বছরজুড়ে ২৯০ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন বলে উল্লেখ করেছে আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)।

রোববার (৩১ ডিসেম্বর) প্রেসক্লাবে বাংলাদেশ মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০২৩-আইন ও সালিশ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

সম্মেলনে আসকের নির্বাহী পরিচালক ফারুক হোসেন বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন অন্তত ৭৮ জন সংবাদকর্মী। সংবাদ প্রকাশের জের ধরে বাংলা নিউজ২৪.কম জামালপুর প্রতিনিধি ও ৭১ টিভির বকশীগঞ্জ উপজেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিমকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়াও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী দ্বারা লাঞ্ছিত ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বাধা প্রদানের শিকার হয়েছেন ২২ জন সাংবাদিক।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ ১৪টি রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বর্জন করায় ইতিমধ্যে নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং অংশগ্রহণমূলকতা নিয়ে দেশে বিদেশে নানা প্রশ্ন ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি হয়েছে।

২০২৩ সালের বার্ষিক মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ বছরেও শান্তিপূর্ণ সভা সমাবেশে বাধা দেওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গায়েবি মামলা, রাজনৈতিক গ্রেপ্তার, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, হেফাজতে নির্যাতন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের আইনবহির্ভূত আচরণ, ধরে নিয়ে যাওয়ার পর গুম করার অভিযোগ, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা অব্যাহত রয়েছে।

১৩ নভেম্বর জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউয়ের (ইউপিআর) আওতায় বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচিত হয়েছে এবং উপরোল্লিখিত মানবাধিকার ইস্যুগুলো নিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য দেশ বাংলাদেশকে প্রায় ৩০০ সুপারিশ করেছে। পর্যালোচনার পরপর ১৪ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে অফিস অব দ্য হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানায়, বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির ক্রমেই অবনতি ঘটছে।

তিনি বলেন, বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে- জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যায্য মজুরির দাবিতে শ্রমিকদের বিক্ষোভে দমনপীড়ন চালানো হয়েছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক কর্মীদের আন্দোলনেও চলছে দমনপীড়ন। এ ছাড়া সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের নেতাদের বিচারিক হয়রানি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিক্ষোভ-আন্দোলন দমাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শক্তি প্রয়োগ, ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া পরিবারের সদস্যদের হয়রানি, ভয় দেখানো এবং বেআইনিভাবে আটক রাখার অভিযোগ সামনে এসেছে।

তিনি আরো বলেন, নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের ক্ষেত্রে এ বছর র‍্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা ছিল। বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার অন্যতম উদাহরণ এটি। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো সরকার ক্রমাগত প্রত্যাখ্যান করেছে এবং সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ এসব অভিযোগকে দেশি-বিদেশি প্রচারণার অংশ হিসেবে উল্লেখ করে নানা ধরনের দুঃখজনক মন্তব্য করেছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে অনেক সময় বলা হয়, বাহিনীতে কর্মরত যে কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উত্থাপন হলে তা গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হয়। এ ধরনের বিষয়ে যদি যথাযথ তদন্ত করা হয় তাহলে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কি ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে থাকে কিংবা ইতিপূর্বে নিয়েছে সে বিষয়ে কোনো তথ্য কিন্তু জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। নিজ বাহিনীর সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ, নিজ বাহিনী তদন্ত করলে প্রকৃত সত্য কিংবা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে না। কাজেই প্রকৃত ঘটনা উদ্ঘাটনে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা আবশ্যক।

অন্যদিকে এ সময়কালে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় বাবা মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে শরীয়তপুর ও গাজীপুর জেলায়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা আছে, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা দেওয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডাণ্ডাবেড়ি পরানো সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও ব্যত্যয় ঘটেছে। উল্লেখ্য রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে কিংবা সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার কারণে যারা আটক বা গ্রেফতার হচ্ছেন, তাদের প্রতি এ ধরনের আচরণ শিষ্টাচার বহির্ভূত; একইসঙ্গে মানবাধিকারের মূল চেতনার পরিপন্থি।

সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার রক্ষায় আসক যেসব সুপারিশ তুলে ধরে সেগুলো হলো-

১. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দ্বারা যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা যেমন- বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুমের অভিযোগ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এখতিয়ার বহির্ভূত আচরণ ইত্যাদির অভিযোগ উঠলে তা দ্রুততার সাথে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করতে হবে এবং সম্পৃক্তদের যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে শান্তি প্রদান করতে হবে।

২. এ পর্যন্ত সংঘটিত সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে নিরপেক্ষ কমিশন গঠন করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।

৩. দেশের যে কোন নাগরিককে আটক বা গ্রেফতারের ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের নির্দেশনা সম্পূর্ণভাবে মেনে চলতে হবে এবং এর ব্যত্যয় ঘটলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।

৪. মিথ্যা মামলা ব্য গায়েবি মামলা সংক্রান্ত যে অভিযোগসমূহ উঠেছে সেগুলো আমলে নিয়ে অভিযোগের যথাযথ নিষ্পত্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৫. নাগরিকের সমবেত হওয়ার অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশের অধিকার যথাযথভাবে চর্চা করার পরিবেশ তৈরি এবং জনদুর্ভোগ এড়ানোর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ভিন্নমত প্রকাশকারীদের বিরুদ্ধে বলপ্রয়োগ কিংবা কোনো ধরনের ভীতি প্রদর্শন থেকে বিরত থাকতে হবে।

৬. আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে পেশাদারীত্বের আওতায় রেখে তাদের কর্ম পরিধি নিশ্চিত করতে হবে।

৭. নারীর সমানাধিকার নিশ্চিত করতে বিদ্যমান বৈষম্যমূলক আইনগুলোতে পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ও যৌন হয়রানি রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য তদন্ত সাপেক্ষে আইন অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

৮. ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরি করে যেন সহিংসতার ঘটনা না ঘটে তার জন্য পর্যাপ্ত সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িতদের সুষ্ঠু তদন্তসাপেক্ষে বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নিজ বিশ্বাস ও রীতি চর্চার অধিকার এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

৯. মানবাধিকারকর্মী ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রস্তাবনা অনুযায়ী জাতীয় মানবাধিকার কমিশন আইন, ২০০৯ দ্রুততার সাথে সংশোধন করতে হবে। কমিশনের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগের জন্য একটি উন্মুক্ত ও অংগ্রহণমূলক পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।

১০. পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি সমতলের আদিবাসীদের সাংবিধানিক অধিকার এবং সাংস্কৃতিক জীবনযাত্রার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

১১. কাঙ্ক্ষিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানবাধিকার সুনিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসাবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। 

১২. দেশে সুস্থ রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক চর্চা নিশ্চিত করার মাধ্যমে নাগরিকদের অধিকার ভোগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে।

১৩. সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের কর্মস্থলে পরিবারসহ বাধ্যতামূলক অবস্থানের জন্য পূর্বের ন্যায় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

১৪. অভিবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা ও সহযোগিতায় বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে জরুরি হেল্পলাইন নম্বর চালুসহ অন্যান্য কল্যাণমূলক ব্যবস্থা বিস্তৃত করতে হবে।

১৫. রাজনৈতিক দলগুলো যেন শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভিত্তিতে এবং সমঝোতার মাধ্যমে সব সমস্যা সমাধান করে, সে ব্যাপারে সব পক্ষকে দায়িত্বশীল হতে হবে।

ওএফএ/পিএইচ