মাদকের মতোই শিক্ষার্থীদের আসক্ত করে সোশ্যাল মিডিয়া
বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীর একটি বড় অংশেরই বয়স ১৮-এর নিচে। এই বয়সী শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়া বেশ শক্তিশালী প্রভাব রাখতে সক্ষম। যুক্তরাজ্যে ১৩ থেকে ১৬ বছর বয়সীদের ওপর ২০১৯ সালে করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, দিনে তিনবারের বেশি সোশ্যাল মিডিয়ায় থাকা শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুস্থতা ধীরে ধীরে কমছে। মোট ১২,০০০ জনের ওপর এই গবেষণা করা হয়। ২০১৬ এমআইটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘন ঘন উপস্থিতির ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে গুরুতর বিষণ্ণতা ৭% এবং উদ্বেগজনিত ব্যাধি ২০% বৃদ্ধি পেয়েছে।
গবেষকরা আরও আবিষ্কার করেছেন যে, বেশি রাতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার বিভিন্ন একাডেমিক পরীক্ষার দুর্বল স্কোরের কারণ ছিল এবং উচ্চ স্তরের উদ্বেগ এবং বিষণ্ণতার কারণও হয়েছিল। এখন প্রশ্ন হলো, এত নেতিবাচকতার প্রমাণ পাওয়ার পরও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার শিক্ষার্থীদের মাঝে বেড়েই চলেছে কেন? এর উত্তর রয়েছে নিউরোসায়েন্স এবং আমাদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতার মধ্যে।
বিজ্ঞাপন
সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম আমাদের মস্তিষ্কের ডোপামিনার্জিক আনন্দের পথকে উদ্দীপিত করে। ডোপামিন আমাদের মস্তিষ্কে উৎপন্ন একটি রাসায়নিক যা আনন্দ, তৃপ্তি এবং অনুপ্রেরণার অনুভূতি দেয়। সোশ্যাল মিডিয়া অ্যালগরিদম বিস্ময়, পুরষ্কার এবং উত্তেজনার অনুভূতিকে উদ্দীপিত করে, যার সবগুলোই ডোপামিনকে ট্রিগার করে। এটি বিভিন্ন উপায়ে মস্তিষ্কে প্রতিক্রিয়া তৈরি করে, যেমনটা কারো মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্তি থাকলে ঘটে থাকে।
আরও পড়ুন
সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে অত্যধিক উত্তেজনার বিপদ হলো যে, ডোপামিন স্মৃতি, মেজাজ, ঘুম, একাগ্রতা, নড়াচড়া এবং শরীরের অন্যান্য ক্রিয়াকলাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে। সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যাধিক ব্যবহারের কারণে মস্তিষ্কে ডোপামিনের ক্ষয় হতে শুরু করে এবং অন্যান্য আসক্তির মতো এই উচ্চতা বজায় রাখার জন্য মস্তিষ্কের আরও বেশি ডোপামিন প্রয়োজন হয়। ইন্ডিয়ান জার্নাল অফ পাবলিক হেলথ-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, যেসব শিক্ষার্থী সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক বেশি ব্যস্ত ছিল তাদের ঘুমের মান খারাপ, একাগ্রতা হ্রাস এবং পরবর্তীকালে একাডেমিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষাবিদরা দেখেছেন যে, সোশ্যাল মিডিয়ার অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে শিক্ষার্থীদের পড়ায় মনোযোগ দেওয়া এবং তথ্য মনে রাখার ক্ষমতা অনেকটাই কমে যায়।
কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখবেন
এই প্রভাবগুলি প্রশমিত করার জন্য কী করা যেতে পারে? প্রতিদিনের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে যুক্তিসঙ্গত সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাটিং কম, মুখোমুখি যোগাযোগ বেশি করতে হবে। অভিভাবকেরা তাদের কিশোর ছেলেমেয়ের অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ করবেন। তারা কীভাবে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছে সে সম্পর্কে কথা বলবেন বা জানার চেষ্টা বরবেন। এটি তাদের কীভাবে এবং কতটা প্রভাবিত করছে তা বোঝার চেষ্টা করতে হবে। কিশোর বয়সে পৃথিবীর অনেকটাই অচেনা থাকে। এসময় সোশ্যাল মিডিয়ার জগতকে স্বপ্নের মতো মনে হয়। তাদের বুঝিয়ে বলুন বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে এর ফারাক কতখানি।
কেবল মা-বাবার প্রচেষ্টাই এই সামাজিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট নয়। দায়িত্ব রয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলোরও। আমরা সেই যুগে পৌঁছেছি যেখানে মানুষই শুধু প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করছে না, প্রযুক্তিও মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করছে। এটি আমাদের সামাজিক সংযোগ, খরচের ধরণ এবং এমনকি মূল্যবোধকে আকার দিচ্ছে। কিশোর-কিশোরীরা এখন জ্ঞানে সমৃদ্ধ হওয়ার চেয়ে প্রযুক্তিতে অনেক বেশি দক্ষ। আমরা ইতিমধ্যে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছি যেখানে সামাজিক মিডিয়া অ্যালগরিদম আর্টিফিসিয়াল ইনটেলিজেন্স দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। যা আমাদের নিজস্ব নৈতিকতা এবং মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলোকে আমাদের মূল্যবোধ সম্পর্কে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। এটি করতে ব্যর্থ হলে মানবতার সামাজিক কাঠামোর ওপর দীর্ঘস্থায়ী এবং সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।