। এরমধ্যে ডিআইজি (গ্রেড-৩) দুজন, অতিরিক্ত ডিআইজি ৩ জন, পুলিশ সুপার ৮০ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১২১ জন এবং সহকারী পুলিশ সুপার ৯০ জন।
এছাড়া ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) ১১৪ জন, উপ-পরিদর্শক (এসআই) ৮৫৮ জন, সার্জেন্ট ৫৭ জন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) ১১৩৩ জন, এএসআই (স্বশস্ত্র) ৩ জন, নায়েক ২৬১ জন এবং নারী কনস্টেবল ১২ হাজার ৫১৭ জন।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ পুলিশে প্রথম নারী সদস্য নিয়োগ শুরু হয়। প্রথমবার সাতজন নারী এসআই এবং সাতজন নারী কনস্টেবল পদে যোগ দেন। ১৯৮৬ সালে প্রথম সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) পদে ফাতেমা বেগমের যোগদানের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে উচ্চপর্যায়ে (বিসিএস) নারী নিয়োগ শুরু হয়। এখন পুলিশ ক্যাডার সার্ভিসে নারীর অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে।
১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারী পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ চালু করেন। ১৯৯৯ সালে ১৮তম বিসিএসে আটজন নারী সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে পুলিশ ক্যাডারে নারীদের প্রবেশাধিকার আবার উন্মুক্ত হয়।
পুলিশ বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটে নারী সদস্যরা দায়িত্ব পালন করলেও আগে ট্রাফিক সার্জেন্ট পদে নারী সদস্যদের দেখা যায়নি। ২০১৭ সালে ৩২ জন নারী সার্জেন্টের যোগদানের মধ্য দিয়ে রাজপথে কাজ করতে শুরু করেন নারী পুলিশ সদস্যরা। বর্তমানে শুধু ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগে কাজ করছেন ৫২ নারী পুলিশ সদস্য।
ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ডিএমপিতে মোট জনবল ৩০ হাজার ৩৫৯ জন। এরমধ্যে নারী কর্মকর্তা ২৯ জন। পুরুষ কর্মকর্তা ৩০০ জন। নারী কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছে যুগ্ম কমিশনার একজন, উপ-কমিশনার তিনজন, অতিরিক্ত উপ-কমিশনার ১২ জন আর সহকারী কমিশনার রয়েছে ১৩ জন।
সহকারী কমিশনারের নিচে নারীর সংখ্যা ২ হাজার ২৮ জন। পরিদর্শক ৮ জন, এসআই ১১৮ জন, সার্জেন্ট ৩৫ জন, এএসআই (নিরস্ত্র) ১৫৯ জন, নায়েক ৪৩ জন, কনস্টেবল ১৬৬৫ জন।
বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিওএন) সূত্রে জানা যায়, নারী পুলিশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান, নেতৃত্ব ও দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০০৮ সালে চালু করা হয় ‘উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক।’ ২০১২ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হয় নারী পুলিশের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। এ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নারী পুলিশের ভূমিকা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও প্রশংসিত হয়।
১৯৮৯ সাল থেকে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি অংশ নিচ্ছেন বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যরাও। চলতি বছরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ১৪৪ নারী পুলিশ সদস্য জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালন করেছেন।
বর্তমানে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চে কর্মরত ও বাংলাদেশ উইমেন পুলিশ নেটওয়ার্ক (বিপিডব্লিওএন) সভাপতি ডিআইজি আমেনা বেগম ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে-বিদেশে বাংলাদেশ পুলিশের জয়যাত্রা চলছে। এতে পুরুষের মতো নারী পুলিশ সদস্যদেরও রয়েছে উল্লেখযোগ্য অবদান। সমাজে নারীর নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করতে হলে পুলিশের মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় বাড়াতে হবে নারীর অংশগ্রহণ।
তিনি বলেন, পুলিশের দক্ষতা-সক্ষমতা বৃদ্ধি, নেতৃত্বের বিকাশ, মানবিক কাজে উদ্বুদ্ধ করতে নিয়মিত নারী পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। যার প্রতিফলন বিভিন্ন অপারেশনাল কাজে পুরুষের মতো সমান সাফল্য পাচ্ছেন নারী কর্মকর্তারাও।
তিনি বলেন, কর্মক্ষেত্র হিসেবে পুলিশে নারী সদস্যদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্য ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন বন্ধে নীতিমালা ও কর্মপন্থা ২০২১’গ্রহণ করা হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের সুনির্দিষ্ট নির্দেশনার আলোকে পুলিশ সদর দফতরের গাইডলাইনস অনুসরণ করে ডিএমপিসহ সব ইউনিটেই সকল বিভাগে নারীদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে এ নীতিমালা ও কর্মপন্থা প্রণয়ন করা হয়েছে।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অ্যাডমিন) মীর রেজাউল আলমের সার্বিক তত্ত্বাবধান ও উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার হামিদা পারভীনের পরিকল্পনায় ‘কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতন বন্ধে নীতিমালা ও কর্মপন্থা ২০২১’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর প্রকাশনায় কাজ করেছে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ।
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঢাকা মহানগর এলাকার সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের প্রতি সংবেদনশীলতা ও তাদের অধিকারকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নারী ও শিশুর প্রতি সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে ডিএমপি। পুলিশের সর্ববৃহৎ এই ইউনিটে বর্তমানে দুই হাজারের অধিক নারী সদস্য কর্মরত। জেন্ডার সংবেদনশীলতাকে গুরুত্ব দিয়ে তাদের জন্য নিরাপদ ও অধিকতর সহনশীল কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বদ্ধপরিকর।
এ ব্যাপারে সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশে নারীর অংশগ্রহণ অবশ্যই বাড়াতে হবে। কিন্তু চ্যালেঞ্জিং পেশা মনে করে পুলিশ সেনাবাহিনীতে অংশগ্রহণে নারীরা এখনো পিছিয়ে। এক্ষেত্রে জেন্ডার ইক্যুইলিটিকে গুরুত্ব দিতে হবে। সবসময় ১০ শতাংশ কোটা পূরণের চেষ্টা করা হয় পুলিশে। এর বাইরেও মেধায় এগিয়ে থাকা নারীদের রিক্রুট করা হচ্ছে। পুলিশে নারীর অংশগ্রহণকে বাড়াতে পরিবার সমাজ থেকে উৎসাহিত করতে হবে।
তিনি বলেন, পুলিশ পরিচালিত জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ কতো চমৎকার কাজ করছে। সেখানে নারী সদস্যের সংখ্যাই বেশি। এরকম সব বিভাগেই নারীরা সফলভাবে কাজ করছে। দেশের মোট জনগোষ্ঠির অর্ধেকই নারী। তাদের উন্নয়ন অগ্রগতি সমৃদ্ধির বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই।
জেইউ/এসএম