ভিয়েতনামি তরুণীর প্রতি ভালোবাসা হার মানায় কবিতার বনলতা সেনকেও
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার দেড় বছর পরে পূর্ব-জার্মান সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে লাইপজিগ শহরে পাড়ি জমান লেখক প্রফেসর শফিকুর রহমান। সেখানে জার্মান ভাষা শেখার সময় তার সঙ্গে পরিচয় হয় বাস্তব জীবনের বনলতা সেনের। তবে এই বনলতা সেন বাংলাদেশের নন। তিনি মার্কিন সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত ভিয়েতনাম সেনাবাহিনীর একজন জেনারেলের মেয়ে। তার নাম ‘ত্রানহা’।
এক বছর ভাষা শেখা শেষে মেডিকেল পড়ার জন্য বনলতা সেন চলে যান জার্মানির উত্তরে, আর লেখককে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার জন্য যেতে হয় সেই দেশের দক্ষিণে। এর ফলে তাদের সবেমাত্র শুরু হওয়া রোমান্সের সেখানেই পরিসমাপ্তি ঘটার কথা। কিন্তু বিভিন্ন অসম্ভাব্য ঘটনার মাধ্যমে শিক্ষা-বছর শুরু হওয়ার আগে তাদের ইউনিভার্সিটি বদলে যায়। দুজন চলে আসেন একই ইউনিভার্সিটিতে। যদিও সেসময় বিদেশিদের সঙ্গে মেলামেশার ব্যাপারে ভিয়েতনামি শিক্ষার্থীদের ওপরে তাদের দেশের সরকারের কঠোর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু এর মধ্যেও তাদের পরিচয় অন্তরঙ্গতায় পরিণত হয়। ডিগ্রি শেষের পরে সম্ভাব্য এক বছরের ইন্টার্নি করার আগেই বনলতা সেন হঠাৎ করে দেশে ফিরে যান। যাওয়ার আগে তিনি লেখককে একটি চিঠির মাধ্যমে তাকে ভুলে যেতে বলেন।
বিজ্ঞাপন
পরিপূর্ণ না হওয়া প্রথম ভালোবাসা সুপ্ত হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কখনোই মরে যায় না। তাই ৩০ বছর পরে লেখক বনলতা সেনকে খুঁজতে শুরু করেন। ভিয়েতনামের নয় কোটি লোকের মধ্যে একজন মানুষকে কি খুঁজে পাওয়া সম্ভব? সম্ভাব্যতা তত্ত্ব ব্যবহার করে, তিনটি মহাদেশের তিনটি দেশ খুঁজে, তিন বছরের মাথায় লেখক তার বনলতা সেনকে ভিয়েতনামের ছোট্ট একটি শহরে খুঁজে পান। কিন্তু বনলতা সেন নাম পরিবর্তন করেছেন কেন, আর কেনই বা তিনি তখনো একা? বাস্তব জীবনের এই ঘটনাগুলো এমন অদ্ভুত যে যুক্তরাষ্ট্রের একটি ফাউন্ডেশন লেখককে এ ঘটনা নিয়ে উপন্যাস লেখার জন্য অনুদান দিয়েছে। এরপর বাস্তবে রূপ নেয় সেই উপন্যাস। আর লেখকের ইচ্ছা অনুযায়ী তা প্রথম বাংলায় ও বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়।
গত ১৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে বইটি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হয়। প্রফেসর শফিকুর রহমানের লেখা প্রথম উপন্যাস ‘ত্রানহার সন্ধানে’ প্রকাশিত হয়েছে জিনিয়াস পাবলিকেশন্স থেকে।
এ প্রসঙ্গে শফিকুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, শীতল যুদ্ধের সময় জার্মানি দুই ভাগের ফলে অসংখ্য ভালোবাসা নষ্ট হয়েছে। অসংখ্য বইয়ে পশ্চিমাদের গল্প উঠে এলেও এশিয়ানদের কোনো ঘটনায় প্রকাশ্যে আসেনি। আমার বইয়ে তা ফুটানোর চেষ্টা করেছি।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে এ লেখক বলেন, প্রথম ভালোবাসা সুপ্ত হয়ে থাকলে তা কখনো মরে যায় না। কেউ যদি কখনো সত্যিকারের ভালোবেসে থাকেন তাহলে বইটি পড়ে দেখতে পারেন। ভালবাসার ভিন্ন রূপ ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছি।
আপাতত বাংলায় প্রকাশিত হলেও ভবিষ্যতে একাধিক ভাষায় বইটি প্রকাশের পরিকল্পনার কথাও জানান তিনি।
একনজরে লেখক পরিচিতি
১৯৫৩ সালে বরিশালের পিরোজপুর শহরে প্রফেসর শফিকুর রহমানের জন্ম। খুলনার ভিক্টোরিয়া স্কুল এবং পরে সেন্ট জোসেফস স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ থেকে মেট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় যশোর বোর্ডের বিজ্ঞান বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করেন। ঢাকা ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কিছুদিন পড়াশোনা করে জার্মানি চলে যান। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে জার্মানির হালে ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
প্রফেসর শফিকুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়ায় বসবাস করছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের এলিগেনি কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস প্রফেসর। সেখানে ডিপার্টমেন্ট হেড এবং সায়েন্স ডিভিশনের কারিকুলাম প্রধান হিসেবেও কাজ করেছেন। এছাড়া একাধিক প্রতিষ্ঠানে গবেষণা করেছেন। পদার্থবিজ্ঞান ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে তার অনেক নিবন্ধ প্রকাশ পেয়েছে।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংবাদ সংস্থা পিবিএস-এর আয়োজিত পাঁচ ঘণ্টার ডকুমেন্টারি ফিল্ম এশিয়ান অ্যামেরিকানস-এর উপরে একটি প্যানেল আলোচনায় নেতৃত্ব দেন।
প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অধীনে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির উপর ভয়েস অব আমেরিকা এবং বাংলাদেশের আরটিভি আয়োজিত একটি টকশোতে প্যানেলিস্ট ছিলেন তিনি। এই উপন্যাসটি জার্মানিতে তার স্নাতক পড়ার সময়ের স্মৃতিকথার উপর ভিত্তি করে লেখা।
এমজে