জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদে ২০ গণমাধ্যমের স্বাক্ষর
গণমাধ্যমে জেন্ডার বিবেচনায় নিরাপত্তা ন্যায্যতা নিশ্চিতের দাবি
চাকরির নিশ্চয়তা, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও পারিবারিক অসহযোগিতার কারণে সাংবাদিকতাকে পেশা হিসেবে নিতে আগ্রহ হারাচ্ছেন বাংলাদেশের নারীরা। গণমাধ্যমের কর্মপরিবেশের পাশাপাশি এর বড় কারণ লিঙ্গ বৈষম্য।
গণমাধ্যমগুলোকে টিকে থাকতে হলে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ ও তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। গণমাধ্যমে জেন্ডার সমতা, ন্যায্যতা, মর্যাদা ও সংবেদনশীলতা প্রতিষ্ঠার তাগিদ দিয়েছেন বিশিষ্টজনরা।
বিজ্ঞাপন
রোববার (১ ডিসেম্বর) রাজধানীর দ্য ডেইলি স্টার ভবনে এমআরডিআই আয়োজিত ‘সংবাদ মাধ্যমের জন্য জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ প্রকাশ’ অনুষ্ঠানে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনরা।
এমআরডিআই নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান মুকুলের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস।
তিনি ‘সংবাদ মাধ্যমের জন্য জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ প্রকাশ’ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।
জেন্ডার চার্টার্ড ওয়ার্কিং গ্রুপ জানিয়েছে, মোট ২০টি গণমাধ্যম এই সংবাদ মাধ্যমের জন্য জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ স্বাক্ষর করেছে। এ ছাড়া আরও দুটি টিভি চ্যানেলের এ অঙ্গীকার সনদে স্বাক্ষরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
আরও পড়ুন
অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং জেন্ডার চার্টার ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান গীতি আরা নাসরিন বলেন, বাংলাদেশের সংবাদকর্মীদের মধ্যে এবং পরিবেশিত সংবাদে নারী, পুরুষ ও অন্যান্য জেন্ডারের উপস্থিতির ক্ষেত্রে সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সংবাদমাধ্যমের জন্য জেন্ডার-সংবেদনশীলতা বিষয়ে একটি অঙ্গীকার সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ সনদ সংবাদ প্রতিষ্ঠানে এবং তাদের পরিবেশিত সংবাদে সব জেন্ডারের উপস্থিতি, অংশগ্রহণ এবং সমতা ও ন্যায্যতা নিশ্চিত করতে তাদের অঙ্গীকারবদ্ধ করবে।
এ সনদ প্রণয়নে মিডিয়া রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভের (এমআরডিআই) উদ্যোগে সাংবাদিকতার শিক্ষক, সংবাদমাধ্যমের সিদ্ধান্ত গ্রহীতা, সাংবাদিক, অধিকারকর্মী, উন্নয়নকর্মী এবং জেন্ডার ও আইন-বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১০ জনের একটি দল গঠন করা হয়। সেই দল ১১টি বৈঠকের মাধ্যমে সনদটি তৈরির কার্যপদ্ধতি নির্ধারণ এবং প্রতিটি স্তরে পর্যালোচনার পর চূড়ান্ত সনদ প্রণয়নের জন্য কাজ করে। সনদ প্রণয়নে ১৫টি দল ভিত্তিক আলোচনার মাধ্যমে রাজধানী ও জেলা পর্যায় থেকে ১২৯ অংশীজনের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়।
এ সনদে বিষয়গুলোকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে সামগ্রিক ঐকতানের মধ্যে বিবেচনা করার প্রচেষ্টা রয়েছে উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, বৈচিত্র্যময় কর্মে নারীর অংশগ্রহণ থাকলেও গণমাধ্যমে নারী অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে কম। গণমাধ্যমে সব জেন্ডারের মতামত দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশের সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট নীতিমালা থাকতে হবে, যদিও অনেক গণমাধ্যমে তা নেই। অথচ গণমাধ্যম স্বচ্ছতা বিষয়টি বেশি দাবি করে।
তিনি বলেন, শাস্তি দেওয়ার জন্য নয়। সচেতনতার জন্য আইনগত ঝুঁকি থেকে গণমাধ্যমের কর্মীরাই যেন মুক্ত থাকেন, সেজন্যই এ সনদ প্রণয়ন করা হয়েছে।
চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র নিউজ এডিটর মীর মাশরুরুজ্জামান রনি বলেন, গণমাধ্যমে জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার বাস্তবায়নের সঙ্গে বিনিয়োগ জড়িত আর বিনিয়োগের বিষয়টি আসলে মালিকানা বিষয়টিও আসে। একজন নারী সহকর্মীর জন্য নানা ধরনের পরিবর্তন সংযোজন প্রয়োজন হবে যেটা অনেক মালিক করতে চাইবেন কি না প্রশ্ন। আমাদের নিউজরুম সংস্কৃতি অনেক পুরাতন যখন নারীদের গণমাধ্যমে অংশগ্রহণ ছিল হাতে গোনা। বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এ নিউজরুম সংস্কৃতিতেও আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে।
সমকালের উপদেষ্টা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, বাংলাদেশে দুটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। একটি ৯০-এ, আরেকটি এই ২৪-এ। ৯০-এর গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ ছিল হাতে গোনা। তবে ২৪-এর গণঅভ্যুত্থানে নারীর অংশগ্রহণ প্রায় ৪০ শতাংশ ছিল। টেলিভিশনে নারী সাংবাদিকদের অংশগ্রহণ তুলনামূলকভাবে বাড়লেও দৈনিক পত্রিকা ও অনলাইন গণমাধ্যমে সে তুলনায় কম। মালিক এবং সম্পাদক দুই পক্ষ মিলিয়ে গণমাধ্যমে জেন্ডার সমতা বলে মনে করেন তিনি। নীতিমালা করে বাধ্যবাধকতাও সম্ভব।
গণমাধ্যম সংস্কার বিষয়ক কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল আহমেদ বলেন, গণমাধ্যম সংস্কারের জন্য আমি বলছি কম শুনছি, পড়ছি, জানার চেষ্টা করছি বেশি। আর যাতে কোনো গণমাধ্যম অফিস পুড়িয়ে দেওয়া না হয় সেজন্য কি করা যায় সেটা নিয়ে একটা নীতিগত অবস্থান তৈরি করতে হবে। বাংলাদেশ বেতার সংস্কারের জন্য একটা কমিশন গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিশনের রিপোর্ট সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে খুঁজে পাওয়া যায়নি। ১৯৮৩ সালে প্রেস কমিশন গঠিত হয়েছিল। সেটারও রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। কোনো কিছুই গণমাধ্যমে চাপিয়ে দিলে হবে না। সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে কথা বলে এ সনদ বাস্তবায়ন করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।
দৈনিক আজকের পত্রিকার সম্পাদক ড. গোলাম রহমান বলেন, এ জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ সব গণমাধ্যমকর্মীর কাছে পৌঁছে দিতে হবে। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে হবে। জেন্ডার বিবেচনায় বৈষম্যহীন পরিবেশ তৈরি করতে হবে। তাতে করে সব সীমাবদ্ধতা জয় করে এগিয়ে যাবে নারীরা।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস বলেন, মিডিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হলো সমাজের বিভিন্ন দিককে প্রতিফলিত করা। গণতন্ত্রের জন্য নারী ও পুরুষকে সমানভাবে চিত্রিত করা অত্যাবশ্যক।
তিনি আরও বলেন, গণতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে এবং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমের নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। গণমাধ্যমে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সহনশীল পরিবেশ তৈরি করতে হবে। গণমাধ্যমে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে নারীদের অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। মানসম্মত সাংবাদিকতা নিশ্চিত করতে হবে।
চ্যানেল ২৪-এর নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন বলেন, গণমাধ্যম খুবই চ্যালেঞ্জিং সময় পার করছে। এ সনদ বাস্তবায়িত হলে গণমাধ্যম কর্মীরাই উপকৃত হবেন। স্বাক্ষরটাই শেষ কথা নয়, এটা বাস্তবায়ন করাই আসল কাজ। তবে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে এটার শুরু হলো।
পিআইবির মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেন, নতুন কোনো গণমাধ্যম আসার পর তাদের কর্মীদের জেন্ডার-বিষয়ক অঙ্গীকার সনদ ও জেন্ডার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত পিআইবি। গণমাধ্যমে কাউকে একক ক্ষমতাবান করা উচিত নয়। গণমাধ্যমে কর্মীদের স্বার্থে একদিন নয়, দু’দিন ছুটি চালু করা উচিত বলেও মত দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহিম আহমেদ, যশোর থেকে প্রকাশিত লোক সমাজ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনোয়ারুল কবির নান্টু, যশোরের গ্রামের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক মবিনুল ইসলাম মবিন, রাজশাহী থেকে প্রকাশিত সোনার দেশ পত্রিকার সম্পাদক হাসান মিল্লাত, মানবাধিকার কর্মী হোচি মিন।
জেইউ/এসএসএইচ