বছরের শেষ সময়। বার্ষিক পরীক্ষা শেষে সব ছেলেপুলে ঝাড়া হাত-পা। খেলা-খাওয়া-ঘুম, দিনের মধ্যে কাজ বলতে এই তিন। এমনসব দিনে মায়েরা কিছুটা নিশ্চিন্ত যেন, তাদের মেজাজও ফুরফুরে। সবচেয়ে ভালো পোশাকগুলো ব্যাগের ভেতর গুছিয়ে নিয়ে মা-বাবা, ভাই-বোনের সঙ্গে নানাবাড়ি বেড়াতে যাওয়ার সময়টা এই শীতকাল। কখনো বাবার ছুটি মেলে না, মা একাই ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার বাবার বাড়ি বেড়াতে যান। খুব ভোরে নানি কিংবা মামীর হাতে তৈরি কোনো পিঠার মিষ্টি গন্ধ নাকে এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। আরামের বিছানা ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়েই পিঠা খেতে ছুট! তারপর চুলার পাশে বসে গরম গরম ভাপা কিংবা চিতই খাওয়া। ছেলেবেলার শীতকালের এমন ছবি আমাদের প্রায় সবারই চেনা।

পিঠায় পরিবর্তন

সময়ের সঙ্গে সবকিছুরই পরিবর্তন হয়। তাই আমরা বড় হতে হতে বদলে যায় শীতকালের সেই চির পরিচিত চেহারাও। পুরোনো ও নতুন মিলে সামনে দাঁড়ায় ভিন্ন কিছু। এখন শীতের দিনে নানাবাড়ি কিংবা আত্মীয়বাড়ি বেড়ানোর সময় মেলে না খুব বেশি। সেই ধোঁয়াওঠা গরম পিঠা খাওয়ার ভোরগুলোকেও খুব একটা খুঁজে পাওয়া যায় না। তবু হারাতে হারাতেও কিছুটা থেকে যায় শীত ও পিঠার ঘনিষ্ঠতা। গ্রাম ও শহর মিলেমিশে তৈরি হয় শীতের পিঠার নতুন কোনো রূপ। আবার কিছু পিঠা রয়ে যায় সেই আগের মতোই, প্রতি কামড়ে ফিরে ফিরে আসে ছেলেবেলা।

শুধু কি শীতকালেই পিঠা খাওয়া হয়?

শীতের সময়ে পিঠা বেশি খাওয়া হয় একথা ঠিক। তবে বছরের অন্যান্য সময়েও তৈরি করা হয় কোনো না কোনো পিঠা। বিশেষ করে উৎসব-পার্বণে পিঠা ছাড়া ফাঁকা ফাঁকা লাগে। আমাদের দেশে নতুন জামাইয়ের জন্য শ্বশুরবাড়িতে পিঠা তৈরির প্রচলন দীর্ঘদিনের। অতিথি আপ্যায়নেও রাখা হয় নানারকম পিঠা। আবার যেসব পিঠা অল্প সময়ে তৈরি করা যায় তা বিকেলের নাস্তায় কিংবা শিশুর টিফিনেও দেয়া হয়ে থাকে। আসল কথা হলো, পিঠাকে আমাদের খাবারের তালিকা থেকে আলাদা করা প্রায় অসম্ভব।

পিঠা খাওয়ার প্রচলন কতদিনের?

এই যে শীতের সময়ে পিঠা খাওয়ার প্রচলন, এ কিন্তু অল্পদিনের নয়। বরং বাঙালির খাবারের ইতিহাস ঘাঁটলে পিঠার অস্তিত্ব পাওয়া যায় অন্তত পাঁচশো বছর আগে থেকে। পুরোনো অনেক গল্প, লোকগাঁথায় উঠে এসেছে নানা পিঠার নাম। আর এ থেকেই বোঝা যায়, পিঠা আমাদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অঙ্গ হিসেবে জড়িয়ে আছে। ঋতুর ধারাবাহিকতায় হেমন্তের পরে আসে শীত। হেমন্তের সময়টা বাঙালি কৃষকের জন্য সবচেয়ে খুশির সময়। কারণ এসময় তাদের উঠোন ভরে যায় সোনারঙা ধানে। ধান থেকে চাল হয়, আর সেই নতুন চালের সঙ্গে শীতে এসে যোগ হয় খেজুরের রস কিংবা গুড়। এই দুই মিলে সবচেয়ে সুস্বাদু পিঠাগুলো তৈরি হয় শীতকালেই।

হরেক পিঠা, হরেক নাম

পিঠার স্বাদ নিয়ে বাঙালি কাউকে নতুন করে বলে দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কারণ প্রধান খাদ্য ভাতের পরেই আয়োজন করে যে খাবারটি খাওয়া হয়, তা হলো পিঠা। সেসব পিঠার আবার একেকটির একেক নাম, একেক পরিচয়। স্বাদের যে কত রকম ভিন্নতা হতে পারে, তা সেসব পিঠা না চাখলে বোঝা সম্ভব নয়। কোনোটি হয়তো ডুবো তেলে ভাজা, কোনোটি আবার ভাপে তৈরি। কোনোটি শুকনো খোলায়, কোনোটি আবার দুধে ভেজানো। চিতই, ভাপা, পুলি, ছিটা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকন, লবঙ্গ লতিকা, পোয়া পিঠা, মুঠি পিঠা, নকশি পিঠা, গোকুল পিঠা, সেমাই পিঠা ইত্যাদি প্রায় সব এলাকায়ই পরিচিত। তবে এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য নাম ও স্বাদের পিঠা। সেসব পিঠা আবার একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত।

পিঠার স্বাদ, স্বাদের পিঠা

শীতের পিঠার স্বাদের জায়গাটি একচ্ছত্রভাবে খেজুর গুড়ের মিষ্টি স্বাদ দখল করে রেখেছে দীর্ঘদিন। তাই বলে যে অন্য কোনো স্বাদের অস্তিত্ব নেই, তা কিন্তু নয়! বরং ঝাল কিংবা নোনতা স্বাদের পিঠাও খাওয়া হয় এই সময়ে। চিতই যেমন ঝোলা গুড় কিংবা খেজুর রসে ভিজিয়ে খাওয়া হয়, তেমনই খাওয়া হয় ঝাল কোনো ভর্তার স্বাদে। এখন তো মরিচ, পেঁয়াজ, ধনে পাতা কুচি সহযোগেও চিতই তৈরি করা হয়। তার নাম দেয়া হয়েছে ঝাল চিতই। শুধু চিতই নয়, ঝাল ভাপা, ঝাল পোয়া এমনকী ঝাল পাটিসাপটাও তৈরি হয়ে থাকে। কেউ মিষ্টি খেতে বেশি ভালোবাসে, কেউ আবার ঝাল। সবার পাতেই যেন শীতের আনন্দ গড়াগড়ি খায়, তাই এই ব্যবস্থা!

শহরে শীতের পিঠা

শীতের পিঠার সঙ্গে গ্রামের সম্পর্ক প্রায় পুরোটাই। কারণ শহরে ইট-পাথরের ভিড়ে নতুন ধান, খেজুর রস আকাশ-কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়! তবু জীবন ও জীবিকার টানে প্রিয় অনেককে দূরে রেখে আমাদের শহরেই বসবাস করতে হয়। নিরন্তর এই ছুটে চলায় অবসর মেলে না প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে একটুখানি শীতের পিঠার স্বাদ নেয়ার। তবু দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো করে শহরেই বসে শীতের পিঠার আয়োজন। পিঠা মেলা ঘুরে কেনা যায় নানা রকম পিঠা। তবে সেসব পিঠায় মায়ের হাতের ছোঁয়া খুঁজতে না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। রাস্তার ধারে যেসব পিঠার দোকান বসে, সেখান থেকেও কিনে খাওয়া যায় আর কোনো উপায় না থাকলে! অনেকে আবার হাজার ব্যস্ততার মাঝেও পিঠা তৈরি করেন ঘরে। কারণ পিঠা তো শুধু খাওয়ার জন্য নয়, অনুভবেরও বিষয় বটে!

অনলাইনে পিঠা কেনা

অনলাইন নির্ভর এই সময়ে অনলাইনে পিঠা কেনা যাবে না তাই কি হয়! এখন অনেকেই বাড়িতে তৈরি খাবার বিক্রি করছেন অনলাইনে। সেখানে মেলে নানারকম পিঠার দেখা। ঘরের স্বাদের সঙ্গে যোগ হয় কিছুটা পেশাদারিত্বের ছোঁয়াও। যাদের খুব বেশি সুযোগ নেই পিঠা তৈরি করে খাওয়ার, তারা নেট ঘেঁটে পিঠা তৈরির কোনো কারিগরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন। শীতের সময়টা পিঠা থেকে বঞ্চিত বুভুক্ষু হয়ে যেন কাটাতে না হয়। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম আমাদের ঐতিহ্যের অংশ এই পিঠাকে পরিচিত করার দায়িত্বও যে আমাদের!

এইচএন/এএ