রিভিউ
বইমেলায় সুজনের ‘অতিপ্রাকৃত অথবা কাকতালীয়’: একটি সাইন্টিফিক ফিলসফি
মানুষের জীবন গুচ্ছ গুচ্ছ ঘটনার সম্মিলন। এক জীবনে মানুষ দাঁড়ায় অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি। এর মধ্যে অদ্ভুত-অস্বাভাবিক বিষয় বিচ্ছিন্ন বলেই ধরে নেওয়া হয়, যতক্ষণ জটিলতা এড়ানো যায়। সেসব ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে, আবার কোনো যুক্তি নাও দাঁড় করানো যেতে পারে। অমীমাংসিত রয়ে যায়। বিজ্ঞান ব্যাখ্যা দিতে না পারলে অতিপ্রাকৃত অথবা অনেকে ভৌতিক বলেও চালিয়ে দেন। কিছু কিছু ঘটনা একটি আরেকটির সঙ্গে মিলে যায়, সে সবকে দায়সারাভাবে কাকতালীয় আখ্যা দেওয়া হয়।
‘অতিপ্রাকৃত অথবা কাকতালীয়’ মুস্তফা মনওয়ার সুজনের লেখা সূক্ষ্ম চিন্তার বৈজ্ঞানিক দর্শনবিষয়ক উপন্যাস।
বিজ্ঞাপন
এতে জীবিত মানুষের আত্মার কার্যক্রমের পর্যবেক্ষণ রয়েছে নিবিড়ভাবে। দেহবিচ্ছিন্ন আত্মা অনুসরণে পদার্থবিদ্যা, নিউরোলজি ও মনোবিজ্ঞানের আশ্রয়ে উঠে এসেছে ততোধিক অনুসিদ্ধান্ত। দেখানো হয়েছে প্রাণ অ্যাবসলিউট নাও হতে পারে। অনেকটা পারদের মতো; বিচ্ছিন্ন হয়ে আবার একত্রিত হওয়ার সক্ষমতা।
উপন্যাসে লক্ষণীয়, দেহত্যাগী মুক্তপ্রাণ বা আত্মার অনিয়ন্ত্রিত অদ্ভুত আচরণ, তবে প্রোগ্রামিং করা। যার যার মস্তিষ্কের গঠন অনুযায়ী প্রোগ্রাম সেট হয়। যদিও তাতে সংশ্লিষ্ট মানুষটির কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশাল নিউরনের সীমাবদ্ধতায় উদ্ভূত ঘটমান পুনঃপুনঃ সংকট সংক্রান্ত বহুমুখী যুক্তিতর্ক এতে উল্লেখযোগ্য।
বইটিতে উত্থাপিত সাইন্টিফিক ফিলসফি মুহূর্তে মুহূর্তে চমকিত করেছে।
যেমন- মানুষ আসলে প্রার্থনা কেন করে? পাপ-পুণ্যের ব্যাপারটা হাজার বছর ধরে টিকে আছে কেন? মানবজীবনে ধর্মের কী আদৌ কোনো প্রভাব আছে? শুধু নিয়তি বা বিশ্বাসের ওপর ভর তো করাই যায়, কিন্তু এসব প্রশ্নের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও থাকতে পারে।
মুস্তফা মনওয়ার সুজন এ বইতে অন্ধ বিশ্বাসের বাইরে দাঁড়িয়ে বিজ্ঞানের সমীকরণ দাঁড় করাতে চেয়েছেন। উত্থাপন করেছেন সান্টিফিক ফিলসফি। এক্ষেত্রে স্ট্যাটিসটিক্স খুবই গুরুত্বপূর্ণ; যা তার অনুসিদ্ধান্তের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।
লেখক মুস্তফা মনওয়ার সুজনকে আমি দেড় যুগ ধরে জানি। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভৌত বিজ্ঞান অনুষদের পরিসংখ্যান বিভাগের স্নাতকোত্তর সুজন পেশায় সাংবাদিক এবং গবেষক। সমাজ, জীবন, বিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে নিরীক্ষা চালান অবিরত।
বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন নিয়ে গবেষণা করেছেন। এ নিয়ে রয়েছে সুজনের কর্মযজ্ঞ। তার রচিত ‘বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক মতবাদ’ গ্রন্থটি শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিলেবাসভুক্ত। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়েও কাজ করেছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের ডায়রি ‘একাত্তরের ডিসেম্বর’ তার লেখা।
সুজনের এবারের ‘অতিপ্রাকৃত অথবা কাকতালীয়’ উপন্যাসটি জীবনের নিগূঢ় মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব-বিরোধ-সংঘাত নিয়ে দাঁড়িয়েছে। এর কেন্দ্রীয় চরিত্র রঞ্জুকে ঘিরে ঘটনার ঘনঘটা জন্ম দিয়েছে প্রশ্নের পর প্রশ্ন। পদার্থবিদ্যা, মনোবিজ্ঞান ও প্রাণীবিদ্যার জটিলতম জিজ্ঞাসাগুচ্ছ উঠে এসেছে তার রহস্যঘেরা জীবনের ঘটনা পরম্পরায়।
উপন্যাসে লক্ষণীয়, রঞ্জুর বিরক্তির ভয়ংকর পরিণতি। অনেকের অনিবার্য মৃত্যু। যদিও সেসবে তার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে না। এমন রঞ্জু হয়ে ওঠার নেপথ্যের কার্য-কারণ জটিলতায় ঠাসা। বইটির ভূমিকায় জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক সাজ্জাদ আলম খান তপু বলেছেন, মানুষটি হতে পারে প্রকৃতির নিষ্ঠুর সৃষ্টি। এ নিয়েও প্রশ্ন আছে বৈকি, অবশ্যই বিস্তর প্রশ্ন আছে।
বিজ্ঞানের অসহায়ত্বে নিয়তি বা ধর্মের ধারণা এ উপন্যাসে ভেঙেচুরে মিলিয়ে গেছে। পাশাপাশি অশরীরীর উপস্থিতি ও কর্মকাণ্ড যুগিয়েছে গভীর ভাবনার খোরাক। এতে জটিল বিজ্ঞানের সমান্তরালে দেখা গেছে লক্ষ্ণৌর এক বাইজির উপস্থিতি। এক সাধারণ গণিকার রাজবেশ্যা হয়ে ওঠার ইতিবৃত্ত। সে বিষয়েও রয়েছে মানব মনের জটিল টু ইন প্যারাডক্স।
উপন্যাসজুড়ে একদিকে রহস্যময় ঈশ্বর কণা, দুর্বোধ্য কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিরীক্ষা অন্যদিকে বিশাল নিউরন জগতের হাইপোথিসিস, পাশাপাশি রয়েছে বিপন্ন প্রেম, নির্মোহতা, মনোজাগতিক দ্বন্দ্ব, দুরন্ত যৌনতা, নগ্নতার অপার সৌন্দর্য, মুগ্ধতার নিষ্ঠুর সমাপনী এবং ঐতিহাসিকতা।
রয়েছে রাজনৈতিক নির্মম বাস্তবতার পাশাপাশি তারুণ্যের রুখে দাঁড়াবার অদম্য সাহস। শেষমুহুর্তে উল্লেখযোগ্য, দুর্বোধ্য এক বৃত্তে জীবনের ঘুরপাক।
বিজ্ঞানের ওপর আদ্যোপান্ত ভর করে সরল ভাষায় গল্প কথনে চমকের পর চমক উপন্যাসটিকে দিয়েছে ব্যতিক্রমী মাত্রা।
সর্বোপরি, উপন্যাসের সংজ্ঞায় চরিত্র সৃষ্টি অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার; এক্ষেত্রে অসাধারণভাবে বেশক’টি সৃষ্ট চরিত্র নজর কেড়েছে, যেমন- বাদল, নবনিতা, ফজল, সুরভী ম্যাডাম, অধ্যাপক আজিজুর রহমান। আর রঞ্জু একটি জ্বলন্ত চরিত্র, মনে হয়েছে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি।
বলতেই হবে রঞ্জু চরিত্রটি তরুণ উপন্যাসিক মুস্তফা মনওয়ার সুজনের অসামান্য সৃষ্টি।
উপন্যাসটি নিয়ে এক মন্তব্যে সাংবাদিক সাজ্জাদ আলম খান তপু লিখেছেন, পদার্থ বিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান এবং নিউরনের মতো জটিল বিষয় নিয়ে সরল উপন্যাস ‘অতিপ্রাকৃত অথবা কাকতালীয়’। এতে চিত্রিত কয়েকটি চরিত্র অনেককেই ভাবিয়ে তুলতে পারে। অনেকে ধাক্কা খেতে পারেন। বাংলা গদ্যের দীর্ঘদিনের প্রচলিত ধারায় মনে হচ্ছে নতুন কিছু আসছে। এটি হুমায়ূন ধারার সায়েন্স ফিকশন নয়, মুহম্মদ জাফর ইকবাল অনুসরণও নয়। এখনই এ ধারার নামকরণ করা ঠিক হবে না— সময় বলে দেবে, পাঠক ঠিক করবে।
এ পর্যায়ে পাঠক হিসেবে বলতেই পারি, ‘অতিপ্রাকৃত অথবা কাকতালীয়’ উপন্যাস একটি সাইন্টিফিক ফিলসফি।
উপন্যাসটি প্রকাশ করেছে বিশ্ব সাহিত্য ভবন। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ।
বইটি এবারের গ্রন্থমেলার সোহরাওয়াদী উদ্যানের ৪ নম্বর প্যাভিলিয়নে পাওয়া যাচ্ছে। দাম ২২৫ টাকা।
সানজিদা সুলতানা
সহ-সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক
এসএসএইচ