স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে জাতীয়ভাবে প্রত্যাখ্যানের আহ্বান
১০ এপ্রিলকে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে জাতীয়ভাবে প্রত্যাখ্যান করার আহ্বান জানিয়েছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও জ্যৈষ্ঠ সাংবাদিক আবেদ খান।
মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ''স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র : ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এবং একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্ম'' শীর্ষক কনফারেন্সে এ আহ্বান জানান প্রবীণ এ সাংবাদিক।
বিজ্ঞাপন
আবেদ খান বলেন, আমাদের একটি বড় দুর্বলতা হচ্ছে আমরা আমাদের গৌরবময় ইতিহাসকে সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে পারিনি। আমাদের অসংখ্য মানুষ, বিশেষত তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানেন না। কেউ কেউ আবার ভুলভাবে জানেন বা প্রচার করেন।
প্রবীণ এ সাংবাদিক বলেন, নতুন প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে দীক্ষিত করে তুলতে হবে এবং তাদের ভেতরে ১০ এপ্রিলের চিন্তা, ভাবনা ও চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আর এটা করতে না পারাই হবে আমাদের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব 'ল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) কর্তৃক আয়োজিত দুই দিনব্যাপী এ কনফারেন্সের সমাপনী দিনে ভারত ও বাংলাদেশের খ্যাতিমান রাজনীতিবিদ, ইতিহাসবিদ এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সন্তানসহ দেশ-বিদেশের স্বনামধন্য আলোচকরা অংশ নেন।
বিলিয়ার অনারারি সেক্রেটারি এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীরের সঞ্চালনায় সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সেক্রেটারি জেনারেল বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন হাবিব তার বক্তব্যের শুরুতে ব্যারিস্টার এম. আমীর-উল ইসলামের প্রতি বিশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সম্পর্কিত আলোচনা জনসম্মুখে তুলে আনার উদ্যোগটি অত্যন্ত সময়োপযোগী।
তিনি উল্লেখ করেন, শুধুমাত্র ভারতীয় সেনাবাহিনী নয় বরং সর্বভারতীয় সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ যেভাবে নৈতিক উপায়ে সহায়তা করেছেন তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
হারুন হাবিব উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও বাংলাদেশ আসলে শত্রুমুক্ত হয়েছে কি না, তা বিশেষভাবে ভেবে দেখা দরকার। কেননা, বাংলাদেশের জন্মের অন্যতম ভিত্তি ছিলো অসাম্প্রদায়িক চেতনা। অথচ স্বাধীনতার ৫২ বছর পার হলেও আমরা সেই অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে পারিনি।
বিচারপতি এএইচএম শামছুদ্দীন চৌধুরী বলেন, ১৯৭১ সালের পরের প্রজন্ম বা নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র কী, অনেকেই আবার জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক মনে করেন। ১৯৭১ সালে যারা স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিলো, সেই অপশক্তি ৭৫-এর পরের ২১ বছর ধরে পাকিস্তান প্রেমীদের দ্বারা প্রলোভিত হয়েছে, নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। নতুন প্রজন্ম বা পরবর্তী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে জানানো এবং সচেতন করে তোলার জন্য এ ধরনের আলোচনা অনুষ্ঠান বার বার আয়োজন করা দরকার।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে বাঙালি জাতির জন্মসনদ উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম আইন, এই আইনের মাধ্যমে আগের আইনগুলোর ধারাবাহিকতাকে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
বেশ কিছু দেশের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দেশের জনগণ থেকে আসে। তবে আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা স্বীকৃত না হলে সেই দেশকে আর স্বাধীন দেশ বলা যায় না।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না পেলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা পূর্ণতা পেত না বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তিনি বলেন, ভারত-সোভিয়েত সমঝোতা চুক্তি না হলে আমাদের বিজয় অর্জন করা আরও কঠিন হয়ে যেত।
জিয়াউর রহমানের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বাংলাদেশে পাকিস্তানাইজেশন শুরু করে জেনারেল জিয়া। সংবিধানে ধর্মকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ধর্ম রাজনীতি শুরু করেন।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান রিসার্চ ইনিশিয়্যাটিভস বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র হচ্ছে বাংলাদেশের ফাউন্ডেশনাল প্রিন্সিপল।
দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি এখনও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে দেশাত্মবোধ জাগিয়ে তোলা ও ধরে রাখার জন্য স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রকে পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান প্রজন্ম '৭১ এর সভাপতি আসিফ মুনির বলেন, বিশ্বের কোনো দেশে সাধারণত ইতিহাসকে রাজনীতিকরণ করা হয় না। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে- বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস এখনও পর্যন্ত নির্মোহভাবে রচিত হয়নি। এক্ষেত্রে প্রজন্ম '৭১ এবং বিলিয়ারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদানের জায়গাটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তবে এটা করতে হলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা একান্ত প্রয়োজন।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উপর চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং ডকুমেন্টারি তৈরিসহ সম্ভাব্য সকল উপায়ে এটাকে ছড়িয়ে দেয়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন আসিফ মুনির।
শহীদ বুদ্ধিজীবীর সন্তান অধ্যাপক ড. নুজহাত চৌধুরী বলেন, নারীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন করতে হলে তাদের বিষয়ে চলমান নেতিবাচক মনোভাব ও সমালোচনা বন্ধ করতে হবে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, দেশের মানুষ যদি মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যথাযথভাবে জানত, তাহলে বাণিজ্যমেলায় পাকিস্তানি পণ্য কেনার জন্য এতটা ভিড় হত না। এটা খুবই আশঙ্কার বিষয় যে- আমাদের ধর্ম পরিচয় এবং জাতীয় পরিচয়ের মধ্যে বৈপরীত্যে তৈরি করে সাম্প্রদায়িক সংকট সৃষ্টি করা হচ্ছে।
তিনি মন্তব্য করেন, '৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হারিয়েছি; আর এটাই ছিল আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।
বাংলাদেশ সম্মিলিত ইসলামি জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান বলেন, নতুন প্রজন্মের নিকট মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তথা যে অসাম্প্রদায়িক মনোভাব এবং সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বাধীনতার সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছিল তা তুলে ধরতে হবে।
জাতীয় চার নেতাসহ ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের জীবনী পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তোলেন মাওলানা জিয়াউল হাসান। তিনি বলেন, এর ফলে নতুন প্রজন্ম অনুপ্রাণিত হবে।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সমালোচনা করে তিনি দাবি করেন, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে পরাহুত করে ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে জাতিকে সামনে এগিয়ে নিতে হবে এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় ৭১'এর সংবিধানের চেতনাকে পুনরুদ্ধার করতে হবে।
দুই দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এ কনফারেন্সে আলোচকদের অনেকেই ১০ই এপ্রিলকে 'রিপাবলিক ডে' ঘোষণার দাবি জানান।
এনআই/এমজে