জীবনের পাতাজুড়ে আমার বন্ধুরা
বিশ্বাস ও নির্ভরতার প্রতীক একটি সুন্দর বন্ধুত্ব। হাঁটতে, চলতে, ফিরতে, মন খুলে কথা বলতে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। মনের মিল থাকলে বন্ধুত্ব তৈরি হয় অনায়াসে। বন্ধুত্বের কোনো বয়সের সীমাবদ্ধতা নেই। শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সেও বিশ্বাস থেকে গেলে বন্ধুত্বের কদর কমে না।
পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্কটির নাম বন্ধু। এরিস্টটলের এই মতটাকে আমি পুরোপুরিভাবে চোখ বন্ধ করেই বিশ্বাস করি। কারণ, বিশাল এই পৃথিবীর বুকে এত এত অপরিচিত মানুষের ভিড়ে জীবনের প্রতিটা পদে আমি এমন একটা বন্ধুকে পেয়েছি যিনি আমার মা। আমার মা-ই হলো আমার সবথেকে কাছের বন্ধু। আমার মুখে হাসি দেখেই হাসেন তিনি। অথচ, কোনদিন বলা হয়নি ভালোবাসি। তবে আমার মাকে বন্ধুর মতো করে সব কথা খুলে বলতে পারি নির্ভয়ে। আবার কিছু সৎ বন্ধুকেও পেয়েছি। পেয়েছি নাবিল, তামিম এবং নোশেদকে। যারা আমার আপদে-বিপদে এগিয়ে আসে সবসময়।
বিজ্ঞাপন
প্রাথমিকে পড়ার সময় ফার্স্ট বেঞ্চের ক্লাস ক্যাপ্টিন নাবিলকে পেয়েছি সেরা বন্ধু হিসেবে। নাবিলের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটেছিল সদ্য কেজিতে ভর্তি হওয়া নার্সারি ক্লাসেই। মন খারাপ হলে তার কাছেই চলে যেতাম, দুজনে মন খুলে হাসি খুশি মুখে কথা বলতাম। তখনও কিন্তু আমাদের জানা ছিল না বন্ধু শব্দের অর্থ কী? জানতাম না, মন খারাপের সময় কে আমার পাশে বসে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে? বুঝতাম না এটাই বন্ধুত্ব।
একবার আমার ভীষণ জ্বর, বন্ধুরা চলে এলো বাড়িতে। মা বললেন, দেখ কারা এসেছে। তোর বন্ধুরা তোকে দেখতে এসেছে। দেখেছি বন্ধু নাবিল মন খারাপ করে শিয়রে বসে থাকলো সন্ধ্যা পর্যন্ত। বন্ধুর বিষণ্ণ মুখ দেখেছি আমি সেদিন। বুঝতে দেরি হয়নি বন্ধুর ব্যথায় বন্ধুর হৃদয়েও বিষণ্ণতা নেমে আসে। তখনও কিন্তু আমরা একে অপরকে বন্ধু বলে ডাকিনি। এভাবেই প্রাইমারি শেষ হলো, আমিও চলে এলাম শহরে। বন্ধুরা চলে গেল অন্য বিদ্যাপিঠে। বন্ধুত্বের বন্ধনে দূরত্বের দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকলো স্মৃতি। পরে আমি শহরে থাকায় দেখাও হয়নি। তবে বছরের পর বছর বন্ধুত্ব টিকে গেছে। যোগাযোগ বিছিন্ন হয়েছে বেশ কয়েকবার, তারপরও কোনো না কোনোভাবে একজন আরেকজনকে খুঁজে বের করেছি।
নাবিলের সঙ্গে আমার অনেক অমিল রয়েছে। যেমন: আগ্রহ, পড়াশোনা, অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। তারপরও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। শহরে থাকতে তাদেরকে ভীষণ মনে পড়তো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাঝে মাঝে তাদের কথা ভেবে চোখ থেকে অশ্রু ঝরতো। গ্রামে গেলে তাদের খোঁজ নিতে প্রতিদিন হোস্টেলে যেতাম। পরিচিত কাউকে পেলে জিজ্ঞেস করতাম- নাবিল কোথায়? মাঝে মাঝে তার দেখা পেতাম, একজন আরেকজনের দুঃখ-কষ্ট, আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গভীর আলোচনা করতাম। আলোচনা শেষে আবার মাসের পর মাস কিংবা কয়েক বছর যোগাযোগ বিছিন্ন। আবার শহর থেকে গ্রামে গেলে গভীর আলোচনা। গভীর কৌতূহল। গভীর সখ্য।
আরেক বন্ধু ইফাজের কথাও বলা যাক। ইফাজের সঙ্গে আমার পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব তৈরি হয় ক্লাস ফাইভে। পড়াশোনায় যথেষ্ট মনোযোগী এবং মেধাবী হওয়ায় তার কাছ থেকে আমি বিভিন্ন বিষয়ে সহযোগিতা নিতাম। এক পর্যায়ে তার সঙ্গে আমার ভালোলাগা এবং বন্ধুত্ব তৈরি হয়। পরীক্ষা শেষে প্রায় দীর্ঘকাল পর্যন্ত তার সঙ্গে আমার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। এখন ইন্টারনেটের কল্যাণে তার সঙ্গে মাঝে মাঝে কথা হয়। কিন্তু কখনো দেখা হয়ে ওঠেনি। বলা হয়নি বন্ধু তোকেও ভালোবাসি। এভাবেই আমাদের জীবনে কারো না কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও বন্ধুত্ব থেকে যায় আমৃত্যু। কারো সঙ্গে দেখা হয় আবার কারো সঙ্গে দেখা হয় না।