সব সম্ভব! তারুণ্যে বদলাবে বাংলাদেশ
সাম্প্রতিক বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে দেশের তরুণ প্রজন্ম আবারো দেখিয়েছে তারা কি করতে পারে। তরুণ বয়সটা সব বৃত্ত ভাঙার। অসম্ভব জেনেও সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার। কোনো ব্যর্থতাকে ব্যর্থতা মনে না করার। বড় চিন্তা করার। ভালো চিন্তা করার। কারণ সে বিশ্বাস করে, সম্ভবের নির্দিষ্ট কোনো সীমানা নেই। বাংলাদেশের জেন-জেড প্রজন্ম বিশ্বাস করে—সব সম্ভব। এমনই শত তরুণের জীবন জয়ের গল্প নিয়ে সংকলন ‘সব সম্ভব’।প্রায় শতাধিক তরুণের জীবন জয়ের গল্প রয়েছে বইটিতে। বইটি প্রকাশ করেছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
বইটির নাম ভূমিকা পড়ে প্রশ্ন হতে পারে, কীভাবে বদলে গেল তাদের জীবন? একটি শিক্ষালয়—কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ বদলে দিয়েছে তাদের জীবন। বান্দরবানে লামায় স্কুলটির অবস্থান।
বিজ্ঞাপন
মেধার কোনো জাত নেই পাত নেই। সুযোগ পেলে যে কেউ নিজ গুণে বিকশিত হতে পারে—এই বিশ্বাস নিয়ে ২০০১ সালে বান্দরবানের প্রত্যন্ত এলাকায় কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ আল বোখারী মহাজাতক গড়ে তোলেন এ বিদ্যাপীঠ। মাত্র সাতজন শিশুকে নিয়ে যাত্রা শুরু। বর্তমানে বাঙালিসহ ২২ জাতির আড়াই হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ধ্যানে জ্ঞানে প্রযুক্তিতে আলোকিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠছে এখানে।
কারো হয়ত বাবা নেই, কারো মা নেই, কারো দুজনই নেই, আবার কারো বাবা-মা থেকেও আর্থিকভাবে অসহায়, কারো লেখাপড়ার পরিবেশ ছিল না—এমন অবস্থায় এই স্কুলে শিশুরা এসেছে চার কিংবা পাঁচ বছর বয়সে, নয়তো স্কুল জীবনের কোনো না কোনো ধাপে। আবার কেউ কেউ ভর্তি হয়েছে কলেজে।
সেই শিশু বয়সেই তারা পেয়েছে নিয়মিত মেডিটেশন, ইয়োগা, লেখাপড়া, খেলাধুলা, শুদ্ধাচার চর্চার পাশাপাশি ‘জীবনে ১ম’ হওয়ার ভাবনা বা মনছবি। এই স্কুলের ছোট্ট কোনো শিশুকে ‘বড় হয়ে তুমি কী হবে’ জিজ্ঞেস করলে, নিজের নামটা ঠিকমতো বলতে না পারলেও সে বলতে পারে—‘পথম’ (প্রথম) হবো। এই প্রথম হওয়ার মনছবির শক্তিতেই তারা আজ অধিকাংশ পড়ছে দেশের স্বনামধন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। জাতীয় শিশু-কিশোর কুচকাওয়াজ প্রতিযোগিতায় প্যারেড ও ব্যান্ড বাদনে (২০১৫-২০১৯) টানা পাঁচ বার প্রথম হয়ে সারাদেশে নজর কেড়েছে। এছাড়াও ক্রীড়ানৈপুণ্যে দেশসেরা স্কুল হয়েছে পর পর চার বার (২০১৭-২০২০)।
কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের বলা হয় কোয়ান্টা। অর্থাৎ প্রত্যেকে একটা করে আলোকগুচ্ছ।
এই বই পড়তে গিয়ে একজন পাঠক যেমন জীবন বদলে দেওয়ার শতাধিক ঘটনা জানবেন, তেমনি পাবেন আমাদের দেশের প্রান্তিক মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রামের বাস্তব চিত্র, তাদের আশা-নিরাশার গল্প। আর ঋণ, তামাক চাষ, মাদক, অবিদ্যা, কুসংস্কার, ডিজিটাল আসক্তির মতো সমাজের নানা অসঙ্গতির খণ্ড খণ্ড চিত্র। তাদের এই গল্পগুলোর নেপথ্যে উঠে আসবে কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজের ২৩ বছরের ইতিহাস। কোয়ান্টামমের ইতিহাস। শূন্য থেকে শুরু করার ইতিহাস। অসম্ভবকে সম্ভব করার ইতিহাস। আসলে তিন দশক আগে সাধারণ মানুষের ভাবনারাজ্যে কোয়ান্টাম যে মানবিক মহাসমাজের বীজ বুনেছিল, তারই ক্রমবিকশিত রূপ এই কোয়ান্টামম এবং এই শিক্ষাঙ্গণ।
পাঠক আপনি যে বয়সের হোন না কেন, তারুণ্য শক্তিকে অনুভব করবেন। আপনি অনুপ্রাণিত হবেন। নতুন শুরুর একটা তাগিদ পাবেন। এই তরুণদের প্রত্যেকের মতো আপনিও বলে উঠবেন—সব সম্ভব! এই বই দেশের বিভিন্ন স্থানে জন্ম নেওয়া অবহেলিত অবস্থা থেকে সাফল্যের শীর্ষে যাওয়ার পথচলার গল্প উঠে এসেছে। প্রায় চারশো পৃষ্ঠার বইটি দাম রাখা হয়েছে পাঁচশ টাকা। অনলাইনে ও পাওয়া যাচ্ছে।
এখন দেশে জনশক্তির বোনাসকাল অতিক্রম করছে। অর্থাৎ দেশে জনসংখ্যায় যুবশক্তি বেশি। কিন্তু এখানে বলে রাখা প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়নের সঙ্গে দেশে যদি সৎ, মানবিক ও ইতিবাচক উদার দৃষ্টিসম্পন্ন ভালো মানুষ না হয় তাহলে সত্যিকারের ভালো দেশ হয়ে ওঠা যাবে না। শারীরিক সুস্থতা, মানসিক সুস্থতা, আত্মিক সুস্থতা, সামাজিক সুস্থতা না থাকলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না।
ভালো মানুষ তৈরির জন্য এখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নিতে হবে যুব সমাজকে দিয়ে। তাদেরকে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। তাই প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত টোটাল ফিটনেস বা সম্পূর্ণ সুস্থতা কারিকুলামে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এ সময়ে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে দ্রুত বদলে যাওয়ার উত্তাপ লেগেছে। প্রযুক্তির প্রসার ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে অনেক মন্দ বা ক্ষতিকর কিছুতে সহজে মানুষ অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। জীবন যাত্রার মান বাড়ার ফলে আমরা নিজেদের অনেক ঐতিহ্য আভিজাত্যও হারিয়ে ফেলছি। পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষায় শুদ্ধাচার, শিষ্টাচার নীতি নৈতিকতা হারিয়ে ফেলছি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নীতি নৈতিকতা ও সৎ মানুষ বানানোর পরিবর্তে শুধু সনদ অর্জনই অন্যতম বিষয় হয়ে উঠেছে।
যতদিন এ দেশের দুঃখী মানুষ পেট ভরে খেতে না পারে, যতদিন অত্যাচার ও অবিচারের হাত থেকে তারা না বাঁচবে, যতদিন না শোষণমুক্ত সমাজ হবে, ততদিন সত্যিকারের মানবিক বাংলাদেশ হবে না। আগেও বলেছি আমাদের দেশে এখন জনশক্তির বোনাসকাল (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট) চলছে। অর্থাৎ এ সময়ে মোট জনশক্তির মধ্যে তরুণ জনশক্তি বেশি। আমার বিশ্বাস, এই তরুণরাই বাংলাদেশ কে বদলাতে পারে, নিয়ে যেতে পারে সমৃদ্ধির শিখরে। এজন্য একসঙ্গে কাজ করতে হবে সবাইকে নিয়ে। বাংলাদেশের ঐতিহ্য, পারিবারিক-সামাজিক বন্ধন সবকিছুই তুলে ধরে। অর্থাৎ আমরা এক মহান জাতি ছিলাম, আমাদের এক মহান ইতিহাস ছিল। ফলে সমৃদ্ধ অর্থনীতির সাথে সাথে আমরা উন্নত মানবিক সম্পন্ন সুস্থ মানুষ হিসেবে পরিচয় অর্জন করবো।
ভালো মানুষের সংজ্ঞা এখানে কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি- ‘নীতি নৈতিকতাবান শুদ্ধাচারী মানুষই ভালো মানুষ। যা কিছু ভালো, যা কিছু কল্যাণকর তা-ই শুদ্ধ। যা কিছু মন্দ, যা কিছু অকল্যাণকর তাই অশুদ্ধ। যা কিছু সত্য, সুন্দর ও শুভ তা-ই শুদ্ধ। যা কিছু অসত্য, পঙ্কিল ও অশুভ তা-ই অশুদ্ধ। যা কিছু ন্যায় ও মানবিক তা-ই শুদ্ধ। যা কিছু অন্যায়, জুলুম ও অমানবিক তা-ই অশুদ্ধ। যা শুদ্ধ ও কল্যাণকর তা-ই ধর্ম আর অশুদ্ধ ও অকল্যাণকর তা-ই অধর্ম।
কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের পক্ষে বইটি প্রকাশ করেছেন মায়িশা তাবাসসুম। প্রচ্ছদ শিল্পী শান্ত খিয়াং। সম্পাদনা করেছেন শরিফুল ইসলাম, উক্য এ মার্মা। প্রকাশকাল ২০২৪ সেপ্টেম্বর।
এমএ