ছবি: প্রতীকী

ফেসবুকে ঢুকতেই পুরো ফেসবুকটাই বাবাময় হয়ে গেল। সবাই বাবাকে জড়িয়ে ছবি শেয়ার দিচ্ছে। ক্যাপশনে লিখছেন, বেঁচে থেকো বাবা, বটবৃক্ষের মতো ছায়া দিয়ো বাবা, হাজার বছর ছায়া হয়ে থেকো ইত্যাদি। বাবাকে নিয়ে পোস্ট আর জড়িয়ে ধরা ছবিগুলো দেখে হৃদয়টা নাড়া দিয়ে উঠলো। জানিনা আমার মত কতজনে চাইলেও যে বাবাকে জড়িয়ে ধরে আর ছবি তুলতে পারবে না। আমরা চাইলেও বাবাকে জানাতে পারবো না বাবা দিবসের শুভেচ্ছা।  কারণ আমাদের বাবারা ইতোমধ্যে মহাকালের যাত্রী হয়েছেন। 

নিজেকে অনেকটা অপরাধী মনে হচ্ছে, বাবা বেঁচে থাকা অবস্থায় অনেকগুলো বাবা দিবস পেয়েছি। কিন্তু বাবাকে কখনো বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানানো হয়নি। কারণ, তখন বাবাকে আনস্মার্ট ভাবতাম। মনে করতাম বাবা এসব বুঝবেন না। কিন্তু কখনো বোঝানোর চেষ্টাও করিনি। এখন ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে এই জন্য যে, বাবার ঘাড়ের ওপর চড়ে নিজেকে স্মার্ট ভাবতাম আর বাবাকে ভাবতাম আনস্মার্ট। বাবাকে বাবা দিবসের শুভেচ্ছা জানানোর সেই সুযোগ আজ নেই। হারিয়ে ফেলেছি চিরদিনের জন্য। 

বাবার লাশ নিয়ে যখন কবরের দিকে রওনা দিলেন, তখন মনে পড়ছিল বাবার সাথে অগণিত স্মৃতিগুচ্ছ। সকালবেলা বাবার সুরেলা কণ্ঠে সুরা ইয়াছিন আর সুরা আর-রহমান শুনে ঘুম ভাঙতো আমাদের। বাবা ফজর নামাজের পর উচ্চ কণ্ঠে সুরা ইয়াছিন আর সুরা আর-রহমান তিলাওয়াত করতেন, প্রতিদিন একই সুরার তিলাওয়াত শুনতে শুনতে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেছিল এই ২ টি সুরা। 

বাবা দুপুরে কাজ শেষ করে গোসল করতে গেলে সঙ্গে আমরাও যেতাম। প্রথমে বড় ভাই, মেজ ভাই এভাবে আমিও বাবার হাত ধরে সাঁতার শিখেছি। বাবার ডান হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা ধরে বাজারে যেতাম। আহা! কত মধুর ছিল দিনগুলো। বয়স আমার ৭/৮ বছর হবে। বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট খালে বাবার সাথে মাছ ধরতে যেতাম। বাবার হাতে জাল আর আমার হাতে খালুই থাকত। আধা খালুই মাছ হলে ঘরে ফিরতাম দু'জন। অনেক সময় বিরক্তবোধ করতাম তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসার জন্য।  আজ আর চাইলেও পারব না বাবার সাথে মাছের খালুই ধরতে। 

স্কুলে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হয়ে একটি বিল পার হয়ে রাস্তায় উঠতে হত। বর্ষার দিনে অতিরিক্ত বৃষ্টি হলে বিলে অনেক পানি জমে যেত। স্কুলে যাওয়ার সময় বাবা কোলে করে বিলটা পার করে দিতেন, আর স্কুল থেকে আসার সময় বিলের ওপার থেকে উচ্চ কন্ঠে বাবাকে ডাকতাম। বাবার কোলে করে বিলটা আবার পার হয়ে বাসায় আসতাম। 

আমাকে যখন খতনা করিয়েছিল, তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। সে সময় দূর্ঘটনায় বাবার হাতে প্রচণ্ড ব্যথা পায়। আমার খতনার কয়েকদিন পর বাবা ভাঙা হাত নিয়ে আমাকে স্কুলে নিয়ে যান। বাবার ডান হাতে ব্যথা পাওয়া সেদিন বাম হাত ধরে স্কুলে গেলাম। স্যারদের অনুরোধ করেছিলেন যেন,  আমাকে কিছুদিন লুঙ্গি পরে ক্লাস করার অনুমতি দেন। অনুমতি পেয়ে লুঙ্গি পরে ক্লাস করলাম কিছুদিন। 

ভালো কাজের শুরুতে বিসমিল্লাহ বলে শুরু করাটা বাবার কাছ থেকে শেখা। ছোট বেলা থেকে নামাজের অভ্যসটাও বাবার কাছ থেকে। ঝড়-বৃষ্টির দিনে মসজিদে যেতে না পারলে বাসার সবাই মিলে জামাতে নামাজ আদায় করতাম। এখনো করি, কিন্তু আজ সেখানে বাবা অনুপস্থিত। 

বাবা যখন কাজে যেতেন তখন কোমরে একটা গামছা বেঁধে নিতেন। সবসময় কোমরে গামছা বাঁধা থাকতো। যখন মসজিদ থেকে আযানের শব্দ বাবার কানে আসতো, তখনি কাজ রেখে, কোমর থেকে গামছাটা খুলে নামাজ পড়ে নিতেন। বিশেষ করে আছরের নামাযে এটা বেশি দেখা যেত। আজ এসব শুধুই স্মৃতি। দাদাকে দেখে ছোট্ট বেলা থেকেই বাবা নামাজে অভ্যস্ত, বাবাকে দেখে বাবার সন্তানরা, বাবার সন্তানদের দেখে এখন আমাদের সন্তানরা নামাজে অভ্যস্ত হচ্ছে। কাউকে দেখিনি নামাজের কথা বলতে, নিজ থেকেই এই অভ্যস গড়ে ওঠা। আলহামদুলিল্লাহ।  
  
গতবার ঈদের পর আব্বুর সাথে আমি মেডিকেল ছিলাম আম্মুও ছিলেন। আব্বু তখন নামাজ পড়ার মত সুস্থ ছিলেন। আমাদের সিটগুলো ছিল কেবিন সিস্টেম, নামাজের সুযোগ থাকতো। একদিন মেডিকেলে এশার নামাজ পড়ছিলাম বাবা আর আমি জামাতের সাথে। আমি ইমাম আর বাবা মুকতাদি। বাবাকে বার বার বললাম আপনি এশার ৪ রাকাত সুন্নাত না পড়লে গুনাহ হবে না। আমি জোর করে পড়তে দিই নাই। ফরজ, সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ, ৩ রাকাআত বিতর নামাজ পড়ে আমি বসে থাকলাম। আব্বুও নামাজ পড়ে বসছেন।

একটু পর আমি বের হলাম, তখন আব্বু বসা থেকে উঠে আবার ৪ রাকাআত সুন্নাতগুলো আদায় করতেছেন। জানালার গ্লাস থেকে আমি দেখে অবাক হলাম। সন্তানের সন্তোষের জন্য সন্তানের সামনে পড়েননি। আবার আল্লাহর সন্তোষের জন্য তা ছাড়েননি। বাবাকে সেদিন আরেকবার চেনার সুযোগ হলো। 

আমি তখন কলেজে পড়ি। থাকতাম কলেজের ছাত্রাবাসে। একদিন গ্রামের বাড়িতে যায়। মোবাইল রেখে সম্ভবত গোসল করতে গেছিলাম। তখনি কলেজের এক বড় ভাই কল দিলেন। আমি পাশে না থাকায় বাবা কল রিসিভ করলেন। ওপাশের ভাইটাকে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, আমার ছেলে তো গ্রামে নামাজ-কালাম পড়ে, কলেজে পড়ে কি না? ভাইটা ওইদিক থেকে বাবাকে রিপ্লাই করলেন, আংকেল ও নামাজ পড়ে এবং ফজরের নামাজের জন্য হোস্টেলের সবাইকে ডেকে দেয়। সন্তানদের ভালো কিছু শুনলে বাবাদের হাসিতে মুক্ত ঝরে।  

আমি সম্ভবত তখন ক্লাস ওয়ান অথবা টু-তে পড়ছি। একদিন বাবার সাথে বাজারে যাচ্ছিলাম।  বাবার সঙ্গে হাঁটার সময় সবসময় বাবার কনিষ্ঠ আঙুলটা ধরে চলতাম। আমি একটু পর পর আঙুল ছেড়ে দিয়ে রাস্তার মাঝখানে চলে যাচ্ছিলাম। সামনে থেকে সিএনজি, জীপ, মালবাহী ছোট বড় ট্রাক আসলে আব্বু আমার জন্য ভয় পেয়ে যেতেন। আব্বু তখন আমাকে উপদেশ দিচ্ছেন এভাবে, গাড়ি এলে রাস্তার পাশ দিয়ে হেঁটো। তখন দেখলাম একটি সাইকেল আসছে। সাইকেল দেখে আমি বাবাকে জিজ্ঞেস করলাম, তো সাইকেল আসলে কোন দিক দিয়ে হাঁটবো? বাবাও সেদিন বলেছিলেন, সাইকেল এলে রাস্তার মাঝ দিয়ে হাঁটবে। বুঝতে পারিনি বাবা সেদিন কথাটি রসিকতা করে বলেছিলেন। রসিকতা হোক আর বাস্তবতা হোক, বিশ্বাস করুন আমি এখনো সাইকেল আসলে রাস্তার মাঝখানে হাঁটি। 

বাবা দিবসের বিভিন্ন পোস্ট দেখে বুকটা ভারি হয়ে উঠলো। কত যে স্মৃতি বাবা রেখে গেছেন। বাবার সাথে একই রঙের পাঞ্জাবি পড়ে জুমা পড়তে যাওয়া। বাবার হাত ধরে মাহফিলে যাওয়া এসব আজ শুধুই স্মৃতি। আমাদের বাড়ির পাশে ছোট্ট একটি খাল। জানি না এটাকে খাল বলে কিনা। বর্ষাকালে পাহাড়ের পানি চলাচল করতো। আমাদের ছোট্ট ঘরটা প্রায় প্রতি বর্ষাতেই ভেঙ্গে যেত। ঘরে থাকা বেশির ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে যেত। মা কাঁদতেন। আর বাবা বলতেন, কাঁদছো কেন? আরশের মালিক তো বেখবর নন। পরিবারের প্রতিটি বিপদে বাবাকে নতুন করে চেনার পরম সৌভাগ্য হতো আমাদের। 

আজ ভীষণ মনে পড়ছে বাবাকে। আর দেখা যাবে না বাবাকে, কোনো সুসংবাদ শুনলে বাবা হাত দুটো আকাশের দিকে তুলে দিতেন।  
শোনা যাবে না বাবার মুখে পবিত্র কুরআনের বানী। ‘হালাল সবসময় বরকতময়’ কথাটি মনে করে দিতে আর আসবেন না বাবা। ওগো আরশে আজিমের মালিক, আমার বাবাসহ সব কবরবাসী বাবাকে ক্ষমা করে জান্নাতের সু-উচ্চ মাকাম দান করুন।

সৌদি আরব প্রবাসী