সকালে অনেক দেরিতে ঘুম ভাঙ্গে শাহরিকার, সাধারণত এমনটা হয়না। প্রতিদিন রাত দশটার মধ্যে ঘুমায় সে, আর ভোর পাঁচটায় ওঠে। এটা দৈনন্দিন ঘুমানোর রুটিন তবে মাঝে-মধ্যে মিস হয়ে যায়। বিশেষ করে পরীক্ষার সময়টাতে। তখন পড়াশোনার চাপ এত বেশি থাকে যে পর্যাপ্ত ঘুমটাও হয় না।বড্ড দেরি হয়ে গেলো! জলদি ফ্রেশ হয়ে বান্ধবী নওশীনের বাসায় যেতে হবে। টানা কয়েকদিন বিশ্ববিদ্যালয় ফাঁকি দিয়েছে শাহরিকা। পড়াশোনার ব্যাপারে এতটা উদাসীনতা তাকে মানায় না। হাতে মাত্র এক মাস সময় বাকি, তার ওপর দিয়ে প্রচুর ঝড় আসবে। 

তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে পড়ে নওশীনের বাসার উদ্দেশ্যে, নওশীন খুব গুণী মেয়ে। যেমন মেধা, তেমনই তার শৈল্পিক দক্ষতা। ছবি আঁকা থেকে কবিতা লেখা সবদিকেই সমান পারদর্শী। যত নোট ছিল সবগুলো সংগ্রহ করে শাহরিকা যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বান্ধবী নওশীনের প্রতি এক বুক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে আবার ফিরে নিজের হোস্টেলে। আর সময় নষ্ট করা চলবে না, পরীক্ষায় ভালো কিছু করতেই হবে। 

দেখতে দেখতে পরীক্ষার দিন ঘনিয়ে এলো। হাতে বাকি আর কয়েকটা দিন, চাপ যেন একটু বেশিই হয়ে যাচ্ছে। শাহরিকা সারাদিন বই পড়ে কিন্তু সেগুলো নয় যেগুলো পড়লে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করা সম্ভব। অ্যাকাডেমিক বই বাদে শাহরিকা অন্যান্য সব বই পড়ে। এটা নিয়ে বাসায় তার মায়ের সাথে কম ঝগড়া হয়নি। সে এক বিশাল ইতিহাস, তবুও সংক্ষেপে কিছু কথা বলি- হাইস্কুলে পড়ার সময় শাহরিকা তার পরীক্ষায় খুব বাজে ফলাফল করে। মায়ের বুঝতে বাকি থাকে না মেয়ের মনোযোগ অন্য পড়াশোনায়। খুব বকাঝকা করেও তেমন কোনো কাজ হয়নি, বরং মেয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে গল্পের বইয়ে হারিয়ে যেত সারাদিন। একটা সময় পরিস্থিতি এমন অবস্থায় দাঁড়ায় যে শাহরিকার গল্পের বইগুলো তার মা আলমারিতে তালাবদ্ধ করে রাখে। সে এক ভীষণ দুঃখের স্মৃতি, আর জাগ্রত না করি। 

পরীক্ষা দরজায় কড়া নাড়ছে কিন্তু মাথায় পড়াশোনার চাপ অসহনীয় হয়ে উঠেছে। কিছুই আর ঢোকে না, যা পড়ে সব ভুলে যায়। এবার একটু বাসার বাইরে না গেলেই নয়। বান্ধবী জেরিনকে ফোন...  

শাহরিকা : হ্যালো, কেমন আছিস?

জেরিন : আছি মোটামুটি, তোর কি অবস্থা? 

শাহরিকা : চলছে কোনোমতে কিন্তু ভালো না। আচ্ছা শোন, কি করিস?

জেরিন : পরীক্ষার আগ মুহূর্তে কি করবো বলে তোর ধারণা? 

শাহরিকা : সারা বছর তো পড়াশোনা করেছিস, এখন আর বিদ্যাসাগর না হলেও চলবে।

জেরিন : বিদ্যাসাগর মানে কি! আমি তো সিলেবাস শেষ করতে পারিনি।

শাহরিকা : একটা কথা বলতে চাচ্ছিলাম... 

জেরিন : হ্যাঁ, তো বলে ফেল!

শাহরিকা : পড়াশোনাটা মনে হয় একটু বেশি হয়ে গেছে। মাথা এতো চাপ নিতে পারছে না। তোর কি অবস্থা?

জেরিন : আমারও তো একই অবস্থা।

শাহরিকা : তাহলে তোর কি মনে হয় না আমাদের বিকেলে একটু কোথাও ঘুরে আসা উচিত? 

জেরিন : না, মনে হয় না। পরীক্ষার আগে কীসের ঘোরাফেরা? আর তাছাড়া অনেক পড়া বাকি আছে। যত ঘোরাঘুরি সব পরীক্ষার পরে হবে।

শাহরিকা : আরে! ঘোরাঘুরি মানে তেমন কিছু নয়। ঘণ্টা খানেকের জন্য কোথাও গিয়ে চলে আসবো। 

জেরিন : এক ঘণ্টার ঘোরাঘুরি করতে তিন ঘণ্টা তিনেক নষ্ট হবে। তারচেয়ে একটু রেস্ট করে পড়, দেখবি চাপ কম মনে হবে।

শাহরিকা : তাহলে যাবি না এটাই তো?

জেরিন : হ্যাঁ যাবো না। রেডি হতে অনেক সময় লাগবে, ঘুরতে সময় লাগবে, আবার বাসায় ফিরে রেস্ট করতেও সময় লাগবে৷ এটা তো খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয়ে গেলো। তুই অন্য কাউকে দেখ।

শাহরিকা : ওকে, যেমনটা তোর ইচ্ছা। 

ইশিতা নিঃসন্দেহে লক্ষ্মী মেয়ে। শাহরিকার সাথে তার দারুণ সম্পর্ক যেন দুইটি দেহে একটি প্রাণ। শাহরিকা জানে আর কেউ না হোক, ইশিতার তার সকল অন্যায় আবদার চোখ বন্ধ করে মেনে নেবে। যেই ভাবা সেই কাজ, ইশিতাকে ফোন করে রাজি করায় সে। বিকেলে একটু ঘোরাঘুরি করে মনটা ফ্রেশ অনুভব হয়। ফেরার পথে শাহরিকার মনে হলো যেহেতু বাইরে এসেই গেছি তাহলে একটু বইয়ের দোকানে গেলে মন্দ হয় না।

বিশেষ করে মনোবিজ্ঞান তথা সম্মোহনী বিষয়ে তার কয়েকদিন ধরে দারুণ আগ্রহের জন্ম হয়েছে। একটি লাইব্রেরিতে গিয়ে খোঁজার পর পার্সিয়ান সম্মোহনী বিষয়ক বই পায় যেটা মূলত ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করা। বই কিনেই দুইজনে নিজেদের গন্তব্যের দিকে রওনা দেয়। সন্ধ্যায় কি যেন মনে হলো, শাহরিকার নতুন বইটা পড়ার খুব ইচ্ছা হলো। তার মন কিছুতেই বইটা থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারছে না। 

আচ্ছা কিছুক্ষণ পড়লে কি এমন ক্ষতি হবে! এমন ভাবনা থেকে পড়া শুরু করে শাহরিকা দেখতে দেখতে ঘণ্টাখানেক পড়লো। তার মনোবিজ্ঞান সম্পর্কে আগ্রহ যেন বাড়তেই থাকলো। এ এক আশ্চর্য ব্যাপার। বইটা যতই পড়ে ততই যেন চুম্বকের মতো টানে। পড়া শেষ করতে মন চায় না। তবে ক্রমশই শাহরিকা বুঝতে পারলো এটা মোটেই কোনো মনোবিজ্ঞানের বই নয় বরং প্রাচীন পার্সিয়ান সম্মোহনী বই যা মানুষকে ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। কল্পনার জগৎ তৈরি করে মানুষকে গভীর সম্মোহনে ডুবিয়ে রাখে। হঠাৎ এশার আজান কানে আসায় তার হুঁশ ফিরলো, সে অনেকটা সময় ব্যয় করে ফেলেছে এই বইটা পড়ে। আর নয়, এবার পরীক্ষার পড়া পড়তেই হবে। নিজের ওপরই রাগ করে শাহরিকা আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ায় মনোনিবেশ করলো। 

নির্ধারিত সময়ে পরীক্ষা শুরু ও সমাপ্তি হলো। দেখা গেলো শাহরিকা যতটা প্রত্যাশা করেছিলো তার চেয়ে ফলাফল অনেক ভালো হয়েছে। পাঁচ বান্ধবী মিলে সারাদিন অনেক ঘোরাঘুরি করলো, রেস্টুরেন্টে খেতেও গেলো। ফোনে ছবি তুললো পাশাপাশি অনেক গল্প করলো। কারণ তাদের সবারই পরীক্ষা তুলনামূলক ভালো হয়েছে। আপাতত পুরো মাসটা আর পড়াশোনার চিন্তা করতে হবে না। 

তবে এতো আনন্দের মাঝেও এক দুঃখের বার্তা নিয়ে হাজির হলো খোদ জেরিন নিজেই। তার মামা ভীষণ অসুস্থ, হাসপাতালে ভর্তি হয়ে আছে। তার মা আগামীকাল হাসপাতালে যাবে, বাসায় বাবা একা থাকবে। এমতাবস্থায় তার পক্ষে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব নয় বলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে জানিয়ে দিলো। জেরিনের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে বান্ধবীরা আর কোনো আপত্তি তুলনা না। 

শাহরিকা : তোর মামার জন্য আমরা দোয়া করি, আল্লাহ দ্রুত সুস্থতা দান করুক। আর তোকে ছাড়া ঘুরে আমাদের কোনো আনন্দই হবে না। তুই উদ্যোগ নিলি, অথচ তুই থাকতে পারলি না।

জেরিন : শোন, আমি যেহেতু একবার গিয়েছি, সবকিছু ঘুরে দেখেছি। তোরা ঘুরে আয়। ইনশাআল্লাহ সময় সুযোগ হলে পরে আবার যাওয়া যাবে৷

ইশিতা : তাহলে আমরা চারজন যাচ্ছি?

জেসমিন : হুমম, আপাতত সেটাই মনে হচ্ছে। 

শাহরিকা : আচ্ছা, তাহলে আমাদের চট্টগ্রাম যাবার প্রস্তুতি কতদূর? 

জেরিন : আব্বুর সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলেছি। আঙ্কেল বেশ আমোদপ্রিয় একজন লোক। তোরা গেলে তিনি খুশি হবেন।

জেসমিন : উনি কি করেন?

জেরিন : উনার নাম দিদাত আহমদ। যতটা শুনেছি আগে দেশের বাইরে থাকতেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন। এখন চট্টগ্রামে স্ত্রী নিয়ে থাকেন। দুই সন্তান আছে, তবে তারা দেশের বাইরে থাকে।

শাহরিকা : আমরা তাহলে আগামীকাল একটু রেস্ট করে পরশুদিন রওনা দেবো?

জেরিন : হ্যাঁ, তোরা পরশুদিন ভোরে রওনা দিবি। আশা করি বিকেলের আগেই পৌঁছাতে পারবি। তোদের সমস্ত দেখাশোনা আঙ্কেল নিজে করবেন। 

চলবে...