আমরা যা খাই তার ওপর আমাদের শরীরের বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ অবস্থা নির্ভর করে। এটা তো আমরা সবাই জানি, তাইনা? কিন্তু শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ব্রেনের সুস্থতা ও কর্মক্ষমতা অটুট রাখতে সঠিক খাবারগুলো বেছে নিচ্ছি তো? ব্রেন আমাদের সব ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে, আমদেরকে চিন্তা ও অনুভব করার ক্ষমতা দেয়, স্মৃতি গঠনে সাহায্য করে। মোটকথা, এমন সবকিছুই ব্রেন নিয়ন্ত্রণ করে যার জন্য আমরা রক্ত মাংসের শরীর থেকে মানুষ হয়ে উঠি। 

বয়সের সাথে সাথে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ব্রেনের কর্মক্ষমতা কমতে থাকে। প্রয়োজন হয় বিশেষ যত্নের। ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে কোন খাবারগুলো খাবার সবচেয়ে কার্যকরী, তা জানার আগে মস্তিষ্ক উপযোগী খাবার বলতে আসলে কী বোঝায় তা জেনে নিই।

ব্রেইন ফুড বা মস্তিষ্কের জন্য উপযোগী খাবার কী?

অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ভালো ফ্যাট, ভিটামিন ও মিনারেলে ভরপুর খাবারগুলোই ব্রেন ফুড হিসেবে পরিচিত। এসব খাবার আমাদের ব্রেনকে শক্তি জোগায়, ব্রেনের কোষগুলোকে সজীব রাখে, স্মৃতি ক্ষয়ের মতো রোগ গুলোকে দূরে রাখে। 

এখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পেটে যাওয়া খাবার মস্তিষ্কের উপর ঠিক কীভাবে কাজ করে? ব্রেইন ফুডগুলো আমাদের অন্ত্রে কিছু বিশেষ হরমোন আর নিউরো ট্রান্সমিটার তৈরি করে যা সরাসরি আমাদের ব্রেনে গিয়ে আমাদের বোধশক্তি, স্মৃতি গঠন ও মনোযোগ দেবার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।

হাভার্ড মেডিকেল স্কুল পরিচালিত একটি গবেষণায়, চল্লিশটি ভিন্ন দেশের ২৭,৮৬০ জন অংশগ্রহণকারীকে পাঁচ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছিল। দেখা গেছে যে, যারা ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির উপযোগী খাবারসখেয়েছেন তাদের জ্ঞানীয় ক্ষমতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাকিদের চেয়ে ২৪ শতাংশ কম ছিল। তাহলে চলুন দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর এই জাদুকরী খাবারগুলো সম্পর্কে।
 
বাদাম

ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান। যা বেশি মাত্রায় পাওয়া যায় বাদামে। ‘রিসার্চ গেট’ এ প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে পুষ্টিবিদ ‘কে এল কুমাওয়াত’ সারাদিন ব্রেনকে সতেজ রাখার জন্য দুটি কাঠবাদাম ও দুটি আখরোট খেয়ে দিন শুরু করার পরামর্শ দেন। 

ডার্ক চকলেট

কী? চকলেটের নাম শুনেই মনটা খুশি হয়ে গেলো? একটি ডার্ক চকলেটে ৭০% কোকোয়া থাকে এবং এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের খুব ভালো উৎস। ২০২২ সালে ‘হেলথলাইন’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে পুষ্টিবিদ ‘ক্রিস গুনারাজ’ বলেন, “ডার্ক চকলেট ব্রেনে রক্ত প্রবাহকে উন্নত করতে সাহায্য করে।” তাই তিনি ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রতিদিন ডার্ক চকলেট খাওয়ার পরামর্শ দেন। 

সবুজ শাক-সবজি

‘ন্যাশনাল লাইব্রেরী অফ মেডিসিন’ জানুয়ারি ২০১৮ তে, বিভিন্ন ধরনের সবজি খাওয়ার সাথে ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির ওপর একটি গবেষণা করে। ফলাফলে দেখা যায় যে, পালং শাক, কেইল, ব্রকলি ইত্যাদি কিছু গাঢ় সবুজ শাক-সবজি ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী।

ব্রকলি

ব্রকলিতে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, ফ্লাভোনয়েডস, আয়রন, ভিটামিন-ই ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ‘এন সি বি আই (ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফর্মেশন)- এর মতে, এই পুষ্টি উপাদানগুলো চিন্তাশক্তির গতিশীলতা বাড়াতে এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে খুব কার্যকরী উপাদান।

পালং শাক

পালং শাক ও ভিটামিন ই এর ভাণ্ডার। রান্না করা পালং শাকে আমাদের দৈনিক চাহিদার ২৫ পার্সেন্ট ভিটামিন ই থাকে যা আমাদের স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

টমেটো

টমেটো লাইকোপেন নামক একটি এন্টিঅক্সিডেন্ট এর আধার, যা কোষের দ্রুত ক্ষয় প্রতিরোধ করে। প্রতিদিনের খাবারে টমেটো রাখলে তা ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে ও স্মৃতির অবক্ষয় হ্রাসে  সাহায্য করে।

বিভিন্ন বীজ জাতীয় খাবার

বীজ জাতীয় খাবারগুলো ভিটামিন ই এর ভালো উৎস। গবেষণা থেকে প্রমাণিত যে, ভিটামিন-ই স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাওয়া কমাতে সাহায্য করে। এসব বীজের মধ্যে কুমড়ো বীজ, সূর্যমুখীর বীজ, তিল বীজ, চিয়া বীজ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। তাই ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রতিদিন এক আউন্স পরিমাণ বীজ খেতে ভুলবেন না।

ফল

ফল খেতে পছন্দ করে না এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যায়! ফল বিভিন্ন ভিটামিন ও মিনারেলের একটি চমৎকার উৎস। ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে উপকারী কিছু ফল সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

আপেল

২০০৬ সালে করা একটি গবেষণায় দেখা যায়, আপেলে ‘কারসেটিন’ নামের এক ধরনের এন্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে যা কোষের মৃত্যুর হার কমায়, নিউরনের প্রদাহজনিত সব রোগের ঝুঁকি কমায়। এমনকী আপেলের রসের সঙ্গে মস্তিষ্কে বেশি পরিমাণে নিউরো ট্রান্সমিটার তৈরির সম্পর্ক পাওয়া গেছে, যা স্মৃতিশক্তিকে উন্নত করতে এবং ব্রেনের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

ভিটামিন সি জাতীয় ফল

ভিটামিন সি জাতীয় ফল স্মৃতিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। কমলা, ডালিম, কিউই, জাম ইত্যাদি ফল উল্লেখযোগ্য। 

ডিম

‘ইউ সি এল এ হেলথ’ এ প্রকাশিত একটি রিসার্চ পেপারে বলা হয়েছে, ডিমে রয়েছে কোলিন, ভিটামিন বি ১২, প্রোটিন যা স্নায়ু সতেজকারী। বিশেষত কোলিন ব্রেনের স্বাভাবিক গঠন নিশ্চিত করা ও কার্যক্ষমতা বৃদ্ধিতে সবচেয়ে কার্যকরী উপাদান। 

ওটস

মস্তিষ্কের কর্ম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাবার হলো ওটস। ওটস এর মধ্যে রয়েছে ভিটামিন ই, বি কমপ্লেক্স এবং জিংক। স্মৃতি ধূসরতা নিয়ন্ত্রণে দারুণ ভূমিকা রয়েছে এই ওটসের।

তৈলাক্ত ও সামুদ্রিক মাছ

মাছ তো আমরা সবাই খাই, কিন্তু জানেন কি তৈলাক্ত মাছ খাওয়া মস্তিষ্কের ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ উপকারী? রুই, তেলাপিয়া, সারডিন, টুনা সহ অন্যান্য সামুদ্রিক মাছ উল্লেখযোগ্য।

চা কফি ও অন্যান্য ক্যাফেইন যুক্ত পানীয়

নিউইয়র্কের ‘লেনোক্স হিল’ হাসপাতালের পুষ্টিবিদ জনাথন পারটেল এর মতে গ্রিন টি ও ব্ল্যাক টি ও কফি মস্তিষ্কের জন্য বিশেষভাবে উপকারী। চায়ে থাকা ‘এল থিয়ানিন’ নামক ‘অ্যামিনো এসিড’ মনোযোগ বাড়ায়। 

ব্রেনের জন্য ক্ষতিকর খাবার

শুধু খেলেই হবে না, কিছু খাবার বাদ দেওয়া ও মস্তিষ্কের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যেমন প্রক্রিয়াজাত খাবার যেগুলোতে সেচুরেটেড ফ্যাট, ট্রান্স ফ্যাট, অতিরিক্ত লবণ ও চিনি থাকে সেগুলো বাদ দিলেই মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা অটুট থাকবে। 

শেষ কথা

আশাকরি ব্রেনের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকরী সব খাবার সম্পর্কে আমরা এতক্ষণে জেনে গেছি। এসব খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম ও মেডিটেশন করা, মনকে উদ্দীপিত করা, দুশ্চিন্তা কাটিয়ে ওঠা, পর্যাপ্ত বিশ্রাম ও পরিবারের সাথে সময় কাটানোর মাধ্যমে আমরা আমাদের ব্রেন কে আরো কর্মক্ষম করে তুলতে পারি। 

এইচএন