ছবি : লেখিকা ও চরভদ্রাসন মডেল স্কুল।

আমার স্কুলজীবনের হাতেঘড়ি হয়েছিলো চরভদ্রাসন মডেল স্কুল থেকে। সেই সময় থানা শহরে ওই একটাই প্রাইমারি স্কুল ছিল এবং সবচেয়ে ভালো স্কুল। থানা শহর থেকে আমাদের বাড়ি ছিল তিন কিলোমিটার দূরের এক গ্রামে। আমাদের গ্রামেও একটা স্কুল ছিল, কিন্তু তুলনামূলক ভালো পরিবেশে পড়ানোর এবং উন্নত শিক্ষালাভের জন্য আমার মা-বাবা সেখানেই ভর্তি করলেন। প্রকৌশলী বাবা চাকরির সুবাদে থাকতেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায়, আর পুরোদস্তুর গৃহিনী মা সংসারের হাজারটা কাজ সামলে ঠিক আমাকে স্কুলে নিয়ে যেতেন, নিয়ে আসতেন, হোমওয়ার্ক করাতেন, পড়াশোনার সমস্ত খোঁজখবর থাকতো তার নখদর্পনে। 

প্রাইমারি স্কুল জীবন ছেড়ে এসেছি আজ অনেক বছর হলো। দু’-চারজন ছাড়া কারো সঙ্গেই আর যোগাযোগ নেই। কে কোথায় কেমন আছে জানি না। তখন তো ফেসবুক দূরে থাক, সেলফোনেরই সহজলভ্যতা ছিল না। নয়তো অনেকের সঙ্গে হয়তো যোগাযোগ রাখতে পারতাম। আমার এক সহপাঠী বান্ধবীর কথা ভীষণভাবে মনে পড়ে এত বছর পরেও। ইতু সিং। ওর বাবা টিএন্ডটি অফিসে চাকরি করতেন সম্ভবত। স্কুলের সঙ্গেই ছিল উপজেলা কোয়ার্টার। ওরা সেই কোয়ার্টারে থাকতো, একদম স্কুলের মাঠ সংলগ্ন বিল্ডিংটাতেই। ওর মতো ওদের বাসার সবাই খুব আন্তরিক ছিল। কাছে হওয়ার সুবাদে অনেকবার যাওয়া হয়েছে ওদের বাসায়। ও আমাকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন উপহার দিয়েছে। একবার বড়দিন উপলক্ষ্যে খুব সুন্দর বড়দিনের কার্ড দিয়েছিল। সেই কার্ড বহু বছর আমার কাছে যত্নে ছিল। কয়েক বছর আগে গ্রামের বাড়ি গিয়ে কার্ডটা অনেক খুঁজেও পাইনি। জানি না হঠাৎ করে কখনো খুঁজে পাবো কিনা, নাকি একেবারেই হারিয়ে ফেলেছি।

ইতুর সঙ্গে আমার বেশ সখ্যতা ছিলো। স্কুলজীবনে কত কত স্মৃতি আমাদের। একসাথে ক্লাস করা, খেলাধুলা করা, আইসক্রিম খেয়ে ড্রেস নষ্ট করা, পিকনিক করা, রূপকথার গল্প বলা, আরো কত কী। ক্লাস ফাইভে আমি স্কুল পরিবর্তন করলাম। সেই সঙ্গে জীবন থেকে ক্রমশ হারিয়ে যেতে থাকলো প্রাইমারি স্কুল জীবনের সবাই। একসময় ইতুকেও হারিয়ে ফেললাম। ওর বাবার ছিলো বদলির চাকরি। ইতুরা যে কোথায় চলে গেলো, কোনদিন আর খোঁজ পেলাম না। আমার বয়স বাড়লো, জীবনের স্তরে স্তরে কত শত বন্ধু গড়ে উঠলো, কিন্তু ইতু আমার মনের ঘরে আজও এক আশ্চর্য প্রদীপ হয়ে জ্বলে রইলো। 

ইতু, তুই আমাকে এত বছরে মনে রেখেছিস, নাকি ভুলে গেছিস জানি না। যদি তোর স্মৃতিপট থেকে আমি মুছে গিয়ে থাকি, তাহলে তা আমাকে দুঃখ দেবে খুব। আমি চাই, এ জীবনে অন্তত আর একটিবার আমাদের দেখা হোক। জানিস, চরভদ্রাসন এখন কত বদলে গেছে, কত উন্নত হয়েছে। মডেল স্কুলে নতুন ভবন হয়েছে, তাও কত বছর হয়ে গেল। স্কুলের সামনের পুকুরটা মাটি দিয়ে ভরাট করা হয়েছে। উপজেলা চত্বর আর স্কুলের মাঝে দেয়াল তুলে দেয়া হয়েছে। হেডমিস্ট্রেস খাদিজা আপা এখনো স্কুলে আছেন কি না জানি না, তবে যতদূর জানি মাকসুদা, নার্গিস আর পারুল আপা আছেন। তাদের কারো সঙ্গেই আমার আর দেখা হয় না। 

স্কুলের পেছনের টিএন্ডটি অফিসটা অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। টিএন্ডটি অফিস আর স্কুলের মাঝামাঝি যে বড় মাঠ, যেখানে আমাদের বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠিত হতো, সেই মাঠ আর আগের মতো সবুজ নেই। স্কুলের পাশের যে বাড়ি থেকে পেয়ারা খেতাম আমরা, সেই বাড়ির মানুষগুলোর সঙ্গেও আর কোনোদিন দেখা হয়নি। আমাদের স্কুলের বারান্দায় যে মীনার বাবা আইসক্রিম নিয়ে বসতেন আর মীনার মা রহিমা খালা স্কুলের যাবতীয় সাফ-সুতরোর কাজ করতেন, আপাদের ফুটফরমাশ খাটতেন, তাদের দেখাও পাইনি বহু বছর। স্কুল থেকে চলে আসার পরেও কিছুকাল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, কারণ মীনা আমাদের বাড়ি কাজ করেছিল কিছুদিন।

পরবর্তীতে শুনেছিলাম মীনার বিয়ে হয়েছে, আর কোনো খবর জানি না। আমাদের যে বন্ধু ছিল তপু, ও পাবনা চলে গিয়েছিল আংকেল বদলি হয়ে গিয়েছিলেন বলে, মনে আছে? অনেক বছর পর ওকে খুঁজে পেয়েছি। সেই আনন্দ বলে বোঝাবার নয়। তপুর মা-বাবা কত স্নেহ করতেন আমাদের। আমার সঙ্গে আবার তপুর যোগাযোগ হয়েছে বলে তারাও খুব খুশি হয়েছেন। আমি সবসময় তপু আর তোকে খুঁজে পেতে চাইতাম। অনেক সাধনার পর তপুকে পেলাম, কিন্তু তোকে আর পেলাম না। তারপর তপু একদিন আমাদের বাড়িতেও এসেছিল জানিস। কত পুরনো স্মৃতিচারণ করেছিলাম আমরা, তোর কথাও বলেছিলাম। তুই যে কোথায় হারিয়ে গেলি। 

জেরিন এখন এমবিবিএস ডাক্তার, ওর বরও। মুরসালিন এখন এক কন্যা সন্তানের বাবা। তুই আমার স্মৃতিতে ওইটুকুনই রয়ে গেছিস, ঝুঁটি বেঁধে স্কুলে আসা ইতু। তোকে কত খুঁজেছি ফেসবুকে, পাইনি রে। চরভদ্রাসনে এখন কয়েকটা কিন্ডারগার্টেন স্কুল হয়েছে। সেই ভীড়ে মডেল স্কুলটা যেন অনেকটা ম্লান হয়ে গেছে। হয়তো সবকিছুই একদিন এভাবে পুরনো হয়ে যায়, মলিন হয়ে যায়। তোর সঙ্গে যদি আবার এসব জায়গায় ঘুরে বেড়াতে পারতাম, ভালোলাগতো খুব। তুই এখন কোথায় থাকিস, কে জানে। আদৌ বাংলাদেশে আছিস কি না, বেঁচে আছিস কি না কিংবা জীবন তোকে কোথায় নিয়ে গেছে, তা সম্পূর্ণই আমার অজানা। আমাদের যদি আর একবার দেখা হতো, তোকে দীর্ঘসময় জড়িয়ে ধরে রাখতাম। আন্টি, আংকেলের সঙ্গেও দেখা করতাম। তারা বেঁচে আছেন তো? আমার বাবা যেমন মারা গেছে বছর চারেক আগে, তোর জীবনেও তেমন কোনো অঘটন ঘটেনি তো? মানুষ কেন এভাবে হারিয়ে যায়, ফুরিয়ে যায় বলতে পারিস? 

ইতু, আমি মোহনা, তোর ছোটবেলার বান্ধবি, খেলার সাথী। আমাকে তোর মনে আছে? ইতু সিং, তোকে বলছি, তোকে আমি আজও খুব ভালোবাসি, খুব মিস করি, খু-উ-ব। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকিস, খুব সুন্দর থাকিস।

শুভ বন্ধু দিবস ইতু।