ছবি: প্রতীকী

খুব ছোট বেলা থেকেই বাবা আমাদেরকে খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নামাজ আদায় করার অভ্যাস করিয়েছিলেন। আমাদের ডেকে দিয়ে বাবা মসজিদে যেতেন।ফজরের নামাজ আদায়ের পরেই বাবা বেরিয়ে পড়তেন কাজে। ফিরতেন সেই সন্ধ্যাবেলা। প্রতিদিন নয়, এই ধরো মাসে দশ- পনেরো দিনই বাবাকে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে দেখেছি। বাবার মুখটা শুকিয়ে যেত সারাদিন পরিশ্রম করে। তবুও বাড়ি ফিরলে মুখে একরাশ তৃপ্তির হাসির ঝলকের দেখা মিলতো বাবার মুখে। বাবার মলিন মুখটা দেখে কখনো কখনো জিজ্ঞেস করতাম, বাবা কী হয়েছে? তোমার মুখটা অমন মলিন দেখাচ্ছে কেন? সকালের নাস্তা করেছিলে কি? দুপুরে কী খেয়েছিলে? উত্তরে বাবা শুধু মাথা নেড়ে বলতেন, হ্যাঁ রে মা খেয়েছিলাম। 

যেদিন গুলোতে বাবা দুপুরের আগে বাড়ি ফিরতেন, সেদিন বাবা আমাদের দুই বোনকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতেন। পিঠাপিঠি হওয়ার কারণে আমরা দুই বোন একই ক্লাসে পড়তাম। আমরা দু-বোন বাবার চোখের মনি। বাবা ছোটবেলা থেকেই আদর করে মনি বলে ডাকেন। স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার পর মা তখন রান্নার কাজে ব্যস্ত থাকতেন। তখন বাবাই আমাদের মাথায় তেল দিয়ে গোসল করিয়ে, দুই বোনকে নিয়ে একসঙ্গে খেতে বসতেন। আমি তখনও মাছের কাঁটা বাছতে শিখিনি। বাবা আমাকে মাছের কাঁটা বেছে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। বাবা যেদিন বাড়ি ফিরে দেখতেন আমি বাড়ি নেই বা কখনো কোনো অন্যায় করে ভয়ে লুকিয়ে আছি, মায়ের কাছে শোনার পর মা যদি বলতেন, জানি না, না বলে কোথায় চলে গেছে, তখন বাবা খুব অস্থির হয়ে খুঁজতেন আমাকে। খুঁজে পাওয়ার পর বাবা খুব রাগ দেখাতেন। তখন বাবার সামনে যেতে ভীষণ ভয় হতো। মনে হতো একটা সিংহ যেন সামনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তুলে তাকাতেই ভয় হতো তখন সেই রক্ত রাঙা চোখ দুটোর দিকে। কখনো কখনো অন্যায় কিছু করলে দুই-একটা চড়ও বসিয়ে দিতেন। খেলা করতে গিয়ে বা কোনো কারণে শরীরে সামান্য ক্ষত হলে যখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়তাম, তখন বাবা এসে মলম লাগিয়ে দিতেন। যখন আমি খুব অসুস্থ হয়ে যেতাম, ঝরঝর করে পানি পড়তো বাবার দুটো চোখ দিয়ে। মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। কেন বাবা? কেন তোমার চোখে পানি পড়তো? আমার অসুস্থতা, আমার কান্না কেন তোমার চোখের নদীতে ঢেউ তুলতো?

তখনও বাবার চোখের ভাষা বোঝার ক্ষমতা আমার হয়ে ওঠেনি। আমি বাবাকে মাঝে-মধ্যে খুব চিন্তিত দেখতাম। তখন বাবা কেমন যেন হয়ে যেতেন। কারো সঙ্গে কথা বলতেন না। আমাদের বাঁশতলায় বাগানে দাদুর কবরের পাশে বসে আনমনে কী যেন ভাবতেন। তখন আমার ভিষণ হাস্যোজ্জ্বল বাবার মুখটা আষাঢ়ের আকাশের মতো গম্ভীর হয়ে যেত। বাবা তখন যেন অদ্ভুত রহস্যময় একটা মানুষ হয়ে যেতেন। বাবাকে অমন করে দেখে খুব জানতে ইচ্ছে হতো, বাবা তোমার কী এমন কষ্ট? তুমি মাঝে মাঝে অমন হয়ে যাও কেন? কিন্তু বাবার ভাব গম্ভীর রাগী চেহারার দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে ভয়ে জিজ্ঞেস করা হয়ে ওঠেনি। 

সন্ধ্যাবেলা মাগরিবের নামাজের পর বাবা পড়তে বসতেন। পাশে আমাদের ও বসাতেন। বাবাকে দেখলে বোঝা যায় বাবার পড়াশোনার প্রতি, নতুন কিছু শেখার প্রতি একটা প্রবল আগ্রহ আছে। দাদুর মুখে গল্প শুনেছি, বাবা পড়াশোনায় খুবই ভালো ছিলেন।  কিন্তু দাদুর কাঁধের বড় সংসারের ভার হালকা করতে বাবা অল্প কয়েক ক্লাস পড়াশোনা করেই সংসারের বোঝা কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। যে কারণে বাবার আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠেনি। নিজের কোনো স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি। ছোটবেলা থেকেই বাবা খুব সাধারণ জীবনযাপন করেছেন। অনেক কষ্টে দিন পার করেছেন। একটা রংচটা জামা বার বার গায়ে দিয়েছেন। একজোড়া জুতা বারবার জোড়াতালি দিয়ে পায়ে দিয়েছেন। তবুও আমার বাবা আমার কোন চাওয়া কখনো অপূর্ণ রাখেননি। যখন যা আবদার করেছি সব পূরণ করেছেন। যখন পারতেন না নরম সুরে বলতেন, মা রে কয়টা দিন দেরি কর। এত বড় সংসারের বোঝা আমার বাবার ওপরে, সঙ্গে মায়ের আর দাদির চিকিৎসা তো আছেই। তবুও বাবার মুখে বিরক্তির ছায়া কখনো দেখিনি। বাবা নিজে অসুস্থ হলেও কখনো তাঁকে শুয়ে থাকতে দেখিনি। হাজার অসুস্থতার মাঝে ও বাবা বিশ্রাম না নিয়ে কাজে চলে যেতেন। 

আমাদের জন্য সবটা উজাড় করে দিয়েছেন আমার বাবা। নিজের জীবনের সব শখ আহলাকে হত্যা করে আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে অবলীলায় হেসেছেন। এত এত  দায়িত্ব বাবার ওপর, তবুও তিনি আমার পরিক্ষার সময় একা বের হতে দেননি। পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে বাবা আমাকে কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে শেষ না হওয়া পর্যন্ত গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন আজও। কোনো স্বার্থ ছাড়াই ধরণীর বুকে আমার মুখে হাসি ফোটানোর জন্য কী না করেছেন। 

আমার সততা, আদর্শের প্রতীক আমার বাবা। একজন সুন্দর মনের মানুষ। একজন অদম্য নীরব সাহসী বীর যোদ্ধা আমার বাবা। সেই ছোট্ট থেকে দেখতে দেখতে আজ আমার বয়স ১৯ পেরিয়ে ২০ বছর। সেই ছোট্ট থেকে এখনো পর্যন্ত বাবা প্রতিটি মুহূর্তে একইভাবে মাথার ওপরে ছায়া হয়ে একটি বটবৃক্ষের ন্যায় দাঁড়িয়ে আছেন। কখনো হতাশ হতে দেন না, ভেঙে পড়তে দেন না। আর বিশেষ করে মন খারাপের সময়টাতে বাবা কখনো আমকে একা থাকতে দেন না। যখনই বাবা আমাকে মন খারাপ করে থাকতে দেখেন তখনই একজন বন্ধুর মতো আচরণ করেন। মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ার সাহস দিয়েছেন আমার বাবা। মন খারাপের সময় কখনো আমাকে বই হাতে দিয়ে বলেন আমার পাশে বসে পড় মা। দেখবি মন ভালো লাগবে। নামাজ পড়বি সব মন খারাপ দূর হয়ে যাবে। আমার কাছে আমার সেরা শিক্ষক আমার বাবা। ছোট থেকেই এখনো পর্যন্ত বার বার ভুল করলেও ক্ষমা করে আবারও কাছে টেনে নিয়েছেন। বাবা তবুও কখনো কষ্টের আঁচ আসতে দেননি আমার জীবনে।

আমার বাবা সবসময় নিজে যেমন ভালো কাজ করেন সবসময় সৎ পথে থাকেন, আমাকেও সৎ পথে থাকার, মানুষকে সাহায্য করার, কখনো কারো ক্ষতি না করার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। আমার বেশ মনে আছে একবার মেলায় গিয়ে বাবার কাছে বেশি টাকা না থাকা সত্ত্বেও আমি অনেক বড় একটা জিনিস চেয়ে বসেছিলাম। বাবা বলেছিলেন কাল কিনে দেবো, কিন্তু আমি জেদ করেই বসে আছি হয় টাকা নিয়ে আসো না হয় বাকিতে কিনে দাও। বাবা আমাকে তখন বলেছিলেন মা রে, বাকিতে কখনো শখ আহ্লাদ পূরণের নাম মুখেও  আনবি না। যদি পরে আমি বা তুই কেউ টাকাটা কোনোভাবে শোধ করতে না পারি, তাহলে মানুষের চোখে আমরা নিচু হয়ে যাবো। পরকালে হিসাব দিতে পারবো না। যেদিন আমি থাকবো না, তোর হাজার অভাব অনটন এলেও বাকিতে মৌলিক পূরণের ইচ্ছে, বাসনা মাথায়ও আনবি না।  

বাবাই আমাকে বলেছেন মা রে,  নিজের যতটুকু আছে তাই নিয়ে সন্তুষ্টি থাক, আর সামর্থ্য অনুযায়ী ব্যায় করতে শেখ। মানুষের কাছে কখনো হাত পাতার অভ্যাস করবি না। তাতে মানুষের কাছে তুই ছোট হয়ে যাবি। কোনো আঘাত এলে কখনো ভেঙে পড়বি না। যদি কখনো কোনো কারণে ভেঙেও পড়িস বাইরের কাউকে তোর ভেতরের অবস্থা বুঝতে দিবি না। তাতে তোকে নিয়ে কখনো কেউ কটাক্ষ করতে পারবে না। আমার বাবার কথাগুলো, বাবার দেওয়া আদর্শ, শিক্ষা আমার কাছে শ্রেষ্ঠ শিক্ষা। বাবার দেওয়া শিক্ষা, সততা, আর আদর্শই আমার একমাত্র সঙ্গী। এগুলো আঁকড়ে ধরেছি বলেই আজ আমি ঘরে-বাইরে, কলেজ-ক্যম্পাসে, এমনকী আত্মীয়স্বজনদের কাছেও আমার অবস্থান দৃঢ় ও মর্যাদাসম্পন্ন করতে পেরেছি। 

বাইরে থেকে দেখে করো বোঝার ক্ষমতা নেই আমার ভেতরের অবস্থা। আমার বাবার দেওয়া শিক্ষা, সততা, আদর্শকে আঁকড়ে ধরেছি বলেই আজ আমি মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হয়েও আত্মসম্মানের জন্য সম্ভ্রান্ত পরিবারের মর্যাদা ধারণ করি। আমার কাছে আমার বাবা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বাবা। ভালো থাকুক, সুখে থাকুক পৃথিবীর সব বাবা।

সাতক্ষীরা