বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর নারীদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে উন্নয়ন হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষা, অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ততাসহ রাজনৈতিকভাবে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীদের উন্নয়নের মধ্যে ‘পিছুটান’ও লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ফলে এখনও নারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পুরুষের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক ‘নারী, ব্যবসা এবং আইন- ২০২২’ শিরোনামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। যেখানে উঠে এসেছে পৃথিবীর যেসব দেশে পুরুষের তুলনায় নারীর অর্থনৈতিক সুযোগ কম, বাংলাদেশ তার অন্যতম।

বিশ্ব ব্যাংক তাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বিভিন্ন আইনি বাধা এবং আইন না থাকায় বাংলাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। বিশ্বের ১৯০টি দেশ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক প্রতিবেদনটি তৈরি করে। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩তম। বাংলাদেশ নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে মোট ১০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ৪৯ দশমিক ৪ শতাংশ স্কোর লাভ করে। দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তান ছাড়া সব দেশের পেছনে বাংলাদেশ।

 বিভিন্ন আইনি বাধা এবং আইন না থাকায় বাংলাদেশের নারীরা অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছেন। বিশ্বের ১৯০টি দেশ নিয়ে বিশ্ব ব্যাংক প্রতিবেদনটি তৈরি করে। ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৩তম

মোট আটটি নির্দেশকের ওপর ৩৫টি প্রশ্নের ভিত্তিতে এ বিষয়ে স্কোর নির্ণয় করা হয়। এগুলো হলো- চলাচলের অধিকার, কর্মক্ষেত্র, মজুরি, বিয়ে, মাতৃত্ব/পিতৃত্ব, উদ্যোগ, সম্পত্তি ও পেনশন।

বিশ্ব ব্যাংক বলছে, বিশ্বে ২৪০ কোটি কর্মক্ষম নারীর পুরুষের সমান অধিকার নেই। ১৭৮টি দেশে অর্থনীতিতে নারীর পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণের পথে আইনি বাধা রয়েছে। ৮৬টি দেশে নারীর কর্মসংস্থানে আইনি বাধা রয়েছে। ৯৫টি দেশ একই কাজের জন্য নারীকে সমান মজুরির নিশ্চয়তা দেয় না।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উচ্চ পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অগ্রগতি সীমাবদ্ধ, বলছেন বিশ্লেষকরা / ফাইল ছবি

নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমরা যদি ধারাবাহিকভাবে দেখি তাহলে প্রাথমিক শিক্ষায় নারী-পুরুষের বৈষম্য কমেছে। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষাতেও মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে অনেক জায়গায় বা ক্ষেত্রে নারীদের উন্নয়ন পিছিয়ে রয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘শ্রমবাজারে নারীদের অংশগ্রহণে আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। এ সমস্যা সমাধানে সরকার বিভিন্ন ধরনের চেষ্টা চালাচ্ছে। যদিও সরকারিভাবে কর্মসংস্থানে নারীদের জন্য ১৫ শতাংশ কোটা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। তবে আমাদের দেশে মূল কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে ব্যক্তি খাত। সেখানে তো কোনো কোটার সিস্টেম নেই। এছাড়া আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারে ১৬ থেকে ৬০ বছর বয়সের পুরুষদের অংশগ্রহণ ৮৫ শতাংশ। অন্যদিকে নারীদের অংশগ্রহণের হার মাত্র ৩৫ শতাংশ। আমার মনে হয়, শ্রমবাজারে আমাদের নারীদের অংশগ্রহণে আরও কিছু করার আছে।’

ব্যবসা-বাণিজ্য বা উদ্যোক্তা হওয়ার ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও সেভাবে লক্ষ করা যাচ্ছে না / ফাইল ছবি

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, নারীদের জন্য উদ্যোক্তা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে সরকার ঋণের ব্যবস্থা করছে। এখানেও দেখা যাচ্ছে ব্যবসা-বাণিজ্য বা উদ্যোক্তা হওয়ায় মেয়েদের যেভাবে অংশগ্রহণ করার কথা, তেমনটি আমরা দেখি না। এ হার আরও বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে একই কাজের জন্য নারী-পুরুষের মজুরির পার্থক্য অতটা নেই। এটা ভালো দিক। তবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপরের দিকের অগ্রগতি সীমাবদ্ধ। উপরের দিকে যাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। যেসব জায়গায় সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধান করতে হবে। এসব জায়গায় সমতা এলে নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে।’

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অর্থনৈতিক অধিকারে বাংলাদেশের নারীদের পিছিয়ে থাকার অনেক কারণ আছে। যেমন- নারীদের লেখাপড়ার সুযোগ কম। বিশেষ করে উচ্চ শিক্ষার হার অনেক কম। কম বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় আমাদের মেয়েদের। বিয়ের পর বেশির ভাগ নারীই লেখাপড়াসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান না। এছাড়া দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের বাইরে কাজ করার সুযোগ কম থাকে। এসব পরিবারের বাবা-মায়েরা চান তাড়াতাড়ি মেয়েদের বিয়ে দিতে। এসব সামাজিক পরিস্থিতি পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত নারীদের অর্থনৈতিক বা সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে না।’

দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের কম বয়সে বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা নারীদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ থেকে বিরত রাখছে, বলছেন বিশ্লেষকরা / ফাইল ছবি 

বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদন প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, বিশ্ব ব্যাংক একেকবার একেক কথা বলে। তারা তাদের কথা বলুক। আমরা বলি বাংলাদেশ সবক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা জানি আমাদের কাজ করতে হবে, যেটা আমাদের সরকার প্রতিনিয়তই করে যাচ্ছে। সামনের দিকে আরও কীভাবে এগিয়ে যাওয়া যায় আমরা সেই চেষ্টাই করব।

এসআর/জেডএস