প্রভাতে ইট পাথরের যান্ত্রিক জীবনকে ঘিরে এ শহরে কোকিলের ন্যায় মোয়াজ্জিনের সুমধুর কণ্ঠে ভেসে আসা আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভেঙ্গে মসজিদে গিয়ে দু’রাকাত ফরজ সালাত আদায়ের পর রবের পানে প্রার্থনায় দু’হাত তুলেছি। মসজিদ থেকে নীড়ে ফিরে পবিত্র গ্রন্থ থেকে তেলাওয়াত করেছি  যা কলবে প্রশান্তির ছোঁয়া এনে দিয়েছে। 

সচরাচর সকালে চা-বিস্কুট পান করে ক্যাম্পাসে যেতে হয়। তবে আজকের দিনটি ভিন্ন ছিল। সিদ্ধ ডিম, ছোলা-বাদাম, মধু আর খেজুর খেয়ে ক্যাম্পাসের উদ্দেশে রওনা দেয়। বাসা থেকে বের হয়ে মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরায় গিয়ে বাসের জন্য মিনিট দশেক অপেক্ষার পর বাসে চেপে জানালার পাশে স্নিগ্ধ বাতাস আর বসন্তের অপরূপ সৌন্দর্যের মায়ায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছি।

পথিমধ্যে মুকুলের ঘ্রাণে শৈশবস্মৃতি নিজের অজান্তে যেন হাহাকার করে বলে উঠলো। ‘জাহিদ তোর সেই সোনালি অতীত কোথায়! কোথায় সেই দিন যখন সকালে উঠে রক্তিমের ন্যায় শিমুল ফুল কুড়াতে যেতি আর মক্তব থেকে বাড়ি ফেরার পথে আমের মুকুল কুড়িয়ে খেলা করতি’।

ভাবনার জগতে স্মৃতির খেলায় মগ্ন হয়ে আফিমের নেশার মতো বুত হয়েছিলাম। বাস ক্যাম্পাসের দরজায় কড়া নাড়লো পাশের সিট থেকে বন্ধু বলে উঠল, ‘ইব্রাহীম কী ভাবছিস আমরা তো ক্যাম্পাসে চলে এসেছি’। আমি অবাক হয়ে তার দু’নয়নের দিকে চেয়ে রইলাম। কীভাবে ঘণ্টা দুয়েক খেয়ালের মাঝেই কেটে গেলো। 

বাস থেকে নেমে পথে স্যারদের সাথে দেখা সালাম বিনিময় শেষে বন্ধুদের সাথে ক্যান্টিনে গিয়ে জীবনের অজানা রসায়ন খোশগল্পে এক নিমিষে ভেঙ্গে চুরে উষ্ণ চায়ের প্রতি চুমুকে উড়িয়ে দিলাম।

ঘণ্টা দুয়েক পর হঠাৎ মুঠোফোনে টুংটাং শব্দ তরঙ্গে ক্ষুদে বার্তা আসলো। স্ক্র্যাচ পড়া নীল স্ক্রিনের দিকে স্বচ্ছ কর্নিয়ায় চোখ বুলাতেই ভেসে উঠলো ‘অনিবার্য কারণবশত আজকে আপনাদের ২৯ ব্যাচের কোন ক্লাস হবে না, পরে অনলাইনে মেকআপ ক্লাস নেওয়া হবে’ 

ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা এগারোটা। ভাবলাম অফিস যেতে হবে ২ টার মধ্যে, হাতে সময় রয়েছে প্রায় ঘণ্টা তিনেক। কৈশরের খেলার সাথি, স্কুল জীবনে খুনসুটি-দুষ্টামীর প্রিয় বন্ধু আয়ানের সাথে দেখা করার জন্য ক্যাম্পাস থেকে বের হয়ে লেগুনায় (পিকআপ ভ্যান) চড়ে আশুলিয়া থেকে মিরপুর ১-এ আসলাম। মিরপুর আসার পরে পড়লাম মহাবিপদে বন্ধুকে কল দিয়ে বললাম, ‘তুই মিরপুর কাঁচা বাজারে চলে আয়’। 

দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর দেখা হলো। তার সাথে গালগল্পের এক পর্যায়ে জিজ্ঞেস করলে সে বলে স্বপ্ন পূরণের জন্য মায়াহীন দূষিত শহরে পাড়ি জমানো। যে শহরে প্রেমিকহীন পুরুষের জন্য নেই কোনো ভালোবাসা। বেকারের খালি পকেটে শুধু রয়েছে বেদনার অশ্রু। মধ্যবিত্তের নিউরনের উদ্দীপনায় রয়েছে পরিবারের দায়িত্ব।

সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা ছেলেটি যখন একটি চাকরির টানাপোড়নে প্রেমিকাকে দেখে ৪০ ঊর্ধ্ব বিসিএস ক্যাডারের পাশে। কোন এক মেয়ে গায়ের শ্যামবর্ণের জন্য পরিবার, বন্ধু মহল থেকে শুরু করে সো কল্ড সভ্য জাতির নিকট উপহাসের পাত্র বনে যায়। পথশিশু যে দুবেলা ভাত পায় না সোনার বাংলাদেশে। 

ঘড়ির কাঁটায় সময়ের দিকে চেয়ে দেখি হাতে রয়েছে ঘণ্টা খানেক। বন্ধুকে বিদায় দিয়ে বললাম। আজ থাক অন্য একদিন না হয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে বসে সমাজের বিবর্ণ  বিষয়াদি নিয়ে আলাপচারিতা করবো। আর আমার সাথে ঘটে যাওয়া মহা বিপদের বিবরণ দিবো। সময় আপন বেগে ছুটে তার গন্তব্যে। আমিও আয়াত বাসে চেপে ছুটে চললাম অফিসের পথে।