নতুনদের জন্য ডা. জাহাঙ্গীর কবিরের ডায়েট চার্ট
বর্তমানে ওজন কমানোটাই অনেকের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ যে হারে ওজন বাড়ে, কমার হার তারচেয়ে অনেক কম। এর বড় কারণ আমাদের জীবনযাপনের ধরন। আমরা যে ধরনের খাবার খেয়ে থাকি, বেশিরভাগ সময় সেগুলোই ওজন বাড়ানোর কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। এর পাশাপাশি আছে শরীরচর্চার অভাবও।
ওজন একবার বেড়ে গেলে তা কমিয়ে আনা কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে। অনেকে নানা ধরনের চেষ্টা, কসরত করেও সফল হন না। অনেকে আবার বুঝে উঠতে পারেন না কী করলে ওজন নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কেউ কেউ আবার না খেয়ে থাকতে শুরু করেন। কিন্তু না খেয়ে থাকা কোনো সমাধান নয়। সুস্থ থাকার জন্য প্রতিদিন পরিপূর্ণ খাবার খাওয়া জরুরি। তাই ওজন কমাতে হবে খাবার খেয়েই। কখন কোন খাবার খেলে ওজন কমবে স্বাস্থ্যকর উপায়ে তা জানিয়েছেন ডা. জাহাঙ্গীর কবির-
বিজ্ঞাপন
কিটো ডায়েট বা কিটোজনিক ডায়েট। এটি হলো সুপার লো-কার্ব ডায়েট। এই ডায়েটে কার্ব কম থাকে এবং ফ্যাট অনেক বেশি থাকে। সেইসঙ্গে প্রোটিন থাকে মাঝামাঝি। আমাদের সাধারণ ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট ৫০%, প্রোটিন ২০% ও ফ্যাট ৩০% থাকে। এদিকে কিটো ডায়েটে কার্বোহাইড্রেট ৫%, প্রোটিন ২৫% ও ফ্যাট ৭০% থাকে। এর মানে হলো আপনি সারাদিনে যতটুকু খাবার খাবেন তার ভেতরে এসব উপাদানের পার্সেন্টেজ এমন থাকতে হবে। তাই কোন খাবারে কী পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট ইত্যাদি থাকে তা জেনে নেওয়া জরুরি।
আপাতত যেসব খাবার বন্ধ করবেন
* চালের তৈরি সব খাবার।
* গমের তৈরি সব খাবার।
* সব ধরনের ডাল।
* সব ধরনের আলু ও শর্করা জাতীয় সবজি যেমন: মূলা।
* চিনি ও চিনি দিয়ে তৈরি সব খাবার।
* দুধ, দুধের তৈরি সব ধরনের খাবার, মিষ্টি দই ও টক দই।
* মধু এবং মিষ্টি ফলমূল।
* সয়াবিন, সূর্যমুখী, রাইস ব্যান, ক্যানোলা ওয়েল, এবং সাধারণ কোনো তেলে রান্না করা খাবার।
* ফার্মের মুরগি, যেসব মুরগিকে টেনারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত খাদ্য খাওয়ানো হয়, সয়া খাওয়ানো হয়।
* গরুর মাংস, যে গরু বা ষাঁড় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মোটা তাজা করা হয়। খাসির ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য।
যেসব খাবার খেতে পারবেন
* সবুজ শাক, সবজি।
* টক জাতীয় ফল।
* সব ধরনের মাছ। সাগরের মাছ খেতে পারলে বেশি ভালো।
* গরু বা খাসির মাংস খেতে পারবেন তবে তা মোটাতাজাকরণ ইঞ্জেকশনমুক্ত হতে হবে।
* গরু বা খাসির পায়া।
* মুরগির ডিম।
* মাছের ডিম।
* ঘি, অর্গানিক বাটার, এক্সট্রা ভার্জিন ওলিভয়েল, এমসিটি ওয়েল, অর্গানিক এক্সট্রা ভার্জিন কোকোনাট ওয়েল।
* সব ধরনের বাদাম।
* রং চা বা দুধ-চিনি ছাড়া কফি। লেবু, আদা, সামান্য লবণ মেশানো গ্রিন টি। কফির কফির সঙ্গে এমসিটি অয়েল, মাখন, ঘি বা অর্গানিক কোকোনাট অয়েল মিশিয়ে বাটার কফি তৈরি করে খেতে পারেন।
ডায়েট শুরু করবেন যেভাবে
সকালের খাবার
* যাদের সকালে খাওয়ার অভ্যাস তারা আটটা বা সাড়ে আটটার দিকে দুধ চিনি ছাড়া এক কাপ চা খেতে পারেন। চায়ে আদা, লেবু ও সামান্য লবণ মেশাতে পারেন।
* আপেল সাইডার ভিনেগার বা কোকোনাট ভিনেগার খেতে পারেন কুসুম গরম পানির সঙ্গে।
* কুসুম গরম পানির সঙ্গে লেবুর রস মিশিয়ে খেতে পারেন।
সকাল আটটায় নাস্তা খেলে দেড়টার ভেতর দুপুরের খাবার খেতে হবে। এছাড়া যাদের দেরিতে নাস্তা খাওয়ার অভ্যাস তারা এগারোটার দিকে উপরোক্ত পদ্ধতিতে নাস্তা করবেন এবং দুপুরের খাবার আড়াইটা-তিনটায় খাবেন।
দুপুরের খাবার
* দুপুরের খাওয়ার আগে অবশ্যই এক চামচ আপেল সাইডার ভিনেগার এক গ্লাস পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাবেন। এতে আপনার গ্যাসের সমস্যা হবে না এবং চর্বি কাটতে সাহায্য করবে।
* দুপুরের খাবারের তালিকায় শাক, সবজি, মাছ অথবা মাংস, ঘিয়ে ভাজা ডিম, ঘিয়ে ভাজা বাদামের সঙ্গে বাটার রাখতে পারেন এবং অবশ্যই টমেটো, গাজর, শসা রাখবেন।
* শাক, সবজি অবশ্যই এক্সট্রা ভার্জিন অলিভ অয়েল দিয়ে রান্না করবেন। মাছ ভাজলে (ডীপ ফ্রাই করবেন না) বা রান্না করলে এই তেল দিয়ে করবেন। সবজি যতটুকু সম্ভব কম সেদ্ধ করবেন। যেন সবজির গুণগত মান ঠিক থাকে।
* ডিম কুসুমসহ ঘি বা মাখন দিয়ে ভেজে খাবেন। দিনে সর্বোচ্চ ছয়টি ডিম কুসুম সহ খেতে পারবেন। কারণ ডিম প্রোটিন এবং ভালো ফ্যাটের উৎস।
* দেশি মুরগি কিংবা গরুর মাংস খেতে পারেন এক-দুই টুকরো। মাছ খেলে মাংস খাবেন না। মাংস খেলে মাছ খাবেন না। বিদেশে থাকলে ফার্মের মুরগি খেতে পারবেন।
* দুম্বা, উট, ভেড়ার মাংস খেতে পারবেন তবে এক টুকরোর বেশি নয়।
বিকেলের খাবার
বিকেলে ক্ষুধা লাগলে উপরে উল্লেখিত চা, বাটার কফি এবং মাখন বা ঘি দিয়ে ভাজা বা মেশানো বাদাম খাবেন।
রাতের খাবার
* রাতের খাবারের আগে আপেল সাইডার ভিনেগার মেশানো একগ্লাস পানি খেয়ে নিবেন।
* রাতের খাবারও দুপুরের খাবারের মতো হবে।
* রাত আটটার আগে খাবার শেষ করুন। এরপর বাকি রাত পানি ছাড়া আর কিছু খাবেন না।
যেসব বিষয় মানত হবে
রাত দশটা বা সর্বোচ্চ এগারোটার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতে হবে। কারণ রাত দশটা থেকে দুইটার ভেতর আমাদের শরীরে গ্রোথ হরমোন নিঃসরণ হয়। এই গ্রোথ হরমোনগুলো ফ্যাট বার্নিংয়ে প্রচুর সাহায্য করে। আপনি যদি এই প্রাকৃতিক বিষয়টি অগ্রাহ্য করেন তবে আপনার ডায়েট অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এবং ভালো ফল পাবেন না।
* খুব সকালে ঘুম থেকে উঠবেন। মুসলমান ধর্মের অনুসারী হলে নামাজ পড়ে হাঁটতে বের হবেন। খালিপেটে হাটা ফ্যাট বার্নিংয়ের জন্য অত্যন্ত কার্যকরী। হাঁটার গতি নির্ভর করবে আপনার বয়স অনুসারে। বয়স যদি চল্লিশের উপরে হয় তবে স্বাভাবিক গতিতে হাঁটুন ৪০-৬০ মিনিট। বয়স যদি চল্লিশের নিচে হয় তবে জগিং করুন নয়তো জোরে জোরে হাঁটুন ৪০-৬০ মিনিট। তবে খেয়াল রাখবেন হাঁটতে হাঁটতে যেন হাঁপিয়ে না যান বা শ্বাসকষ্ট না হয়।
* দ্রুত মেদ ভুরি কমানোর জন্য ইয়োগা করতে পারেন। ইউটিউবে ইয়োগা করার বিভিন্ন পদ্ধতি শিখতে পারবেন।
* উপরে লিখিত পদ্ধতিতে সাত থেকে আট দিন নিয়ম করে চলুন। এই সময়ে আপনার শরীর ফ্যাট বার্নিং বা চর্বি গলাতে শিখে যাবে। এটি হচ্ছে আপনার ডায়েটিং এর প্রথম ধাপ।
* এবার দ্বিতীয় ধাপে শুরু করুন রোজা রাখা। সাহরিতে শুধু পানি খেয়ে রোজা রাখা আরম্ভ করুন। স্বাভাবিক রোজার মতো দিনে পানি এবং সমস্ত কিছু খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
* ইফতার করবেন বাদাম, মাখন এবং শসা দিয়ে। সাথে অন্যান্য সালাদ কিংবা টক ফল রাখতে পারেন।
* আপেল সাইডার ভিনেগার মিশ্রিত পানি খেয়ে রাতের খাবার উপরে উল্লিখিত অনুরূপ খাবেন এবং অবশ্যই আটটার আগে সমস্ত খাবার শেষ করবেন। বেশি ভালো ফল পেতে ইফতারের এক ঘণ্টার ভেতর খাবার শেষ করুন এরপর পানি খেতে থাকুন।
* রোজা রাখা শুরু করলে বসা থেকে দাঁড়াতে মাথা সামান্য ঘুরতে পারে। সেক্ষেত্রে সামান্য লবণ মিশ্রিত পানি খাবেন প্রতিদিন ইফতারে। এছাড়া ডাবের পানি খেতে পারেন। প্রতিদিন একটি কচি ডাব খাওয়া খুবই জরুরি।
একটানা যতগুলো ফাস্টিং বা রোজা করতে পারবেন তত দ্রুত ফল পেতে থাকবেন। তবে ৭দিন পর দুইদিন রোজা বিরতি দেবেন। এই দুইদিনও দুইবেলা খাবেন চার ঘণ্টার ব্যবধানে। খাবারের মেন্যু আগের মতোই থাকবে। বাকী সময় ওয়াটার ফাস্টিং করবেন। অর্থাৎ ভিনেগার, লেবু, গ্রীন টি, লবণ মিশ্রিত পানি এসব খাবেন।
* যদি একটানা রোজা রাখতে না পারেন তবে সপ্তাহে অন্তত দুটি করে রোজা রাখুন। আর যাদের পুরো দিনে রোজা রাখতে সমস্যা হয় তারা উপরের মেন্যুগুলো অনুসরণ করে খাদ্যবিরতির সময়টা দীর্ঘ করবেন। অর্থাৎ আংশিক ফাস্টিং করে যাবেন। দুইবেলা খাবেন চার ঘণ্টার ব্যবধানে। খাবারের মেন্যু আগের মতোই থাকবে।৷ বাকী বিশ ঘণ্টা ওয়াটার ফাস্টিং করবেন। অর্থাৎ ভিনেগার, লেবু, গ্রিন টি, লবণ মিশ্রিত পানি এগুলো খাবেন। সেইসঙ্গে নিয়মিত হাঁটুন এবং ব্যায়াম করুন। আশা করা যায় দেড়, দুই মাসের ভেতরেই আপনি আপনার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন।
আরও যেসব বিষয়ে খেয়াল রাখবেন
* যতটুকু সম্ভব দুশ্চিন্তামুক্ত থাকার চেষ্টা করবেন।
* হাসিখুশি থাকবেন।
* প্রতিদিন হাঁটার সময় বা হাঁটার পরে সকালের রোদ গায়ে লাগানোর চেষ্টা করবেন। কারণ রোদে থাকা ভিটামিন ডি আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়তা করে।
* রাত আটটার ভেতর সমস্ত ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন। এতে ঘুম ভালো হবে।
* মুসলমান ধর্মের অনুসারীরা নিয়মিত নামাজ পড়বেন। বেশি বেশি নফল নামাজ পড়বেন। এতে আপনার ফরজ আদায় হওয়ার পাশাপাশি শারীরিক কিছু ব্যায়াম হবে। যা আপনার স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। অন্য ধর্মের হলে নিজ নিজ ধর্মের রীতি অনুসারে ইবাদত করুন। আর সৃষ্টিকর্তার উপর বিশ্বাস রাখুন এবং ভরসা রাখুন। অবশ্যই আপনি সফলকাম হবেন।
* বাইরের সব খাবার পরিহার করুন।
* তরকারির জন্য প্যাকেটজাত মশলা না কিনে নিজেরা আস্ত মশলা মেশিনে ভাঙিয়ে নিন। সব ধরনের প্যাকেটজাত দ্রব্য পরিহার করার চেষ্টা করুন।
* রান্নায় সয়াবিন তেলের পরিবর্তে এক্সটা ভার্জিন অলিভওয়েল ব্যবহার করতে না পারলে আপাতত সরিষার তেল ব্যবহার করুন।
ডা. জাহাঙ্গীর কবির এর ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত