বুক রিভিউ
‘বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ আষাঢ়’ : ক্লান্তির ওষুধ ও চিন্তার খোরাক
অনেক দিন রম্যলেখা পড়া হয় না। জীবনে আর এত আনন্দ-অবসর কই? সময় চলে যায় জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে। পড়াশোনা যা হয় তাও তাৎক্ষণিক দরকারি। অর্থাৎ যা না পড়লেই নয়। স্কুলজীবনের সাহিত্যপাঠের আনন্দ হারিয়েছি অনেক দিন আগেই। এর মধ্যে তাপস রায়-এর ‘বঙ্গ ভান্ডারে তব বিবিধ আষাঢ়’ পড়া গেল। বইটা আমার ক্লান্তির ওষুধ হিসেবে কাজ করেছে। বইটি পড়তে পড়তে এক মুহূর্তে শরীর থেকে ঝরে পড়েছে অবসাদের অসুখ। নির্মল এক আনন্দ পেলাম বইটি পড়ে।
বইটিতে আছে মোট ১৪টি অধ্যায়। বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ আষাঢ়, তাড়া খাওয়া ভূতের জীবন, তেল বের করে নেওয়া খৈলজীবন, গরম যদি মন্দ তবে, সব ঋড়ড়ষ বোকা নয়, নিঃসংকোচে দেওয়া মিথ্যা বচন, ভুলে না যাই বই খোশবাই, ত্রাহি স্বরসতী, সুকুমার দর্জির গোল, পাত্র নির্বাচন, মেড ফর ইচ আদার, অলাতের এড়িয়ে যাওয়া, ভবের আলীর ভ্রমণ, লেজ।
বিজ্ঞাপন
সবগুলো লেখাতেই লেখক সামাজিক নানা অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেছেন মজার মজার গল্পে। গল্পগুলোতে মিশিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা। নিজের অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিশে আছে দেশের আচার-সংস্কৃতি। ফলে লেখাগুলো আর কারও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। পড়তে পড়তে মনে হয় এগুলো আমারই কথা। যেমন প্রথম রম্য লেখাটি বঙ্গ ভাণ্ডারে তব বিবিধ আষাঢ়-এ লেখক বলছেন, বঙ্গে বারো মাসই আষাঢ়। এ আবার কেমন কথা! আষাঢ় মানে যে শুধু বর্ষকাল নয়, গালগল্পেরও মাস তা আমরা জানি। আষাঢ়ে গল্প নামে বাংলায় একটা বাগধারা আছে, যার অর্থ অবিশ্বাস্য গল্প। লেখক বলছেন, বাংলায় ফাল্গুন-চৈত্র মাসেও এখন ‘আষাঢ়ে গল্প’ চালু। যে যেভাবে পারছেন যা-তা বলছেন। ভয়ঙ্কর মহামারির মতো বলার রোগে পেয়ে বসেছে আমাদের। যার বলার নয়, তিনিও বলছেন, যা বলার নয় তাও বলছেন।
টিভি খুললেই আমরা দেখব কে না কী-না বলছেন! টকশো মাস্টারদের থেকে শুরু করে কবি-সাহিত্যিক-রাজনীতিবিদ কারও যেন বলার বিরাম নেই। কিন্তু, বলছেন কী? একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে সবাই সব কথা বলছেন বটে কিন্তু কারও কথারই বিশেষ কোনও অর্থ নেই। আর বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক তো কথার হাটবাজার। যার যা মন চায় বলছে, যখন-তখন। তাই লেখক আক্ষেপ করে বলছেন, বলবে না নাই বা কেন? এ যুগে বলাতেই বল, বলাতেই দল, বলাতেই ছল। এমন কি ফলও মিলে যেতে পারে জায়গা মতো যদি বলতে পারেন! আর ছলে দলে ভারী হতে কে না চায়? তাই স্পিকার যেমন বলছেন, ক্যানভাসারও বলছেন, কথাবন্ধুরা বলছেন, জনগণের বন্ধুরা তো বলবেনই।
‘অতিকথন’ জন্মহারের চেয়েও বঙ্গে আজ বড় সমস্যা। বঙ্গের অতিকথনের কথা বলে লেখক নিজের জীবনের একটি আষাঢ়ে গল্পের কথা জানিয়েছে পাঠককে। কিন্তু, আষাঢ়ে গল্প হলেও তা সত্যি। একদিন স্যার আষাঢ়ে গল্প লিখতে দিয়েছিলেন স্কুলে। লেখক নিজের জীবনের এক স্মরণীয় গল্পের কথা লিখে দেন।
দ্বিতীয় রম্যরচনা ‘তাড়া খাওয়া ভূতের জীবন’- এ লেখক বর্ণনা করেছেন ভূতময় অভিজ্ঞতার নানা দিক। ভূত ভীষণ রকম অদ্ভুত। সেইসঙ্গে কিম্ভূতও বটে। কীরকম কিম্ভূত? কারও জীবনে ভূতের বেগার খাটাই সার, কাউকে-বা ভূতে টাকা যোগায়। বছর পাঁচেক আগেও এই ভূমণ্ডলে ভবের আলীর কিছু ছিল না, এখন গুলশানে আলিশান বাড়ি। এমন ভবের আলীর সংখ্যা কম নেই সমাজে। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যেখানে ভূতের বেগার খেটে শুকিয়ে শুটকিমাছ হচ্ছেন, কতিপয় তখন ভোজভাজির মতো চোখের পলকে আঙুল ফুলে কলাগাছ হচ্ছেন। লেখক তাই বলছেন, “ভূত মরে অপঘাতে। আমরা মরছি ঘাটে ঘাটে। সুতরাং তারা আছে। আমাদের আশেপাশেই আছে। তারা আমাদের দেখছে, অমরা দেখছি না-পার্থক্য এটুকুই।” (পৃষ্ঠা-২২)
‘তেল বের করে নেওয়া খৈলজীবন’-এ লেখক জানাচ্ছেন তেলের তেলেসমাতির নানা কথা। ‘তৈল’ নামে এক দারুণ লেখা পড়েছিলাম হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখেছিলেন, “বাস্তবিকই তৈল সর্বশক্তিমান, যাহা বলের অসাধ্য, যাহা বিদ্যার অসাধ্য, যাহা ধনের অসাধ্য, যাহা কৌশলের অসাধ্য, তাহা কেবল তৈল দ্বারা সিদ্ধ হইতে পারে।” তাপস রায়ের লেখার অনুপ্রেরণাও ওই নিবন্ধটি। তবে, তাপস রায় আধুনিক সময়ের তৈলবিদদের বর্ণনা দিয়েছেন সরস ভঙিতে। যেমন প্রথমেই তিনি জানাচ্ছেন, “এ কালে কলুদের এতটা কায়দা না জানলেও চলে। কিন্তু কর্পোরেট কলুদের এটুকু জানতেই হয়। যিনি যত তেলসিদ্ধ তার কার্যসিদ্ধি তত বেশি।” (পৃষ্ঠা-২৩)
বর্তমান সমস্ত পেশাক্ষেত্রই যেন তেলের হাটবাজার, তেলের খনি। তেল ছাড়া আর অফিস-আদালত চলে না। সমাজ-সংসার অচল। লেখকের বন্ধু ভবা তাই স্কুলজীবন থেকে অফিসজীবন, সংসারজীবন সবখানেই তেলমারার চর্চা করে যাচ্ছে। প্রমোশনের লোভে বসের বউকে তেলমারে ফেসবুক কমেন্টে, বউ সামলানোর জন্য আবার অন্যভাবে তাকে তেল মারতে হয়। মোট কথা, ভবা বুঝে গেছে, তেলে শুধু চাকাই ঘোরে না, মনও ঘোরে।
আমাদের জীবনে বর্ষাকাল ছাড়াও যেমন আষাঢ়ে গল্প থাকে তেমনি শীতকালেও থাকে প্রচণ্ড গরম। এই গরম যে শুধুমাত্র আবহাওয়াজনিত কারণে তা নয়, বরং আমাদের স্বভাব-চরিত্রের সবকিছুতেই এখন গরমের প্রকাশ। গরম না দেখালে যেন আমাদের ঠাটবাটও ঠিক মতো প্রকাশ হয় না। তাই লেখক বলছেন, “ঘরের বউ থেকে অফিসের বস, কাঁচাবাজার থেকে কালোবাজার, পাতি নেতা থেকে দলনেতা, পুলিশ থেকে পাবিলককরণে, বনে, জলে, জঙ্গলে সবাই তেতে আছে। ভূতল থেকে ভূপৃষ্ঠ একই অবস্থা।” (পৃষ্ঠা-৩০)
রম্যছলেও বললেও এ-বড় নিদারুণ বাস্তবতা। এ-নিয়ে দার্শনিক, মনস্তাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক গবেষণাও হতে পারে যে আমরা হঠাৎ কেন এমন গরম হয়ে উঠলাম! এ কি শুধু প্রাকৃতিক কারণে, নাকি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণে। এ-দেশে যে যার ওপর সুযোগ পায় তার ওপরই গরম দেখায়। গরম না দেখালে যেন পেটের ভাত হজম হয় না, নিজের ব্যক্তিত্ব পরিপূর্ণ প্রকাশ পায় না। মাথাগরম জাতি হিসেবে এ-জাতি কবেই স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই লেখক বলছেন, গরম যদি মন্দই হবে, ডালপুরি খুঁজতে গিয়ে ঠান্ডা দেখলে মেজাজ গরম করো কেন!
সব গরম যেমন মন্দ নয় তেমনি সব ফুলও (ঋড়ড়ষ) বোকা নয়। আজকাল দেখেশুনে বোকা চেনা যায় না। উল্টো বোকা বনে যাওয়ার আশঙ্কা। হাতে বালা কানে দুল হেঁটে যায় সাইদুল- এসব তো আছেই; এই নগরে মানুষকে বোকা বানানোর আয়োজনেরও কমতি নেই। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোতে দেখা যায় আড়াইশ গ্রাম শুকনো মরিচ কিনলেও ভ্যাট গুণতে হয়। কারণ কী, কারণ হচ্ছে মরিচের প্যাকেট এখন সাইদুলের মতো হাতে বালা কানে দুল পরেছে। ওখানে গিয়ে দামদর তো দূরের কথা, কিছু জিজ্ঞেসও করা যাবে না, তাহলে বোকা হয়ে যেতে হবে!
বোকামির উদারহরণ দিতে গিয়ে লেখক বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী নিউটনের একটা গল্প বলেছেন। নিউটনের গবেষণাগারের দরজার ভাঙা অংশ দিয়ে একটা বিড়াল প্রায়ই যাতাযাত করত। এক সময় বিড়ালটি বাচ্চা দিল। ফুটফুটে বাচ্চা! নিউটন খুশি হলেন। বাচ্চাটি যাতে অনায়াসে গবেষণাগারে ঢুকতে পারে এ জন্য তিনি একটি উপায় বের করলেন। মা বিড়াল দরজার ভাঙা যে অংশ দিয়ে ঘরে ঢুকত তার পাশে ছোট্ট আরেকটি দরজা করে দিলেন।
বড় দরজা দিয়ে মা বিড়ালের সঙ্গে ছানাটিও যে ঢুকতে পারবে নিউটনের মাথাতেই আসেনি। অথচ ওই মাথা খাটিয়েই তিনি কত কিছু আবিষ্কার করেছেন। নিউটন ফুল হলেও নিশ্চয়ই বোকা নন। তেমনি রবীন্দ্রনাথও। বিয়ের আসরে ভাঁড় খেলার সময় ভাঁড়গুলো উপুড় করে দিতে লাগলেন। তাই দেখে ত্রিপুরাসুন্দরী দেবী বলে উঠলেন, ও কি করিস রবি? ভাঁড়গুলো সব উলটেপালটে দিচ্ছিস কেন?
রবীন্দ্রনাথ বললেন, জানো না কাকিমা, সব যে ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
‘ভুলে না যাই বই খোশবাই’ রম্যরচনাটি নানা কারণেই এখন প্রাসঙ্গিক এবং উল্লেখযোগ্য। এ- লেখাটি বই নিয়ে। ফেব্রুয়ারি মাস এলে বাংলাদেশে বই নিয়ে একটা সরগরম ওঠে। সারা বছর তা প্রায় নিরবই। বই মেলার সময় ছাড়া আর তেমন বই প্রকাশ হয় না। অনেক সাধারণ পাঠকও তখন বই থেকে দূরে থাকেন। এটা একটা দুষ্টচক্রের মতো হয়ে গেছে বাংলাদেশের বইবাজারে। শরৎচন্দ্র সেই কবে ক্ষেদের সঙ্গে বলে গেছেন, ‘অনেক বড়লোকের বাড়িতে গেছি। খোঁজ নিয়ে দেখেছি, তাদের সবই আছে। নেই কেবল গ্রন্থাগার। যাদের বা একান্তই আছে, তারা কয়েকখানা চকচকে বই বাইরের ঘরে সাজিয়ে রাখেন। কিন্তু বাংলা বই মোটেই কেনেন না।’
অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত লেখকের মজার মজার গল্প জানিয়েছেন তাপস রায়। যেমন, বিদ্যাসাগরের শখ ছিল বই পড়া এব বই বাঁধাই করে রাখা। একদিন এক ভদ্রলোক বইগুলো দেখে বললেন, এত খরচ করে বইগুলো বাঁধিয়ে না রাখলেও হতো।
কেন? এতে দোষ কী?
ওই টাকায় অনেকের উপকার হতে পারত।
বিদ্যাসগর তামাক খেতে খেতে ভদ্রলোকের শাল লক্ষ্য করে বললেন, আপনার শালটি চমৎকার। কোত্থেকে, কত দিয়ে কিনেছেন?
শালের প্রশংসা শুনে ভদ্রলোক উৎফুল্লা কণ্ঠে বললেন, পঁচিশ টাকায় খরিদ করা।
বিদ্যাসাগর সুযোগ পেয়ে বললেন, পাঁচ সিকের কম্বলেও তো শীত কাটে, তবে এত টাকার শালের প্রয়োজন কী? এ টাকায়ও তো অনেকের উপকার হতে পারত।
কার্ল মার্ক্সের মৃত্যুর পর তার স্ত্রীর সাক্ষাৎকার নিতে এলেন এক সাংবাদিক। এ প্রশ্ন সে প্রশ্নের পর মার্ক্সের দাম্পত্য জীবন নিয়েও প্রশ্ন করলেন তিনি। এমনই এক প্রশ্নের জবাবে স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা যথেষ্ট সুখী ছিলাম।
উত্তর দেওয়ার ধরন দেখেই চতুর সাংবাদিক চটপট জানতে চাইলেন, আপনারা সত্যিই কি সুখী ছিলেন?
এবার ভদ্রমহিলা আরও বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, আমরা সত্যিই সুখী ছিলাম, কিন্তু কার্ল যদি ‘ক্যাপিটাল’ লেখায় সময় না দিয়ে ক্যাপিটাল সংগ্রহেও কিছু সময় দিত তাহলে আরও ভালো হতো।
বইয়ের অন্য রম্যরচনাগুলোও সরসগুণে সুখপাঠ্য হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন রম্যরচনায় তাপস রায় যে ছোট ছোট গল্পগুলো বলেছেন তা-ই নিজগুণে অনন্য হয়ে উঠেছে। ৯৬ পৃষ্ঠার বইটি এক বসাতেই পড়ে ফেলার মতো। এক বসাতে পড়ে ফেললেও এর বিষয়বস্তু এক মুহূর্তে ভুলে যাওয়ার মতো না। বরং বিষয়গুলো আমাদের ভাবাবে অনেক দিন। হাসির খোরাকের সঙ্গে বইটিতে কিছু চিন্তার খোরাকও আছে।
বইটি প্রকাশ করেছে অনার্য পাবলিকেশন্স লি.। প্রকাশকাল ২০২০। মূল্য : ২৪০ টাকা।
এসএম