খাবার সবাই খায়। তবে কেউ খায় কেবল বেঁচে থাকার তাগিদে আর কেউ সেসঙ্গে সুস্থভাবে বাঁচতে। দীর্ঘমেয়াদী রোগ আর অসুস্থতা থেকে দূরে থাকতে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের বিকল্প নেই। তার জন্য শরীর আর মন দুটোই ভালো থাকা চাই। সুস্থভাবে বাঁচতে সঠিক খাদ্য বেছে নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে ফাংশনাল ফুড হতে পারে রোজকার সঙ্গী। 

ফাংশনাল ফুড কী?

ফাংশনাল ফুড বলতে মূলত এমন কিছু প্রাকৃতিক ও নিরাপদ খাদ্যকে বোঝানো হয় যা দেহের মৌলিক পুষ্টি চাহিদা তো পূরণ করেই, উপরুন্ত শরীরে এমন কিছু কার্যকরী ভূমিকা রাখে যা বিশেষ কিছু রোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সহজ ভাষায় বলা যায়, যেসব খাবার বা খাবারের উপাদান পুষ্টির চাহিদা মিটিয়েও স্বাস্থ্যোপকারিতা দেয় সেগুলোই ফাংশনাল ফুড। এসব খাবারে থাকে বায়ো-অ্যাকটিভ উপাদান যা আমাদের দেহে কার্যকরী প্রভাব রাখে। পরিচিত কিছু ফাংশনাল ফুড হলো- হলুদ, আদা, মধু, রসুন, কালোজিরা, দারুচিনি, গোলমরিচ, লবঙ্গ ইত্যাদি।

ফাংশনাল ফুডের ইতিহাস

খাবারের মাধ্যমে সুস্থ থাকার পদ্ধতি হাজার বছরের পুরনো। কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা পত্র অনুযায়ী, ফাংশনাল ফুডের ধারণা সর্বপ্রথম পাওয়া যায় প্রায় ২৫০০ বছর আগে গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিসের উক্তি ‘খাবার হোক ওষুধ আর ওষুধই খাদ্য’- থেকে। 

পরবর্তীতে ফাংশনাল ফুড কথাটির উদ্ভব হয় জাপানে। ১৯৮০ সালে জাপান সরকার প্রমাণিত উপকারের ভিত্তিতে সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যোপকারিতার কথা বিবেচনায় এমন খাবার সমর্থন দেওয়া শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায়, ফাংশনাল ফুডের কার্যকারী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও গবেষণার জন্য ১৯৮৪ সালে দেশটির সরকার একটি বাজেট বরাদ্দ করে।  

গবেষণা শেষে ১৯৯১ সালে জাপান আইন প্রণয়ন করে ‘ফুড ফর স্পেশালাইজড হেলথ ইউজ (এফওএসএইচইউ)’ বিভাগের আওতায় কিছু খাবার সংযুক্ত করার মাধ্যমে সেগুলোতে এফওএসএইচইউ লেবেল দেওয়ার অনুমোদন দেয়।

বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ পাস করে। এই আইনের ৩১ নং ধারার অধীনে ‘ফাংশনাল ফুড’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অর্গানিক নিউট্রিশন লিমিটেড প্রথম বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফাংশনাল ফুড নিয়ে গবেষণা, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাত শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ‘কারকুমা’ ব্র্যান্ডের মাধ্যমে সর্বত্র পৌঁছে দিচ্ছে অর্গানিক ফাংশনাল ফুড।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আর পুষ্টিবিদরা ফাংশনাল ফুডকে কেমন চোখে দেখেন? তাদের কাছে এই বিশেষ খাদ্যের ব্যাখ্যাই বা কী? 

পুষ্টিবিদ আয়শা সিদ্দিকার মতে, ‘ফাংশনাল ফুড বলতে এমন খাবারকে বোঝানো হয় যেসব খাবার আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াবে এবং রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করবে, বিকাশে সাহায্য করবে, পুষ্টির ঘাটতি দূর করবে। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় থাকা কিছু পরিচিত ফাংশনাল ফুড হলো আদা, হলুদ, জিরা, রসুন, দারুচিনি, এলাচ ইত্যাদি। এসব খাবারে বাড়তি কিছু পুষ্টি উপাদান থাকে যা আমাদের সুস্থ থাকার পথ প্রশমিত করে। এই যেমন, হলুদের ইনফ্লামেটরি গুণ থাকে। এটি পাকস্থলীর সুরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ প্রদাহ রোধে অ্যান্টিবায়োটিকের মতো কাজ করে।’

ফাংশনাল ফুড বলতে সেসব খাবারকে বোঝানো হয় যাতে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, অ্যান্থোসায়ানিনস, নিয়াসিন, রিবোফ্লাভিন, লিপিড পারঅক্সিডেশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ উপাদান থাকে। সুস্থ ও রোগমুক্ত জীবনের জন্য ফাংশনাল ফুডের কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন পুষ্টিবিদ আয়শা।  

ফাংশনাল ফুড নিয়ে জানতে যোগাযোগ করা হয় লিভার, গ্যাস্ট্রো-এন্টেরোলজি ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এম. সাঈদুল হকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের খাদ্যাভ্যাস ও লাইফস্টাইলে পরিবর্তন হয়েছে। পাশাপাশি কমেছে কায়িক শ্রমের পরিমাণ। অতীতে আমরা প্রাকৃতিক খাবার খেলেও বর্তমানে ফাস্টফুড, প্রসেস ফুড বেশি খাচ্ছি। ফলে শরীরে খাদ্য থেকে পাওয়া গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। ফলে সামগ্রিকভাবেই স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, দীর্ঘমেয়াদী রোগ দেখা দিচ্ছে। এমনকি অনেক জটিল রোগের চিকিৎসার পরও ভালো ফল মিলছে না। আসলে কেবল ওষুধ দিয়ে রোগ নিরাময় সম্ভব নয়। সুস্থ থাকতে খাদ্য ও খাদ্য উপাদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে ফাংশনাল ফুড উপযুক্ত। এসব খাবারে থাকে গুরুত্বপূর্ণ খাদ্য উপাদানের সুষম বণ্টন। যা সুস্থতার জন্য জরুরি।’

ফাংশনাল ফুড কি ফ্যাটি লিভারের মতো জটিল স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান হতে পারে? জানতে চাইলে এই গ্যাস্ট্রোলিভার বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ফ্যাটি লিভারে ভোগা রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এই সমস্যা নিরাময়ে ফাংশনাল ফুডে যে অ্যান্টি অক্সিডেন্ট রয়েছে তা অত্যন্ত কার্যকর হিসেবে বিবেচিত। এমনকি লিভার সিরোসিসের মতো রোগকে দূরে রাখতেও ফাংশনাল ফুডের বিভিন্ন উপাদান কার্যকরী ভূমিকা রাখে।’ 

ফাংশনাল ফুডের পূর্ণ কার্যকারিতা পেতে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাপন পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। তবেই মিলবে সুফল।