লেখক বইকে পরিচয় করাতে গিয়ে বলেছেন, ‘নতুন চিন্তার উপন্যাস।’ পাঠকও খুঁজতে লাগল, উপন্যাসে নতুন চিন্তা কী?

প্রথমে দেখা যায়, আবু নামের এক মধ্যবয়স্ক লোক, যিনি নিম্নমধ্যবিত্ত, তিনি দোকানে গেছেন শ্যাম্পু কিনতে। আবুর বড় মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। আরও একবার বড় মেয়ে প্রকৃতিকে দেখতে এসেছিল, চুলের জন্য পছন্দ করে নাই। এবার প্রকৃতির মা জমানো টাকা থেকে দুইশ টাকা দিয়েছে শ্যাম্পু কিনতে, সাথে কন্ডিশনারও। 

আবুর সাথে দোকানির ঝগড়া লাগে। আবুর যুক্তি হলো- শ্যাম্পু দেবে, আবার কন্ডিশনার কেন? দুইটাইতো মাথায় দেবে- তাহলে আলাদা আলাদা কেন? একসাথেইতো ছিল? কেন আলাদা করল, কেন বেশি টাকা খরচ করাচ্ছে? 

আবুর এই জানতে চাওয়ার মধ্য দিয়ে পাঠকের মনে হতে থাকে, তাইতো! প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের অগ্রসরে আমাদের জীবনযাপন সহজ হবার কথা, কিন্তু জটিল হচ্ছে কেন? জীবনযাপনের ব্যয়ও বাড়ছে। 

দোকানি আর আবুর কথোপকথনের মধ্য দিয়ে যেন পাঠক নিজের জটিল জীবনেই প্রবেশ করে। একটু এগিয়ে যাবার পর পাঠক হয়ত একটু চমকাবে। দোকানিকে আবু বলছে- ‘মৃত মানুষের কোন শ্যাম্পু নাই? কন্ডিশনার নাই? আমি কিনমু।’ 

আগুনকাল- এর লেখক মোস্তফা মনন

দোকানি বলে, ‘আবু ভাই, আপনে কিন্তু পাগলামি করতাছেন।’ 

‘ব্যাটা বেচবি তোরা, লাভ করবি তোরা, সারা মাস খাইট্টা যে কয়টা পয়সা পাই, শ্যাম্পু, কন্ডিশনার আর মুখ ফরসা ক্রিম বেইচা সব টাকাপয়সা নিয়া ফুতুর করবি আমারে আর আমারেই কবি পাগলামি করতাছেন?  ফাইজলামি পাইছস? আমার প্রশ্নের সাফ সাফ উত্তর দে।’

আবুর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না দোকানি। আবুর মনে হয়, অবশ্যই জবাব দিতে হবে। কোম্পানির কাছে জবাব চাইবে। কয়েকটা বেশি টাকার জন্য আমাদের জীবনটাকে এত জটিল করে তুলছে কেন? আমি দেশের নাগরিক। এই জবাব আমাকে দিতে হবে। 

নিজের বড় মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। সেসব বাদ দিয়ে ঢাকাগামী বাসে ওঠে আবু। ঢাকা ১১০ মাইল দূরে।

আবু শহরে ছুটছে, পাঠকও আবুর সফরসঙ্গী হবে। আগুনকালে এইটুকু পড়ে মনে হবে, আবুর সঙ্গে থাকতে হবে। এক মাস পর আবুকে খুঁজতে আসা বড় মেয়ে প্রকৃতির সাথে পাঠকের একটা বন্ধন তৈরি হবে। আবু খোঁজে সমাধান, প্রকৃতি খোঁজে তার বাবাকে। কেউ এখনও কাউকে পায় নাই। জীবনের জটিল সব বাঁক পেড়িয়ে প্রকৃতি শহরজুড়ে আবুকে খোঁজে। আবু মুখোমুখি হয় চরম বাস্তবতার। 

জীবনের সমস্যাগুলো লেখক মোস্তফা মনন নিরেট বাস্তবতার আলোকে বিশ্লেষণ করেছেন। আবুর সাথে এগিয়ে যায় পাঠক, দেখবে শহরের অলিগলি, দেখবে মানুষের নানান মুখ আর মুখোশ। আবিষ্কার করবে বোধের অনেক জটিল ধাঁধা। পরক্ষণে মনে হবে, এই ধাঁধা কৃত্রিম, যা এতদিন আসল ভেবে ভুল করেছিল। 

আসলেইতো মানুষের জীবন এতো জটিল না। মানুষের সরল সুন্দর জীবনকে একদল ব্যবসায়ীলোক খুব সচেতনভাবে জটিল করছে। এটা একটা আকাঙ্ক্ষার ফাঁদ, পণ্যফাঁদ। এই ফাঁদ থেকে বের হতে হবে। সমাজের প্রতিকূলতার মাঝে কীভাবে লড়াই করে এগিয়ে যাওয়া যায়, তা উপন্যাসে দেখানো হয়েছে। 

আবু খোঁজে তার প্রশ্নে উত্তর, মেয়ে খোঁজে আবুকে, পুলিশ খোঁজে আবুকে। উপন্যাসের পুরোটা জুড়ে টেনশনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে পাঠক। আবুকে কে আগে খুঁজে পাবে? মেয়ে নাকি পুলিশ? মেয়ে পেলে বাড়ি নিয়ে যাবে, পুলিশ পেলে জেলে দিয়ে দেবে। আবুর দোষ কোথায়? প্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা কি আবুর অপরাধ? চরিত্রের বাঁকে বাঁকে কখনো কখনও দম বন্ধ হবার মতো অবস্থা, আবার কখনও চোখ ভিজে ওঠে আবেগে। কখনও খুব জেদ হয় এই সমাজের কিছু মানুষের ওপর। সব মিলিয়ে আগুনকাল এই সময়ের বাস্তব উপন্যাস।খুব প্রয়োজনীয় উপন্যাস। জীবনকে সহজ করতে ‘আগুনকাল’ গুরুত্বপূর্ণ। 

উপন্যাস : আগুনকাল
লেখক : মোস্তফা মনন
ধরন : সমকালীন উপন্যাস (সমাজ সচেতনতামূলক)
প্রকাশক : শোভা প্রকাশ, ১৩ নং প্যাভিলিয়ন, একুশে বই মেলা ২০২১
বইটি পাওয়া যাচ্ছে রকমারি’তেও।

বিডি/এইচকে